সময়ের পরিক্রমায়, দৃষ্টিভঙ্গির বদল

মানব জীবন বড়ই বিচিত্র। বয়স বাড়ার সাথে সাথে একটা বিষয় লক্ষ করছি, আর সেটা হচ্ছে সময়ের সাথে সাথে, আমার দৃষ্টিভঙ্গিরও বদল হচ্ছে। আগে যেটা মনে হয়েছিল, আমার সাথে অন্যায় হয়েছে, এখন সেটা মনে হচ্ছে ঠিকই ছিল। আবার যেটা ঠিক ছিল বলে, এতদিন মনে করেছিলাম, এখন মনে হচ্ছে আসলে ঠিক ছিল না। জানি না আপনাদের ক্ষেত্রেও এটা হচ্ছে কিনা। এই দৃষ্টিভঙ্গির বদল নিয়ে একটা গল্প মনে পড়ে গেল।
 
কয়েকশ বছর আগের কথা, অবিভক্ত ভারতবর্ষের কোন এক এলাকার, এক ধনী ব্যাবসায়ী, পবিত্র হজ্জ পালনের ইচ্ছা করলেন। সেই জামানায় হজ্জে যেতে হলে, পায়ে হেটে বা উট বা ঘোড়ায় চড়ে যেতে হত। যেতে আসতে প্রায় বছর লেগে যেত। অনেকেই হজ্জে যেয়ে আর ফেরত আসত না। কারন তারা রোগে ভুগে, বা দস্যুর আক্রমনে মারা পড়ত। যা হোক সেই ব্যাবসায়ি তার এক সৎ ও বিশ্বস্ত, তরুণ কর্মচারীর হাতে, সব কিছুর দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে, পবিত্র হজ্জ পালনের উদ্দেশে রওয়ানা হল। হঠাৎ করে এত টাকা পয়সা, আর ধনসম্পদের দায়িত্ব হাতে পেয়ে, যুবক কর্মচারীর মাথা খারাপ হয়ে গেল। সে কিভাবে কি করবে বুঝে উঠতে পারছিল না।এদিকে কিছু অসৎ, সুযোগ সন্ধানী বন্ধু, তার সাথে জুটে গেল। তাদের কুমন্ত্রনায় তার উপর শয়তান ভর করল। সে মদ, জুয়া আর নারীর পিছনে সেই ধন সম্পদ দেদারসে উড়াতে লাগল। সারাদিন মদের নেশায় সে টাল হয়ে থাকত। আর এই সুযোগে, সবাই ইচ্ছা মত লুটপাট করতে লাগল। সে যে অন্যায় করছে, সেটা সে মাঝে মাঝে স্মরণ করত অনুতপ্ত হত। কিন্তু তার বন্ধুরা তাকে বুঝাত যে, সেই ব্যাবসায়ী আর কোন দিন ফেরত আসেবে না, কারন এই বছর দস্যুদের আক্রমন অনেক বেশি হচ্ছে। সে হয়ত পথেই মারা গেছে, আর কোন দিন ফেরত আসবে না। তাদের কথায় নিশ্চিন্ত হয়ে, সে আরও বেশি বেশি টাকা উড়াতে লাগল। বছর শেষ হবার আগেই, সেই ব্যাবসায়ীর সম্পদ প্রায় শেষ হয়ে গেল।
 
এদিকে পবিত্র হজ্জ পালন শেষে, সেই ব্যাবসায়ি উপস্থিত হল। সে এসে দেখল যে, তার ব্যাবসা, ধন সম্পদ, সব প্রায় নিঃশেষ হয়ে গেছে। সে প্রচন্ড আশাহত হল। এটা সে স্বপ্নেও ভাবেনি। কি আর করার, সে কাজির দরবারে বিচার চাইল। কাজির বিচারে সেই যুবকের প্রানদন্ড হল। যুবক বাঁচার জন্য অনেক কাকুতি মিনতি করতে লাগল। কিন্তু কাজি ছিল সৎ, সে তার সিদ্ধানে অটল। ওদিকে ব্যাবসায়ির মন কিন্তু গলে গেল। সে আসলে সেই যুবককে, নিজের ছেলের মত মনে করত। সে কাজির কাছে আরজি জানাল, যুবককে মৃত্যুদন্ড না দিয়ে অন্য কোন শাস্তি দেয়ার জন্য। যেন সে প্রানে বেঁচে যায়। কিন্তু কাজি তার সিদ্ধান্ত
কোন মতেই পরিবর্তন করতে রাজি হল না। ব্যাবসায়ির অনেক জোরাজুরি পরে, কাজি যুবককে দুইটা অপশন দিল, হয় তাকে প্রাণদণ্ড দেয়া হবে, অথবা তাকে চিরজীবনের জন্য অন্ধ করে দেয়া হবে। যুবক দ্বিতীয়টিকেই বেছে নিল। তার দুই চোখ অন্ধ করে দেয়া হল। সে সেই ব্যাবসায়ির কাছে তার কৃতজ্ঞতা জানাল। কারন তার দয়ার কারনেই তার জীবন বেঁচে গেল। এভাবে তার জীবন চলতে লাগল। যেহেতু সে অন্ধ ছিল, তাই জীবনে সে কিছুই করতে পারেনি। প্রচন্ড গরিবি হালে তার জীবন চলেতে লাগল। কিন্তু এর পরেও, সেই ব্যাবসায়ির প্রতি তার কৃতজ্ঞতা অটুট ছিল।
 
কিন্তু বয়স বাড়ার সাথে সাথে, তার দৃষ্টিভঙ্গিও আস্তে আস্তে বদলাতে থাকল। শেষ বয়সে এসে তার মনে হতে লাগল যে, তার এই দুরবস্থার জন্য আসলে সেই ব্যাবসায়িই দায়ী। সে মনে করতে লাগল, ভুল আসলে সেই ব্যাবসায়িই করেছে। কারন তার মত একজন অল্পবয়সী অনভিজ্ঞ লোকের হাতে, এত বিপুল পরিমান ধনসম্পদ রেখে যাওয়া তার উচিৎ হয়নি। তার মত একজন অভিজ্ঞ ব্যাবসায়ির এত বড় ভুল মানায় না। সেই ব্যাবসায়ি যদি তাকে এই দায়িত্ব না দিত, তবে সে হয়ত এত বড় ভুল জীবনে করত না। তার চোখ হারাতে হত না। সে ছিল সৎ আর পরিশ্রমী। কাজেই সে হয়ত জীবনে সফল হত, অনেক বড় কিছু হত।
 
সারাজীবন যে ব্যাবসায়ির প্রতি সে কৃতজ্ঞ ছিল তার জীবন বাঁচাবার জন্য, শেষ বয়সে এসে সে তাকে অভিশাপ দিতে লাগল তার জীবন ধবংস করার জন্য। আসলে যুক্তির বিচারে কে সঠিক কে বেঠিক, এটা বের করা খুবই মুশকিল। বাস্তবতা হচ্ছে সময়ের সাথে সাথে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিরও পরিবর্তন হয়। কাজেই কোন কিছুকেই ১০০% সঠিক বলে চালিয়ে দেয়া উচিৎ নয়। এক মাত্র সময়ই বলে দিতে পারে, কি ঠিক ছিল, আর কি বেঠিক ছিল।
 
ধন্যবাদ!

Similar Posts