ফ্রিল্যান্সারের স্বাস্থ্য ভাবনা

একটা গল্প দিয়ে শুরু করি। সেটা সেই ২০০৪ সালের দিকের ঘটনা। আমি তখন ফারমাসিউটিক্যাল কোম্পানিতে চাকরি শুরু করেছি। পেশার খাতিরে ডাক্তারদের সাথে ভাল খাতির রাখতে হত। একজন ডাক্তারের সাথে একটু বেশি খাতিরে হয়ে গেল। যিনি বর্তমানে দেশের একজন বড় নিউরো মেডিসিন স্পেশালিষ্ট। প্রায় সময় তার ডরমেটোরিতে যেয়ে, তার সাথে আড্ডা দিতাম। আমাকে ছোট ভাইয়ের মত খুব স্নেহ করতেন। সেই সময় বা এখনো, ঢাকার যে সব ডাক্তার, ঢাকায় ভাল প্র্যাকটিস করতে পারত না, তারা ছুটির দিনে, বিভিন্ন জেলা শহরে যেয়ে প্র্যাকটিস করত। যারা ঢাকায় বসে মশা মাছি তাড়াত, তারাই আবার ঢাকার বাহিরে রাজা, বাদশা। এমনও ডাক্তার দেখেছি, ঢাকায় সারা সপ্তাহে ১০/১৫ জন রোগী পেত কিনা সন্দেহ, সে আবার ঢাকার বাহিরে, জেলা শহরে এক দিনে একশো/দেড়শো রোগী দেখত। যার কথা বলছি, তিনি সেই সময়, শুক্রবারে ঢাকার বাহিরে ১০০+ রোগী দেখতেন। রোগী প্রতি ৫০০ টাকা ভিজিট ধরলে, ৫০ হাজার টাকা। রোগী টেস্টের কমিশন, ঔষধ কোম্পানির গিফট, অন্যান্য মিলে আরও প্রায় ৫০ হাজার। সব মিলে ১ দিনে এক লক্ষ টাকা ইনকাম। মানে শুধু ৪ দিন প্র্যাকটিস করেই, মাসে মাসে ৪ লক্ষ টাকা ইনকাম।
 
 
কোন এক দিন তার সাথে আড্ডা হচ্ছিল। তিনি হাসতে হাসতে, তার মতে , একটা মজার গল্প বলছিলেন। সেটা হচ্ছে, সপ্তাহ আগে, শুক্রবার ভোঁরে, তিনি তার বাসা থেকে বের হচ্ছেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে যাবেন প্র্যাকটিসের জন্য। বাসার দরজার সামনে একটা বেওয়ারিশ কুকুর শুয়ে ছিল। তিনি ঘর থেকে বের হবার সাথে সাথেই, তার পাড়া কুকুরের উপরে পড়ে। কুকুরও সাথে সাথে তার পায়ে একটা কামড় বসিয়ে দিয়ে দৌড়ে পালায়। তিনি ভেবে দেখলেন, এত ভোঁরে হাসপাতাল খোলেনি, সকাল হবার পরে হাঁসপাতালে চিকিৎসা নিতে গেলে অনেক দেরি হয়ে যাবে, মানে আজকের প্রাকটিস বাদ, অর্থাৎ তার ১ লক্ষ টাকা লস। তাই তিনি যেটা করলেন, আবার রুমে ঢুঁকে, কামড়ের জায়গা সাবান পানি দিয়ে ভাল করে ধুয়ে, একটু ড্রেসিং করে ব্যান্ডেজ বেঁধ্‌ বেরিয়ে পড়লেন। ওই অবস্থায় সারাদিন প্র্যাকটিস করেন। এর পরে ঢাকায় এসে আরও ব্যাস্ত হয়ে পড়েন। কয়েক দিন পরে তার মনে পড়ল, তাকে কুকুরে কামড়িয়েছিল। বুঝেন অবস্থা। আমি অবাক হয়ে বললাম প্রায় ১ সপ্তাহ পার হয়ে গেছে, আপনি কি চিকিৎসা নিয়েছেন? তিনি বললেন, না নেইনি। যুক্তি হল, এত দিনে যেহেতু জলাতঙ্কের লক্ষণ প্রকাশ পায় নাই, কাজেই আর সমস্যা নেই।
 
 
গল্পটা বললাম এই কারনে যে, টাকার লোভে মানুষ কি না করতে পারে। একজন সচেতন ডাক্তার পর্যন্ত, এই ধরনের বোকার মত কাজ করতে পারে শুধু টাকার জন্য। আমরা ফ্রিল্যান্সারেরাও কি এর বাহিরে? অবশ্যই না। আমাদের ফ্রিল্যান্সারদের প্রতিটা মিনিট টাকায় হিসাব করা যায়। সেই ২০১৫/১৬ সালের দিকে আমি দিনে ১৮ ঘন্টা পর্যন্ত কাজ করেছি। কারন দেখেছি কাজ করলেই টাকা। তাই খালি কাজ করেই গিয়েছি। এবং তার ফলও হাতে নাতে পেয়েছি। কয়েকবার হাসপাতালে ভর্তি হওয়া হয়ে গেছে। প্রতিদিন বেশ কয়েকটা ওষুধ খেতে হয়। আমার ফ্রিল্যান্সিং লাইফে, যে পরিমান ওষুধ খেয়েছি, আমার সারা জীবনে এত ওষুধ খাইনি। আমার সাথে প্রচুর ফ্রিল্যান্সারের যোগাযোগ আছে, অনেকের সাথেই সরাসরি দেখাও হয়েছে। আমি দেখেছি প্রায় ৯০% ফ্রিল্যান্সারই অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর জীবন যাপন করেন। আমি নিজেও এর ব্যাতিক্রম নই।
 
 
কয়েক দিন আগে আমাদের এক ফ্রিল্যান্সার ছোট ভাই আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়েছেন। আল্লাহ্‌ তাকে জান্নাতবাসী করুন। তার সাথে আমার মেসেজে যোগাযোগ ছিল। কিন্তু ব্যাক্তিগত ভাবে তাকে তেমন জানি না। এখন আমার পূর্বের ডাক্তার এবং রোগী নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতার আলোকে যদি “শার্লক হোমস” স্টাইলে কেস স্টাডি করি, তবে আমি যা যা পেলাম সেটা বর্ণনা করছি। তার হয়েছিল হেপাটাইটিস A, এটা হেপাটাইটিস B বা C এর মত মারাত্মক নয়, এটা খুবই কমন। ধারণা করি, এটা থেকে তার জন্ডিস হয়েছিল। আমাদের দেশে সাধারনত যে জন্ডিস হয়, তার বেশির ভাগ মূলত, এই হেপাটাইটিস A এর কারনেই হয়। তবে B এবং C এর কারনেও জন্ডিস হয়। জণ্ডিস কোন রোগ না, এটা রোগের উপসর্গ মাত্র। কারো জণ্ডিস হলে, প্রধানতম সিকিৎসা হচ্ছে, পুরাপুরি বেডরেস্টে থাকা, কারন এই সময় লিভার ঠিক মত কাজ করতে পারে না। তাই লিভারকে পুরা রেস্ট দিতে হবে। না হলে রক্তের বিলুরবিন বাড়তে থাকবে। এটা টক্সিক উপাদান। শরীর থেকে দ্রুত বের করে দিতে হয়। এই বিলুরবিন এর কারনেই আমাদের মল হলুদ হয়। যখন লিভার ভাল করে কাজ করতে পারে না, তখন এই বিলুরবিন রক্তে বাড়তে থাকে, ফলে আমাদের শরীর হলুদ হতে থাকে। এই জন্য পুরাপুরি বেড রেস্ট এ থেকে লিভারকে সুস্থ হবার সুযোগ করে দিতে হবে। এমনকি সামান্য নাড়াচাড়াও লিভারের উপর চাপ বাড়তে পারে। সাথে খাবার এর কিছু রেস্ট্রিকশন আছে, আর সাথে ওষুধ। আশা করা যায় রোগী দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠবে।
 
কিন্তু কেউ যদি এই অসুস্থ অবস্থায়ও কাজ করতে থাকে, তবে যেটা হবে, তার রাক্তের বিলুরবিন মারাত্মক হারে বেড়ে যাবে। রক্ত দূষিত হয়ে পড়বে। সময় মত চিকিৎসা না করলে, বেশি খারাপ অবস্থায় কিডনি বিকল হয়ে যেতে পারে। আর কিডনি একবার বিকল হলে, সেটা হার্ট এবং ফুসফুসের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলবে। এবং রোগীর অবস্থা খুবই ক্রিটীক্যাল হয়ে যাবে। দেখা যাচ্ছে, উপরের সব কিছু তার সাথে মিলে যায়। হেপাটাইটিস A এর জীবানু আমাদের চারিদিকে গিজগিজ করছে। এটা বিশেষ করে খাবার পানির সাথে বেশি ছড়ায়। পানি যদি বিশুদ্ধ না হয় বা যদি ঠিকমত ফুটানো না হয় বা রোগীর পান করার পাত্রে যদি সুস্থ মানুষ পানি খায়, তবে সেও আক্রান্ত হতে পারে। এই জন্য বড় বড় শহরে, বিশেষ করে ঢাকায় জণ্ডিসের এত প্রকোপ। সামনে গরমকাল আসছে। এটার প্রাদুর্ভাব শুরু হবে। কারন আমারা অনেকেই রাস্তার ধারে অপরিছন্ন অবস্থায় আখের রস বা সরবত বেশি বেশি খাব।
 
 
আমি ধরানা করি তার শরীর আগে থেকেই বেশ খারাপ ছিল। সেই অবস্থাতেই তিনি পরিশ্রম করে গেছেন। গত জানুয়ারিতে তিনি তার নতুন অফিস খোলেন, এর আগে থেকেও তার অনলাইন ট্রেনিং প্রোগ্রাম চালু ছিল, সাথে ফ্রিল্যান্সিং এবং ইউটিউব চ্যানেল। মাত্র ২৩ বছর বয়সে অনেকে বেশি প্রেশার নিয়ে ফেলেছিলেন। এত ধকল তার শরীর নিতে পারেনি। আসলে অনেক সময় পারিপার্শ্বিক কারনে চাইলেও বিরতি নেয়া যায় না। ফলে দেখা যায় অনেকেই হাঁসপাতালের বেডে শুয়ে, বায়ারের কাজ কর্‌ আবার ফেসবুকে ছবি দিয়ে পোষ্ট দেয়। আমি মনে করি এই ধরনের পোষ্ট দেয়া গর্বের নয়, লজ্জার। তার সম্পর্কে আমি এতক্ষণ যা বললাম, সেটা আমার ধারণা মাত্র। যারা তার কাছের মানুষ তারা এটা যাচাই করে বলবেন আমার ধারণা ঠিক আছে কিনা। তিনি পিতা মাতার একমাত্র সন্তান ছিলেন। এটা যে তার পরিবারের উপর কত বড় আঘাত সেটা বোঝাবার ভাষা আমার নেই। আল্লাহ্‌ তাঁদের এই শোক কাটিয়ে উঠার তৌফিক দিন। আমিন! 
 
 
আমার এক ঘনিষ্ঠ ফ্রিল্যন্সার বন্ধু গত বছর মারা যান। তিনিও একটা অগোছালো অনিনন্ত্রিত জীবন যাপন করতেন। মাঝে মাঝে বুকে ব্যাথা করত, কোন গুরুত্ব দিতেন না। ফলাফল নিজের সন্তানের মুখটা না দেখেই, পৃথিবী থেকে বিদায়। প্রার্থনা করি এমন করুন পরিনতি যেন কারো না হয়। এই সব উদাহরণ দিয়ে আমি কাউকে ছোট করতে চাচ্ছি না। শুধু সবাইকে সাবধান করে দিতে চাচ্ছি। আমাদের সব ফ্রিল্যন্সার ভাই বোনদের এখনই সাবধান হওয়া উচিৎ। সবার একটা গোছানো জীবন যাপন করা উচিৎ। কাজের বেশি প্রেশার আসলে, একটা টিম নিয়ে, সেটা ভাগ করে দিয়ে, প্রেশার কমানো উচিৎ। সারাদিন নিজেকে ঘরে আবদ্ধ না রেখে বাইরের জগতের সাথে যোগাযোগ বেশি বেশি বাড়ানো উচিৎ। বেশির ভাগ ফ্রিল্যান্সারের সারা দিন ঘরে থাকার কারনে, ভিটামিন ডি এর মারাত্মক ঘাটতিতে ভুগছে। এর ফলে আমাদের ব্যাকপেইন এবং শরীরে এত ব্যাথা বেদনা হয়। তাই ডাক্তারের পরামর্শে ওষুধ এর পাশাপাশি, বাহিরের রোদে অন্তত ১ ঘন্টা থাকা উচিৎ। সবারই কাজের সময় নিদিষ্ট করা উচিৎ। আমরা যেসব বিদেশী বায়ারদের কাজ করি, তারা কিন্তু সবাই সপ্তাহে দুই দিন আরাম করে। এই সময় তারা কোন কাজ করে না। এমনকি মেইলেরও জবাব দেয় না। তাঁদের লাখ টাকা বাড়তি দিলেও, রাতে কাজ করবে না। অফিস টাইমের ৮ ঘণ্টা বাদে সাধারণত তারা, ওভারটাইম খুব একটা করে না। অথচ তাঁদের সাথে কাজ করে আমরা কত অনিয়ম করি।
 
 
জিওগ্রাফিকাল কারনে আমাদের রাত জেগে কাজ করতেই হয়। কারন আমাদের রাত তাঁদের দিন। ভাল্ হয় যদি আপনি রাত ১২ টা পরে ঘুমিয়ে পড়েন এবং ফজরের সময় উঠে নামাজ পড়ে কাজ শুরু করেন। এই সময় প্রোডাক্টিভিটি সর্বচ্চ থাকে। মানে অন্য সময় চার ঘন্টায় যা করবেন, এই সময় দুই ঘন্টাতেই তার থেকে বেশি কাজ করতে পারবেন। এটা বৈজ্ঞানিক ভাবে প্রমানিত। অনেকেই মনে করেন, রাত জেগে কাজ করলে মানুষ দ্রুত মারা যায়। এসব ভুল ধারণা, যুগ যুগ ধরে অনেক পেশার মানুষ আছে যাদের রাত জেগে কাজ করতেই হয়। তাহলে তারা সবাই অল্প বয়সে মারা যেত। তবে রাতে কাজ করলে কিছুটা হরমনাল ইম্ব্যালেন্স হয় এটা ঠিক। ফলে শরীরের কিছুটা ক্ষতি হতে পারে। তাই রাতে কাজ করে, দিনে যদি ঘুমাতেই হয়, তবে ঘর পুরাপুরি অন্ধকার এবং নিরিবিলি করে রাতের পরিবেশ সৃষ্টি করে ঘুমাতে হবে। এতে রাতের বেলায় আমাদের শরীরে, যে সব হরমোন সিক্রেশন হয়, দিনের বেলাতেও সেটাই হবে। ফলে রাত জাগার ক্ষতি অনেকটাই পুষিয়ে নেয়া সম্ভব। এটা আমার বানানো কোন কথা না, বৈজ্ঞানিক ভাবে প্রমানিত।
 
 
জীবনে টাকার দরকার আছে, কিন্তু তার অর্থ এই না যে, এই টাকা কামাতে যেয়ে আমাদের জীবনটাকে বিসর্জন দিতে হবে। আমরা যৌবনে অমানুষিক পরিশ্রম করে টাকা কামাই, আবার সেই টাকাই শেষ বয়সে খরচ করি জীবন বাঁচানোর জন্য। মাঝখান থেকে আমাদের জীবনটা বরবাদ হয়। কিছু কিছু রোগ আছে যেগুলো নিজেকে ফকির বানাবার পাশাপাশি পুরা পরিবারকেই ফকির বানিয়ে দেয়। যেমন কিডনি, হার্ট, লিভার ইত্যাদি রোগ। নিয়মিত সুস্থ জীবন যাপন আমাদের এই ধরনের রোগ থেকে অনেকটাই মুক্ত রাখতে পারে। এর পরেও যদি এই ধরনের রোগ হ্‌ তবে সেটা নিয়তির বিধান ধরে নিতে হবে। সবার উচিৎ বছরে অন্তত একবার ফুলবডি চেকাপ করানো। এতে বড় কোন রোগ হবার আগেই আগাম সতর্ক থাকা যাবে। ঢাকার বড় বড় হাঁসপাতালে ফুল বডি চেকআপ করার প্যাকেজ আছে। চাইলে পাশের দেশে গিয়েও চেকাপ করাতে পারেন। খরচ খুব একটা বেশি না। পাশাপাশি আমাদের নিজ নিজ ধর্মমত অনুযায়ী সবার ধর্মকর্ম পালন করা উচিৎ। এতে মন ভাল থাকবে কাজে আগ্রহ বাড়বে। নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম এবং ব্যায়াম শরীর ভাল রাখতে সাহায্য করবে।
 
আপনি ভাল থাকলে, আপনার পরিবারও ভাল থাকবে। একজন রেমিটেন্স যোদ্ধা দেশেরও সম্পদ। আসুন নিজের, পরিবার এবং দেশের কথা চিন্তা করে সুস্থ জীবন যাপন করি, নিজেকে সুস্থ রাখি।
ধন্যবাদ!

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *