বাবা দিবসের স্মৃতিঃ ধীরে ধীরে সাইকেল চালানো!

আজকে ফেসবুক নিউজ ফিডে দেখি, সবাই বাবাকে নিয়ে পোষ্ট দিচ্ছে। প্রথমে বুঝতে পারিনি, পরে চেক করে দেখি, আজকে নাকি বাব বাবা দিবস। আমি অবশ্য এসব দিবস টিবস মানি না। কিন্তু তার পরেও, বাবাকে নিয়ে সবার পোষ্ট দেখে, আজকে কেন জানি বাবাকে অনেক বেশি মনে পড়ছে।
 
মানুষটা চলে গেছে আজ ১৩ বছর হয়ে গেল। অথচ মনে হচ্ছে, এইত সেদিনের কথা। বাবা কি জিনিস, সেটা বাবাকে না হারানো পর্যন্ত আসলে বোঝা যায় না। বাবা যদি বেঁচে থাকত, তবে আমার জীবনটা হত পুরাপুরি অন্য রকম। কখনো ভাবিনি পুরা পরিবারের দায়িত্ব একা কাধে তুলে নিতে হবে, গ্রামে থেকে জীবন যাপন করতে হবে। প্রতি নিয়ত ঘৃণ্য গ্রাম্য পলিটিক্স মোকাবেলা করে, টিকে থাকার সংগ্রাম করতে হবে। আসলে বাবা বেঁচে থাকলে, এসব নিয়ে কোন চিন্তাই করতে হত না। তবে এসব নিয়ে আমার মনে কোন কষ্ট নেই । বরং মাঝে মাঝে চিন্তা করি, আমাদের জন্য তিনি কতই না কষ্ট করেছেন । বাবার দায়িত্ব পালন করার যোগ্যতা দানের জন্য, আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করি।
 
পুলিশের সাব ইন্সপেক্টরের মত একটা চাকরি করে, আমাদের জন্য কোন সঞ্চয়ই রেখে যাননি, ১ শতাংশ জমি কেনার সামর্থ্যও হয়নি। অথচ তার বেশির ভাগ কলিগদের ঢাকায় বাড়ী, গাড়ি আছে। চাকরি লাইফে একটা সেকেন্ডহ্যান্ড মটরসাইকেল কেনার সামর্থ্যও তার ছিল না। এসব নিয়ে আমার কোন আফসোস নেই। বরং এমন সৎ পিতার সন্তান হিসবে নিজের গর্ব হয়। মানুষটা ছিল খুবই বোকাসোকা, আর সহজ সরল টাইপের। দুনিয়াবি বিষয়ে তার জ্ঞান ছিল খুবই সীমিত, অফিসের লেখালেখির কাজ খুব পছন্দ করতেন। তিনি যদি কোন অফিসের কেরানী বা স্কুলের টিচার হতেন, তবে অনেক ভাল করতেন। ভুল পেশায় থেকে, সারাজীবন মানুষের কটু কথা আর হাসি ঠাট্টার পাত্র হয়ে, কষ্ট করতে করতে, দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন। পবিত্র রমজানের ২৬ তারিখ, জুমাতুল বিদার মত পবিত্র একটা দিনে, তিনি আমাদেরকে ছেড়ে, আল্লাহ্‌র কাছে চলে যান। আল্লাহ্‌ যেন তাকে জান্নাতুল ফিরদাউস সুখে শান্তিতে রাখেন। আমিন!
 
আমার সহজ সরল বাবার কথা বলছিলাম। তিনি কতটা সরল টাইপের মানুষ ছিলেন, সেটা আজকের এই গল্পের মাধ্যমে বুঝতে পারবেন। সেটা নব্বই দশকের শুরুর দিকের কথা, আমি তখন ছোট, ক্লাশ থ্রি বা ফোরে পড়ি। আমাদের জেলার পুলিশ লাইনে, প্রতি বছর ডিসেম্বর মাসে, বিশাল আকারে ক্রীড়া এবং সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা হত। আমরা সারা বছর অপেক্ষা করতাম, এই সময়ের জন্য। কয়েক দিন ধরে এই উৎসব চলত। অনেক মজা হত। আমার আব্বাকে কখনো কোন ধরণের খেলাধুলা বা গান বাজনায়, অংশগ্রহন করতে দেখিনি। খুবই লাজুক টাইপের লোক ছিলেন। সেই বছরের ক্রিড়া প্রতিযোগিতায়, নতুন একটা খেলা যুক্ত হয়েছিল “ধীরে ধীরে সাইকেল চালানো”।
 
ছোটবেলা থেকেই দেখেছি, আব্বা সব সময় সাইকেল চালাতেন। সাইকেল ছিল আব্বার জান প্রান, দিনের একটা বড় সময়, তার ব্যয় হত, সেই সাইকেলের পরিচর্যা করতে। আব্বা সেই পুরাতন ঝরঝরে সেকেন্ড্যান্ড সাইকেলকে, এতটাই ভালবাসত যে, আমাকে ছুতেও দিত না, চালানোত অনেক দূরের ব্যাপার। আব্বা যখন ঘুমাত, তখন চুরি করে সাইকেল নিয়ে বের হতাম, এভাবেই সাইকেল চালানো শিখেছি। এখনকার সন্তানদের মত, একটা সাইকেল আবদার করার সাহস ছিল না, কারন ভাল করেই জানি, তার সাইকেল কিনে দেয়ার সামর্থ্য নেই।
 
আমার সেই আব্বা, হঠাৎ করেই ধীরে ধীরে সাইকেল চালানো শুরু করলেন। দেখা যাচ্ছে, স্বাভাবিক গতিতে সাইকেল চালিয়ে বাসায় আসছেন, কিন্তু হথাৎ করেই গতিবেগ কমিয়ে দিলেন। খুব আস্তে আস্তে চালাতে থাকলেন, বাসায় আসতে হয়ত আর বড়জোর ১ মিনিট লাগত, সেখানে ১০ মিনিট লাগিয়ে বাসায় এলেন। এভাবে দিন নেই রাত নেই, প্রায় ১ মাস আগে থেকেই, তার প্র্যাকটিস চলতে লাগল। বুঝতে পারলাম বাবা এবারের এই নতুন প্রতিযোগিতায় নাম লেখাবেন। যে কোন বিষয়ে আমার আব্বার ডেডিকেশন ছিল দেখার মত। মনে আছে কে যেন আব্বাকে, স মিলের একটুকরা ভাঙ্গা করাত দিয়েছিল। প্রায় দুই ফুট লম্বা, সেই করাতের একপাশে ছিল, খাঁজকাটা, তার উদ্দেশ্য ছিল, এটাকে অফিসে স্কেল হিসবে ইউজ করা,কারন অনেক বড় বড় খাতায় রুল টানতে হল। কিন্তু এই খাজ কাটার জন্য, তিনি সেটা অফিসে নিতে পারছিল না। তাই আব্বা যেটা শুরু করল, সেটা হচ্ছে, প্রতিদিন মাঝরাতে ২/৩ ঘন্টা বাথরুমের মেঝেতে, বালি দিয়ে ঘসে ঘসে, সেই খাজ কাটা পাশটা সমান করার চেস্টা করা। মনে আছে, বালি আর লোহা ঘষার তীব্র শব্দে, আমরা রাতে ঘুমাতে পারতাম না। আমার মায়ের সাথে, আব্বার কয়েক বার ঝগড়াও হয়ে গেল। কিন্তু কে শোনে কার কথা, তিনি ছিলেন ঘাড় ত্যাড়া লোক। আব্বা তার কাজ প্রতি রাতে চালিয়ে যেতেই লাগলেন। আমারাও ধীরে ধীরে অভ্যাস্ত হয়ে গেলাম। আব্বার হয়ত মনে হয়েছিল যে সপ্তাহ খানেক ঘষলেই, এটা সমান হয়ে যাবে। কিন্তু প্রায় এক বছর ধরে প্রতদিন ঘষার পড়েও, আধা সুতা পরিমাণ লোহা কমল কিনা সন্দেহ। ভাগ্য ভাল, বাসায় দেখা করতে আসা, আব্বার এক কলিগের এই ঘটনা চোখে পড়েছিল, তিনি আব্বার কাছে থেকে একরকম জোর করেই, সেই করাতের টুকরা ওয়ার্কশপে নিয়ে গিয়ে, লেদ মেশিনে দিয়ে কেটে, সমান করে বাসায় ফেরত দিয়ে যান। সেই মহান ব্যাক্তি যদি আমাদের এই উপকারটুকু না করতেন। তবে মনে হয় আরও কয়েক বছর এই যন্ত্রুনা আমাদের ভোগ করতে হত।
 
তা আব্বা যখন ধীরে ধীরে সাইকেল চালানো প্র্যাকটিস শুরু করলেন, তখন সবাই ধরেই নিলাম যে, আব্বার প্রথম হওয়া কেউ আর ঠেকাতে পারবে না। যথারীতি প্রতিযোগিতার সময় চলে এল। মনে আছে দুপুরের পরে প্রতিযোগিতা শুরু হল। প্রায় ১০০ জনের মত প্রতিযোগী। পুলিশ লাইনের বিশাল মাঠ। এই মাথা থেকে, সেই মাথা পর্যন্ত যেতে হবে।অনেক দীর্ঘ রাস্তা, আর মাঠটাও বেশ উচু নিচু। ধীরে ধীরে সাইকেল চালানো খুবই কঠিন। রেস শুরু হয়ে গেল। টপা টপ সাইকেল পড়ে আচ্ছে। আমার আব্বা সবার সামনে। দীর্ঘ এক মাসের প্র্যাকটিস বলে কথা। কোন বাঁধাই তার কাছে বাঁধা না। ধীরে ধীরে প্রতিযোগী কমে যাচ্ছে। আব্ব সহ আর মাত্র ১০/১২ জন টিকে আছে। আব্বা যথারীতি সবার সামনে। খুব ধীরে ধীরে সাইকেল চালালেও, আব্বার গতি সব থেকে বেশি, মাঝে মাঝে দেখছি তিনি আড় চোখে পিছিনে দেখছেন। আমি খুব উত্তেজিত, জীবনে আমার আব্বাকে এই প্রথম কোন প্রতিযোগিতায় দেখছি। মাঠে কয়েক হাজার দর্শন উপস্থিত। সবাই হই হুল্লোড় আর চিৎকার চেঁচামেচি করে প্রতিযোগীদের উৎসাহ দিচ্ছে। ধীরে ধীরে সাইকেল চালাতে চালাতে, প্রতিযোগীদের অনেকেই, অনেক পিছনে, কিন্তু আব্বা যথারীতি সবার সামনে।
 
শেষের সীমারেখা আর বেশি দূরে নেই। এবার সবাই আব্বার উদ্দেশ্য বুঝতে পারল। তিনি আসলে ধীরে ধীরে সাইকেল চালিয়ে, সবার আগে পৌছাতে চাইছেন। সবাই চিৎকার করে, তাকে আরো ধীরে ধীরে সাইকেল চালাতে বলতে লাগল। কিন্তু কে শোনে কার কথা। আব্বার মুখে তৃপ্তির একটা হাসি দেখতে পাচ্ছি, সারা জীবন পরাজিত হতে থাকা একজন মানুষ, এই প্রথম কোন কিছু জিততে যাচ্ছে। তৃপ্তির হাসি ঠোটে আসা স্বাভাবিক। কিন্তু মানুষটা জানেই না, এবারও আরও লজ্জার পরাজয় ঘটতে যাচ্ছে। আমি ছোট মানুষ, চিৎকার করে আর কিই বা করতে পারব। আমার আব্বা ধীরে ধীরে সাইকেল চালিয়ে, সব প্রতিযোগীকে অনেক পিছনে ফেলে শেষ প্রান্তে পৌছে গেল। বিজয়ের আনন্দে আব্বা চিৎকার করে, চাইকেল থেকে নেমে, সাইকেলটা উচিয়ে ধরল। লজ্জায় আমি চোখ বন্ধ করলাম। পুরা মাঠের কয়েক হাজার দর্শক, অট্ট হাসিতে ফেটে পড়ল। সবাই খুব মজা পাচ্ছে, এই জামানায় এমন বোকা মানুষও হয়। অনেকেই আজে বাজে মন্তব্য করতে লাগল, কটুক্তি করতে লাগল। আব্বার জন্য খুব খারাপ লাগছিল। এতটা বোকা মানুষ কি করে হয়। ধীরে ধীরে সাইকেল চালানো মানে হচ্ছে যে সবার পিছনে থাকবে, সেই হবে ফাস্ট। এই সাধারণ জিনিষটাই সহজ সরল মানুষটার মাথায় আসেনি।
 
চোখ মেলে দেখি, আব্বা লজ্জায় মাথা নিচু করে মাঠ থেকে বের হয়ে যাচ্ছে। আমারও লজ্জায় মনে হচ্ছিল, মাটি ভেদ করে চলে যাই। এর পর থেকে, আব্বকে আর কোনদিন কোন প্রতিযোগিতায় নাম লেখাতে দেখিনি। আর ওই ঘটনার অনেক দিন প্রযন্ত আব্বাকে নিয়ে সবাই হাসি ঠাট্টা করেছিল। আব্বার এক কলিগ, প্রায়ই বাসার সামনে দিয়ে সাইকেলে যাবার সময়, সাইকেল স্লো করে বলত, ভাই ধীরে ধীরে সাইকেল চালাই। আমার আব্বার ফর্সা মুখটা লজ্জায় লাল হয়ে যেত।
 
এই ছিল আমার আব্বাকে নিয়ে মজার এক সৃতি। এই দুনিয়াতে হয়ত তিনি পরাজিতে খাতায় নাম লিখিয়ে গেছেন। কিন্তু আমি দৃঢ় বিশ্বাস করি, পরকালে ইনশাল্লাহ তিনি বিজয়ীদের প্রথম সারিতেই থাকবেন। তিনি আমার বাবা বলে বলছি না, তার মত সৎ এবং ভাল মানুষ আমি এখনো খুজে পাইনি। তিনি জীবনে মানুষের ভাল ছাড়া, কখনো খারাপ কিছু করেননি। আমার আব্বার জন্য সবাই দোয়া করবেন।
 
ধন্যবাদ!

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *