রোগ নির্ণয়ে থ্রি ডক্টরস থিয়োরি

এই থিয়োরির কথা আমি একটা বইতে পড়ি। ঘটনা খুলে বলি, সেটা হচ্ছে কারো যদি কোন বড় রকমের রোগ ধরা পড়ে, তবে চিকিৎসার চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে স্বাধীন ভাবে তিন জন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া উচিৎ। কোন ডাক্তারকেই আগের বিশেষজ্ঞের চিকিৎসার কথা বলা যাবে না। কারন এতে তার সিদ্ধান্ত প্রভাবিত হবে। এভাবে তিনজন বিশেষজ্ঞের ফাইনাল রেজাল্ট জানার পর সিদ্ধান্ত নিতে হবে রোগীর কি ধরনের চিকিৎসা হবে।আরে এটাই হচ্ছে থ্রি ডক্টরস থিয়োরি!

আমি এই পরামর্শ অনেককেই দিয়েছি। কিন্তু নিজের ক্ষেত্রেই এটা প্রয়োগ করতে হবে সেটা কখনো ভাবিনি। ঘটনা খুলে বলি। মাস দেড়েক আগে হঠাৎ করে বুকের বাম পাশে ব্যাথা, শুধু তাই না, সেই ব্যাথা বাম হাত এবং পিঠেও ছড়িয়ে পড়তে লাগল। ভ্য় পেয়ে গেলাম। আমার জেলার স্বনামধন্য হৃদরোগ বিশেষজ্ঞকে দেখালাম। তাকে সব সমস্যার কথা খুলে বললাম। তিনি ECG, ইকো, এক্সরে, রক্ত টেস্ট ইত্যাদির পরীক্ষা দিলেন। ইকো তিনি নিজেই করলেন। রিপোর্ট গুলো দেখার পর তিনি আমাকে রীতিমত বকা দিলেন 🙁 শরীরের কোন যত্ন নেই না বলে (ঘটনা সত্যি) 🙂 তার ভাষ্য মতে আমার হার্টের অবস্থা বিশেষ ভাল না। ইকো রিপোর্ট দেখে তিনি বললেন আমার ইতিমধ্যে একটা মাইল্ড হার্ট এটাক হয়ে গেছে :'( কারন রিপোর্টে বলছে হার্টের Level-1 ডায়াস্টলিক ডিসফাংশন রয়েছে। তিনি আমাকে সাবধান করলেন। অনেকগুলো ঔষধ লিখলেন। তিন সপ্তাহ পর দেখা করতে বললেন। বললেন এর মধ্যে যদি ব্যাথা না কমে, তবে এঞ্জিওগ্রাম করতে হবে এর পরে ডিসিশন হার্টে রিং না বাইপাস :'(

যে আমি ওষুধ খেতে খুবই অপছন্দ করি, এমনকি জ্বর আসলে একটা প্যারাসিটামল পর্যন্ত খাইনা, সেই আমি গত একমাস নিয়ম মত প্রতিদিন তিনবেলা মিলিয়ে ০৮ ধরনের ওষুধ খেয়েছি 🙁 একবেলার ডোজও বাদ দেইনি। আমি আর আমার পরিবার গত একমাস কি রকম টেনশন আর অনিশ্চয়তার মধ্যে দিয়ে গিয়েছি, সেটা ভাষায় প্রকাশ করার মত না। কারন পরিবারের দেখাশোনা পুরাটাই আমাকেই করতে হয়। আমার ছোট বাচ্চাগুলোর দিকে যতবারই তাকিয়েছি ততবারই কষ্টে বুক ভেঙ্গে গেছে। প্রায় একমাস ওষুধ খাবার পরেও যখন ব্যাথা কমার কোন লক্ষণ দেখা গেল না, তখন ধরেই নিলাম যে বড় কিছু গণ্ডগোল হয়ে গেছে 🙁 এর থেকে নিস্তার নেই। নিজের অনিয়মের জন্য অনুশোচনা হতে লাগল। ধরে নিলাম খারাপ কিছু হতে যাচ্ছে। হৃদরোগের চিকিৎসা নিচ্ছে এমন কয়েক জন আত্মীয় স্বজনের পরামর্শ নিলাম। তাদের কথা হচ্ছে দেশের বাহিরে বিশেষ করে ভারতে যেতে হবে চিকিৎসার জন্য। আমিও ধরে নিলাম এটাই করতে হবে। ভারতে যাবার ব্যাপারে প্রাথমিক আলাপ পর্যন্ত করে ফেললাম!

কয়েক দিন আগে হঠাৎ করেই আমার থ্রি ডক্টরস থিয়োরির কথা মনে পড়ল। আগে যেহেতু দীর্ঘদিন ফারমাসিউটিক্যাল কোম্পানিতে চাকরীর অভিজ্ঞতা আছে, তাই ঢাকার অন্যতম বড় একটা কার্ডিয়াক হাঁসপাতালের বড় একজন হৃদরোগ বিশেষজ্ঞের এপয়েন্টমেন্ট নিলাম। ফারমাসিউটিক্যাল কোম্পানির বড় পদে কর্মরত আমার স্নেহের এক ছোট ভাই সব ব্যাবস্থা করল। বিশেষজ্ঞ ডাক্তারকে দেখালাম। তিনি সব কিছু চেক করে আমাকে ETT টেস্ট দিলেন। আল্লাহর রহমতে টেস্টে খারাপ কিছু আসেনি। আমার হার্ট পুরাপুরি ভাল, শুধু তাই না আপনাদের দোয়ায় সর্বচ্চ লেভেলে কাজ করছে। সব রিপোর্ট দেখে তিনি আমার হার্টের সব ঔষধ বন্ধ করে দিলেন। বললেন আমার হার্টে কোন সমস্যা নেই। আসলে আমার মেরুদণ্ডে আগে থেকেই ব্যাথা ছিল আর মাসল পেইনের কারনে এটা হয়েছে। তিনি একজন মেডিসিন বিশেষজ্ঞের পরামর্শে ব্যাথার ওষুধ খেতে বললেন। আগামি পরশু একজন মেডিসিন বিশেষজ্ঞেকে দেখাব ব্যাথার জন্য।

আমার কাহিনী আপাতত এখানেই শেষ। এখন অনেকেই বলতে পারেন যে তিনজন বিশেষজ্ঞ দেখাতে গেলে অনেক টাকা লাগবে ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু আমি বলব আখেরে আপনারই লাভ হবে। কারন সঠিক রোগ নির্ণয় করতে পারলে, ভাল চিকিৎসা হবে দ্রুত আরোগ্য লাভ হবে। অহেতুক কাটাছেড়া এমনকি বড় অপারেশন নাও লাগতে পারে। টাকা বেঁচে যাবে। যেমন আমার ক্ষেত্রে সবাই ধরেই নিয়েছিল হয়ত হার্টে রিং পড়াতে হবে বা আরও বড় কিছু হতে পারে। ইন্ডীয়াতে মাস খানেক চিকিৎসা শেষে কয়েকদিন আগে আমার এক আত্মীয় দেশে ফিরেছে। তার প্রায় আড়াই লাখ টাকা খরচ হয়েছে। আমারও এমন খরচ হতে ধরেই নিয়েছিলাম।

বিশেষজ্ঞে ডাক্তারদের নিয়ে আমি কোন বিতর্কে যাব না। ভুল যে কারো হতেই পারে। তাই তিন জনকে দেখালে এই ভুলের পরিমান কমে আসবে। রোগীর সঠিক চিকিৎসা হবে। উল্লেখ থাকে যে “থ্রি ডক্টরস থিয়োরি” এটা শুধু মাত্র বড় বা জটিল কোন রোগের ক্ষেত্রেই কাজে লাগান উচিৎ। ছোট খাট রোগে, সর্দি জ্বরে এই থিয়োরি কাজে লাগিয়ে টাকার শ্রাদ্ধ না করাই উচিৎ 🙂 বিজ্ঞান সাময়িকীর একটা লেখায় পড়েছিলাম, স্রষ্টা আমাদের দেহ নামক মেশিন এমন ভাবে তৈরি করেছেন যে, সঠিক ভাবে যত্ন নিলে আমরা কমপক্ষে ১২০ বছর বাঁচব। কিন্তু দেখা যায় আমাদের অনিয়ম আর অযত্নে আমাদের এই মেশিন সময়ের আগেই এক্সপায়ার হয়ে যায় 🙁 তাই সবার নিজের শরীরের প্রতি যত্নশীল হওয়া উচিৎ!

একটা প্রাণীর দাঁতের গঠন আকৃতি দেখে বুঝা যায় সে কি ধরনের খাবার খাবে। যেমন বাঘ বা সিংহের দাঁতের গঠন দেখে বুঝা যায় তারা মাংসাশী প্রানী। ছাগল, গরু, হরিন দেখলেই বুঝা যায় তারা তৃণভোজী। আর তারা এসব খেয়েই তাদের লাইফ সাইকেল শেষ করে। ঠিক তেমনি ভাবে মানুষের দাঁতের গঠন দেখে বিজ্ঞানীরা এই সিদ্ধান্তে এসেছেন যে, আমরা মূলত তৃণভোজী প্রাণী যারা মধ্যে কিছুটা মাংসাশী প্রবণতা রয়েছে। অর্থাৎ আমরা মানুষেরা ৮০% তৃণভোজী আর ২০% মাংসাশী। কাজেই আমরা যতবেশি তাজা শাকসবজি খাব এবং মাংস কম খাব, আমরা তত বেশি ভাল থাকব। সব খাবারই খাওয়া যাবে, তবে নিয়ম মেনে এবং পরিমান মত। আর সাথে অবশ্যই ব্যায়াম করতে হবে। দিনে কমপক্ষে ৩০ মিনিট ব্যায়াম।

সবাই সুস্থ থাকুন ভাল থাকুন। এই কামনা করি।

ধনবাদ!

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *