আমার ফ্রিল্যান্সার হবার গল্প

দুটি কথা

আমি গোলাম কামরুজ্জামান, একজন রাইটার, উদ্যোগতা এবং সব থেকে বড় কথা হচ্ছে আমি একজন ফ্রিল্যান্সার। ফেসুবকে যারা আমার লেখার সাথে পরিচিত এবং যারা আমাকে অনেক দিন ধরে চেনেন। তারা জানেন আমি সেই ২০১৪ সাল থেকে, ফ্রিলান্সিং বিষয়ক লেখালেখি করছি। ২০১৪ সালের অক্টোবর মাসে আমার প্রথম পোষ্ট দেই। সেই থেকে আজ অবধি, নিয়মিত লিখে যাচ্ছি। অনেকেই আমাকে নিষেধ করেছেন এসব না করার জন্য। আবার অনেকেই জিজ্ঞাস করেন, আমার সময় নষ্ট করে কেন আমি এসব করি? উত্তর হচ্ছে, আমি এক ধরনের দায়িত্ববোধ থেকেই এসব করি। কারন আমার ফ্রিল্যনাসিং যাত্রা মোটেই সহজ ছিল না। প্রায় ২ বছর অকল্পনীয় কষ্ট করার পর আমি প্রথম ৫ ডলার ইনকাম করতে পারি। তাই ঠিক করেছিলাম, যদি কখনো সফল ফ্রিল্যন্সার হতে পারি, তবে ট্রাই করব, অন্তত লেখালখির মাধ্যমে হলেও অন্যকে হেল্প করার। সেই থেকে আমার এই লেখালেখি চলছে। আমার চরম শত্রুও (আদৌ যদি কেউ থাকে) বলতে পারবে না যে, আমি এসব করে কারো কাছ থেকে, কোন ধরনের সুবিধা নিয়েছি।

 

আমরা যারা দীর্ঘদিন ধরে ফ্রিলান্সিং করছি, তাদের প্রায় প্রত্যেকেরই সংগ্রামের কাহিনী আছে। কিন্তু লোক লজ্জা হোক, বা অন্য কোন কারনেই হোক আমারা এসব প্রকাশ্যে বলি না। ফলে বাহিরে একটা ধারণা হয়ে গেছে যে, একটা পিসি আর নেট কানেকশন থাকলেই সবাই বড় ফ্রিল্যন্সার, ফলাফল খালি ডলার আর ডলার। আর এই সুযোগটা কাজে লাগিয়ে প্রতারকেরা প্রতারনার, রমরমা বাণিজ্য করে যাচ্ছে। আমার মনে হয় কারো কোন গল্প থাকল্‌ বলে ফেলা উচিৎ। অন্তুত মানুষ প্রকৃত বিষয়টা জানুক। আমারও অনেক দিন ধরেই ইচ্ছা ছিল যে, আমার এই সংগ্রামের কাহিনী বলি। কিন্তু ব্যাস্ততার কারনে হয়ে উঠছিল না। গত বছর আমার খুব কাছের একজন বন্ধু, সুবর্ণ ইসলাম ভাই হঠাৎ করেই মারা যান। অনেক সফল একজন ফ্রিল্যান্সার ছিলেন। তারও অনেক বলার মত গল্প ছিল, কিন্তু বলে যেতে পারেননি। সেই থেকে একটা তাড়না অনুভব করছিলাম, আমার গল্প লিখে ফেলার। তাই অবশেষে লিখে ফেললাম আমার ফ্রিল্যান্সার হবার গল্প!

ধন্যবাদ!

আমার আমি

মিডিয়ার কল্যানে ফ্রিলান্সিং এখন হটকেক। অনেকেই মনে করেন,একটা পিসি আর নেট কানেকশন থাকলেই হল,যে কেউ ফ্রিলান্সার হতে পারবে ফলাফল ডলারের বন্যা। বিষয়টা আসলে তা নয়। একেকজন ফ্রিল্যন্সার হচ্ছে একেক জন যোদ্ধা। হাজারো বাঁধা পেরিয়ে, অনেক সাধনার পরে একজন ফ্রিল্যন্সার তৈরি হয়। এই বন্ধুর যাত্রায় কতজন যে ঝড়ে পড়ে, তার কোন হিসাব নেই। আমরা শুধু সাফল্যই দেখি, এর পিছনের কষ্টের কাহিনী আমরা জানি না। আমিও একজন ফ্রিল্যন্সার, গর্বিত একজন রেমিটেন্স যোদ্ধা,সামান্য কিছু বৈদেশিক মুদ্রা হলেও, দেশে আনার মাধ্যমে, দেশের উন্নয়নে কিছুটা হলেও ভুমিকা রাখি। তবে আমার চলার পথ মোটেও মসৃণ ছিল না। বলা যায় সেটা ছিল এক ভয়ংকর আর অনিশ্চিত যাত্রা। অনেক দিন ধরেই ভাবছিলাম আমার ফ্রিল্যান্সার হবার গল্প বলব।কিন্তু সময়ের অভাবে হচ্ছিল না।অবশেষে সেই সুযোগ চলে এসেছে। আমি আমার গল্প লিখতে পেরেছি।যা হোক,কথা না বাড়িয়ে শুরু করা যাক।

আমি নিম্ন মধবিত্ত পরিবারের সন্তান। বাবা ছিলেন স্বল্প বেতনের একজন সৎ সরকারী পুলিশ অফিসার। আমাদের খাওয়া পরার তেমন কষ্ট না থাকলেও, পরিবারে প্রাচুর্য ছিল না। দেখেছি আমার মা শাড়ি সেলাই করে, হাঁস মুরগি পালন করে সংসারের ঘাটতি মেটাতেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা রেশনের পচা চাল বাছাই করতেন। রেশনের চাউলের পাথরের কারনে তার দুইটা দাঁত ভেঙ্গে গিয়েছিল। এই কিছুদিন আগে আমার মায়ের, দুইটি দাঁত বাঁধিয়ে দিয়েছি। স্কুলে যে বয়সে সবাই আড্ডা আর খেলাধুলায় ব্যাস্ত থাকত, সেই বয়সে আমি আমার ৪/৫টা ছাগল চড়ান নিয়ে ব্যাস্ত থাকতাম। বিষয়টা আর কিছুই না, যদি পরিবারে একটু উন্নতি হয়।বড় সন্তানের আসলে অনেক দায়িত্ব থাকে। আমার মায়ের মুখে একটি কথাই, বার বার শুনে বড় হয়েছি, সেটা হচ্ছে, “তুই কবে বড় হয়ে চাকরি করবি, পরিবারকে হেল্প করবি”

পড়াশোনায় ছন্দপতন

আসলে আমার তেমন কোন স্বপ্ন ছিল না। মাথায় একটা কথাই গেঁথে গিয়েছিল, আর সেটা হচ্ছে, পড়াশোনা শেষ করে, যে করেই হোক, একটা চাকরি জুটিয়ে পরিবারেকে সাহায্য করতে হবে। বাবা সৎ হওয়াতে কোথাও বেশিদিন থাকতে পারতেন না, বার বার বদলি করা হত। এমনও হয়েছে, বছরে আমি দুবার স্কুল চেঞ্জ করেছি। মেধাবী ছাত্র ছিলাম,সব সময় ক্লাসে ফাস্ট সেকেন্ডের মধ্যে থাকতাম। কিন্তু এসব সমস্যার কারনে পড়াশোনায় অনেক ব্যাহত হয়েছে। এস এস এসসি পরীক্ষায় অনেক ভাল রেজাল্ট করেছিলাম।সবাই বলাবলি করছিল যে একে একটু সুযোগ দিলে জীবনে বড় কিছু হবে। কিন্তু বাবার সেই বদলির সমস্যার কারনে, ইন্টারমিডিয়েটে পড়াশোনার ব্যাপক ক্ষতি হল। পড়াশোনা এক রকম বন্ধ হবার উপক্রম হল। টাকার সমস্যার কারনে আমি যে কলেজে ভর্তি হয়েছিলাম, সেখানে থেকে পড়তে পারলাম না। কারন বাবার টাকা দেয়ার ক্ষমতা নেই। বাবার বদলী যেখানে, সেখানে চলে এলাম। সেটা ছিল এক মফস্বল এলাকা। কলেজে টিচার ছিলা না বললেই চলে। বলা যায় নিজে নিজেই পড়ে পরীক্ষা দিলাম। ফলাফল টেনেটুনে সেকেন্ড ক্লাশ। আমার জীবনের একটা বড় ছন্দপতন হল বলা যায়।

কি আর করার, মফস্বল শহরের কলেজে অনার্সে ভর্তি হলাম। কিন্তু পড়াশোনা আর শেষ হয় না। তখন তিন বছরের অনার্স কোর্স ছিল। সেশনজটের কারনে, সেটা শেষ করলাম প্রায় পৌনে ছয় বছরে। অধৈর্য হয়ে মা প্রায়ই বলতেন, তুই মনে হয় ফেল করিস, না হলে পড়াশোনা শেষ হতে এস সময় লাগে কেন? মনের কথা কি করে তাকে বুঝাই। একদিন অনার্সের রেজাল্ট বের হল। মোটামুটি ভাবে পাশ করলাম। বাবার টানাটানির চাকরীর অবস্থা দেখে, আগেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে, কখনো সরকারী চাকরি করব না। কারন সরকারী চাকরি পেতে অনেক সময় লাগে। আমার সেই সময় নেই। মাস্টার্স করব না সিদ্ধান্ত নিলাম, কারন আমাকে একটা চাকরি যোগাড় করে, পরিবারকে হেল্প করতে হবে।

ঢাকায় অনিশ্চিত যাত্রা

অনার্সের সারটিফিকেট তখনো বের হয়নি। রেজাল্ট সিটের ফটোকপি, আর একবুক আশা নিয়ে ঢাকায় চলে এলাম চাকরীর খোঁজে। ঢাকায় একেবারে নতুন, প্রায় কোন কিছুই চিনি না,কোন আত্মীয় স্বজন আছে কি না সেটাও জানি না। থাকার কোন জায়গা নেই। শুনলে অবাক হবেন ঢাকায় যার কাছে উঠেছিলাম,তাকে আমি এর আগে কখনো দেখিনি। এক জব ইন্টারভিউ দিতে যেয়ে, তার সাথে পরিচয়। ঢাকায় থাকার জায়গার ব্যাবস্থা হয়নি শুনে, সে আমাকে প্রস্তাব দিল তার সাথে থাকার। তার নাকি একটা বেড খালি আছে। আমি কথা না বাড়িয়ে তার সাথে তার মেসে গেলাম। বুঝলাম দুনিয়াতে এখনো অনেক ভাল মানুষ আছে। থাকার ব্যাবস্থাটা না হলে, হয়ত আবার বাড়ী ফিরে যেতে হত, আরো দেরি হত চাকরি পেতে।সেই বেচারা আমার কাছ থেকে থাকা বাবদ কোন টাকাও নেয়নি। জানি না সে কোথায় আছে এখন। দোয়া করি যেখানেই থাকে, যেন ভাল থাকে,আমি যে তার কাছে ঋণী।

সোনার হরিণ প্রাপ্তি

আমার গল্প এই পর্যন্ত শুনে, আপনারা হয়ত মনে করছেন, আমার প্রথম চাকরি যোগাড় করতে, অনেক কষ্ট করতে হয়েছিল, হয়ত অনেক দিন অপেক্ষা করতে হয়েছিল। বিষয়টা আসলে ভুল। আমার ক্যারিয়ার শুরু হয়েছিল বলা যায়, সোনার চামচ মুখে নিয়ে। দ্বিতীয় ইন্টারভিউতেই দেশের নামকরা এক ফারমাসিউটিক্যাল কোম্পানিতে মেডিকেল প্রমোশন অফিসার হিসেবে সিলেক্ট হয়ে যাই। সেটা ২০০৪ সালের কথা। বেতনও ছিল হ্যান্ডসাম। বলা যায় খোদা আমাদের দিকে মুখ তুলে তাকালেন। জীবনের প্রথম বেতন পেয়েই, মায়ের হাতে তুলে দিলাম। মায়ের চোখে সেই আনন্দের কান্না, এখনো আমার চোখের সামনে ভাসে। চাকরীতে আমি দ্রুত উন্নতি করতে লাগলাম। চাকরিটা আমি খুবই উপভোগ করতাম। চাকরীর মাত্র আড়াই বছরের মাথায়, আমার প্রথম প্রমোশন পেলাম। চকরির পাশাপাশি মাস্টার্সটাও কমপ্লিট করে ফেললাম। মজার ব্যাপার হচ্ছে,আমি আমার ডিপার্টমেন্ট থেকে, পরীক্ষায় হাইয়েস্ট নাম্বার পেয়েছিলাম।চাকরি করার পাশাপাশি, সামান্য পড়েই এত ভাল রেজাল্ট করলাম, ক্লাশের বন্ধুরা এটা মেনে নিতে পারছিল না। তাদের সে কি আফসোস। ভাবতে গেলে এখনো হাসি পায়। অথচ বন্ধু বান্ধবদের কেউ তখনও কর্ম জীবনে প্রবেশ করেনি। স্বপনের মত সব কিছু চলছিল।

আনন্দের সেই দিনগুলি

পরিবারে স্বচ্ছলতা ফিরে এল। মাসের বেতন পেলেই, নিজের খরচের টাকাটা রেখে, পুরটাই মায়ের হাতে তুলে দেই।ঢাকায় চাকরি করি। কাজ শেষ করে, বৃহস্পতিবার রাতে, শেষ বাসটা ধরে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেই।মাঝরাত পার হবার পর বাসায় আসি। বাবা আমার জন্য জেগে থাকেন। আমি আসলে দরজা খুলে দেন। আমাকে দেখে তার, চোখ মুখে কি আনন্দের হাসি। শুক্রবারটা শুয়ে বসে,টিভি দেখে,বাসাতেই কাটাই।এই একটা দিনই মা একটু ভাল মন্দ রান্না করেন। তারা একটাই কথা আমাকে ছাড়া, বাসায় ভাল কিছু রান্না হবে না। আমরা তিন ভাই আর মা বাবা মিলে, এক সাথে দুপুরের খাবার খাই। আমার ছোট ভাই আফসোস করে বলে,তুমি প্রতিদিন আসতে পার না? তাহলে আমরা প্রতিদিন ভাল ভাল খাবার খেতে পারতাম। শনিবার ভোঁরের ফাস্ট ট্রিপের বাসে করে ঢাকা চলে আসি। আবার পরের বৃহস্পতিবারের অপেক্ষা, বলা যায় জীবনটা স্বপনের মত আনন্দে কেটে যাচ্ছিল। এভাবে প্রায় আড়াই বছর পার হয়ে গেল। পরিবারের পছন্দে, বিয়ে করে নতুন সংসার শুরু করলাম। মাঝে কোম্পানি থেকে, কয়েকবার বিদেশ ভ্রমন করে এলাম। জীবনটা সিনেমার গল্পের মত মনে হচ্ছিল। চারিদিকে শুধু সাফল্য আর সাফল্য।

জীবনের বড় ছন্দপতন

হঠাৎ একটা বজ্রপাতে জীবনটা এলোমেলো হয়ে গেল। আমার বাবা হঠাৎ করেই ২০০৮ সালে মারা গেলেন। তিনি ছিলেন পরিবারে ছাতার মত। এই ঘটনার জন্য আমরা মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। তার মৃত্যুর কারনটা সেই সরকারী চাকরিই,আগেই বলছি, তিনি খুব সৎ,আর সরল মনের মানুষ ছিলেন।কি ভাবে পুলিশের চাকরীতে ঢুকলেন সেটা এক রহস্য বটে।ফলে তাকে বেশি বেশি খাটানো হত। রাত নেই, দিন নেই তাকে খালি ডিউটি দেয়া হত। এটা করতে করতে তার শরীর ভেঙ্গে পড়ল। সাথে ছিল ডায়াবেটিস। আমি তখন ঢাকায় থাকি। এসব খেয়াল রাখার কথা না। আমার মা ছোট ভাইয়েরা,সবাই ময়মনসিংহে গ্রামের নতুন বাড়ীতে থাকে। আর বাবা ছিলেন দূরে শেরপুরে তার কর্মস্থলে। মা সাথে থাকলে, বাবার সেবা যত্নের ত্রুটি হত না। কিন্তু দূরে থাকতে্‌, অনিয়মে তার শরীর আরও ভেঙ্গে পড়তে লাগল। কিন্তু তার ঊর্ধ্বতনেরা নুন্যতম মানবিকতা দেখাল না। এভাবেই আমার বাবাকে শেষ করে দিল। মাত্র ৫০ বছর বয়স হয়েছিল তার। আমরা হাঁসপাতালে নিয়েও কিছু করতে পারিনি। তখন তার শেষ অবস্থা। এখন অনেক আফসোস লাগে। আমার বর্তমান অবস্থা যদি তখন থাকত, তাহলে বাবাকে কখনোই চাকরি করতে দিতাম না। হয়ত তাকে আরও অনেকদিন কাছে পেতাম। ২৬শে রোজার জুম্মার দিনে তিনি আমাদের কাছে থেকে বিদায় নেন। আল্লাহর কাছে দোয়া করি। তিনি যেন তাকে জান্নাতে দাখিল করেন।

জীবন নামের জেলখানা

আব্বার শোকে আমার মা অনেকটাই মানসিক রোগী হয়ে গেলেন। পুরা পরিবারের দায়িত্ব আমার উপরে চলে এল।দুইটা ফ্যামিলি চালাতে যেয়ে আমার,একার বেতনের টাকায় টান পড়তে লাগল। দিনে দিনে ঋণের জালে আটকে যেতে লাগলাম।পিতৃশোক আর ঋণের কারনে, দিন দিন মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়তে লাগলাম। এসব কারনে কোম্পানিতে, আমার পারফরমেন্স দিন দিন খারাপ হতে লাগল। যেখানে আমার দ্রুত আরেকটা

প্রমোশন হবার কথা ছিল, সেখানে চাকরি নিয়েই টানাটানি। মার্কেটিং এর চাকরি করি বলে অফিসের বদলে,বাহিরে বাহিরে বেশির ভাগ সময় থাকতে হত। ঢাকার ধুলা ময়লা আর ধোয়ায় এজমার রোগী হয়ে গেলাম,শীতকাল আসলে প্রচন্ড শ্বাসকষ্টে কষ্ট পেতাম। বলা যায় প্রতিদিন রাতেই মৃত্যুর স্বাদ পেতাম। শরীর দিন দিন খারাপ হতে লাগল।বড় বড় ডাক্তার দেখালাম। কিন্তু কোন ওষুধেই কাজ হচ্ছিল না।কাছের এক ডাক্তার বললেন, আপনি ঢাকায় থাকলে বেশি দিন বাঁচবেন না। পারলে ঢাকা ছেড়ে পালান। সেই থেকে আমার মাথাও ঢুঁকে গেল, ঢাকা থেকে পালাতে হবে। এর মধ্যে আমার বস চেঞ্জ হয়ে গেল। নতুন বস এসে, আমার মানসিক দুর্বলতাকে পূঁজি করে, আমার জীবনটাকে স্রেফ নরকে পরিণত করে ফেলল। চাকরীর এই বদ্ধ জীবন আর ভাল লাগছিল না। কাজের চাপে মাঝে মাঝে আত্মহত্যা করতে ইচ্ছে হত। এটা থেকে যে বের হব, সেই উপায়ও ছিল না। অনেকগুলো মানুষ আমার উপর নির্ভরশীল। অনেকটা বাধ্য হয়েই চাকরি করে যাচ্ছিলাম,এটা ছিল আমার জন্য একটা জেলখানা।

 

ঢাকা ছেড়ে পালালাম

আমার জেলায় দুর্নীতির কারনে, একজনের চাকরি চলে গেল। কারো পৌষ মাস কারো সর্বনাশ।আমার সামনে সুযোগ এল ঢাকা ছেড়ে পালিয়ে যাবার। এই সুযোগে অনেক অনুরোধ আর অনুনয় বিনয় করে, বলা যায় এক রকম জোর করেই, নিজের জেলায় বদলি নিলাম। উদ্দেশ্য নিজের যান বাঁচানো আর, কাছে থেকে পরিবারকে সাপোর্ট দেয়া। আমার ঢাকা থেকে পালানোর গল্প এখান থেকে পড়তে পারেন। মানুষ ভাবে এক, আর হয় আরেক। নিজের জেলাতে এসে চাকরি করা আরও কঠিন হয়ে গেল। আমার আগের জনের দুর্নীতির কারনে, সেলসের অবস্থা মারাত্মক খারাপ ছিল। ফলে সেলসের প্রচন্ড প্রেশার আর বসদের চাপ অব্যাহত রইল। অনেক বড় একটা টীম চালাতে হয়,কয়েকটা জেলা মিলে আমাকে দেখতে হত। কে না জানে, মানুষ চড়ান দুনিয়ার সব থেকে কঠিন কাজ। জীবনটা দিন দিন, কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে যেতে লাগল। এর মধ্যে ২০১০ সালে আমাদের প্রথম সন্তান দুনিয়াতে এল।

 

নতুন চ্যালেঞ্জের সন্ধানে

 

অবশেষে চাকরি ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েই নিলাম। বুঝলাম আমার দ্বারা আর এই চাকরি করা সম্ভব না। সালটা ছিল ২০১১। ঠিক করলাম মার্কেটিং এর চাকরি ছেড়ে দিয়ে, অফিশিয়াল একটা জব নেব, উদ্দেশ্য ছিল, একটু শান্ত নিরিবিলি নিরঝঞ্ঝাট জীবন কাটানো। আমি সেই ২০০৮ সাল থেকেই ফ্রিলান্সিং সম্পর্কে জানতাম। কিন্তু মনে মনে ইচ্ছা থাকলেও,কখনো সিরিয়াস ছিলাম না।কারন বেশ সম্মানজনক একটা চাকরি করতাম। সামাজিকতার ভয়ে সেটা ছেড়ে নতুন চ্যালেঞ্জ নেয়া সম্ভব ছিল না। নতুন চাকরিতে আসার একটা উদ্দেশ্য মনে মনে ছিল, সেটা হচ্ছে, নিদিষ্ট কোন একটা বিষয় ভাল করে শিখব, যদি কখনো ফ্রিলানসিং করা যায়।

 

একটা স্বাধীন জীবনের স্বপ্ন সব সময় দেখতাম। কিন্তু ভাল একটা চাকরি ছেড়ে, নতুন একটা চ্যলেঞ্জ নেয়া খুব কঠিন একটা কাজ ছিল। নতুন চাকরি এই সম্ভবনাকে বাস্তবায়ন করার সুযোগ করে দিল। কিন্তু মানুষ ভাবে এক আর হয় আরেক। যে আরাম আয়েশের উদ্দেশে নিজের জেলাতে,নতুন চাকরি নিয়েছিলাম, সেটা শুরুতেই উবে গেল। সকাল ৯ টা থেকে শুরু করে রাত্র ৯ টা পর্যন্ত আফিস করতে হত। কাজের চাপে অন্য কিছু চিন্তা করার সুযোগই ছিল না। মনটাই খারাপ হয়ে গলে। নতুন জবটা ছিল, একটা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের,বড় একটা মাদক নিরাময় কেন্দ্রের,অফিশিয়াল বিষয় দেখা। কিন্তু আমাকে অফিশিয়াল জবের পাশাপাশি মাদকাসক্তদের কাউনসেলিংও করতে হত।যে আমি নিজে জীবনে একটা সিগারেটে টান দেইনি, সেই আমি মাদকাসক্তদের উপদেশ দিতাম। এর থেকে হাস্যকর কিছু আর হতে পারে না। বাধ্য হয়েই এসব করতে হত। কোন উপায় ছিল না।আসলে চাকরি মানে হচ্ছে চাকরগিরি, স্বাধীনতা বলতে কিছু নেই। আর অফিসের বস যদি হয় খারাপ এবং তার নেক নজর যদি না থাকে। তবে চাকরিতে এর থেকে খারাপ কিছু হতে পারে না। আমার অবস্থাও তাই হল। আমি স্বাধীনচেতা মানুষ, সৎ জীবন যাপন করতে পছন্দ করি। কাউকে তেল দেয়া আমার একেবারেই অপছন্দের কাজ। আর এটাই আমার চাকরীর করার ক্ষেত্রে মূল অন্তরায়।

জীবনের সব থেকে ভুল সিদ্ধান্ত

 

আসলে জীবনে সঠিক ক্যারিয়ার খুজে বের করা, সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ।আমার যে কজটা করি সেটা আমাদের সব থেকে অপছন্দের কাজ। আমি খুব কম মানুষ পেয়েছি যে, সে তার কাঙ্ক্ষিত ক্যারিয়ার খুজে পেয়েছে।এই চাকরিটা ছিল আমাদের জীবনের এ যাবত কালের সব থেকে ভুল সিদ্ধান্ত যার জন্য এখনো মাঝে মাঝে আফসোস হয়।জীবনটা দিন আরও কঠিন হয়ে যেতে লাগল। দিনের পর দিন মানসিক বিকারগ্রস্ত মাদকাসক্তদের সাথে থাকতে থাকতে, আমিও মানসিক ভাবে অসুস্থ হয়ে যেতে লাগলাম। তাদের কাছ থেকে যে পরিমান অভিজ্ঞতা আর গল্প শুনেছি, তা ঠিকমত গুছিয়ে লিখতে পারলে, অনেক বড় লেখক হয়ে যেতাম।উদাহরণ হিসেবে, একজন মাসকাসক্তের একটা গল্প বলি। তার পরিবার জোর করে তাকে মফস্বলের এক মাদক পুনর্বাসন কেন্দ্রে ভর্তি করেছে। প্রায় ২৫ জনের মত তারা আছে। কিভাবে পালাবে কয়েক জন মিলে ফন্দি করতে লাগল। কেন্দ্রের নিরাপত্তা খুব কঠোর, ভেঙ্গে পালাতে পারবে না। জোর করেও কোন ফয়দা নেই।

 

তারা খেয়াল করল, শহরের এক প্রভাবশালী নেতার ছোট ভাই কয়েকদিন হয় সেখানে ভর্তি হয়েছে। নেশা করে করে, তার শরীর একেবারে ভেঙ্গে পড়েছে, শরীর খুবই দুর্বল, সারদিন ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়। তারা বুঝতে পারল এই হচ্ছে সুযোগ। রাতে বেলা তারা কয়েকজন মিলে হাত পা চেপে ধরে, বালিশ চাপা দিয়ে,তাকে মেরে ফেলল। এর পর খুব সাধারণ ভাবে সবাই ঘুমিয়ে পড়ল, যেন কিছুই হয়নি। সকাল বেলা পুনর্বাসন কেন্দ্রের লোকজন ঘটনা টের পেয়ে গেল। সবাইকে জেরা করতে লাগল সাথে প্রচন্ড মারধোর। কিন্তু তাদের ভাবটা এমন, যেন সবাই ধোয়া তুলসি পাতা, কেউ কিছু জানে না। মালিক পক্ষ বুঝতে পারল, পার পাবার কোন উপায় নেই। তারা তালা ঝুলিয়ে সবাই পালিয়ে গলে। এমন ঘটনা বেশিক্ষণ চাপা থাকে না, জানাজানি হয়ে গেল । নেতার লোকজন এসে সব ভাংচুর আর লুটপাট করতে লাগল। এই সুযোগে তার সবাই পালিয়ে গেল্। আমি তাকে সরাসরি জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কি এই খুনের সাথে জড়িত ছিলেন। উত্তরে সে একটা রহস্যময় হাসি উপহার দিল।

 

সিদ্ধান্তহীনতার দুই বছর

বুঝতে পারলাম এভাবে আর বেশিদিন চলতে পারে না। বুঝালাম এই চাকরি আমার জন্য না। আবার চাকরি ছেড়ে, করবটা কি, ফ্রিলান্সিংত অনেক দুরের বিষয়। আত্মবিশ্বাস তলানিতে চলে গেল। ডিপ্রেশনে ভুগতে লাগলাম। ওজন বৃদ্ধি আর এজমা সমস্যা জীবনটাকে নরকে পরিণত করতে লাগল। এর মধ্যে রাতে নাইট ডিউটি শুরু হল।বসে বসে রোগীদের পাহারা দিতে হয়। সময় কাটতে চায় না। ভাবলাম এই একটা সুযোগ। বিক্রয় ডট কম থেকে একটা পুরাতন ল্যাপটপ কিনে, রাতে বসে বসে ওয়েব ডিজাইনের কাজ শিখতে লাগলাম। দুঃখের বিষয় অফিস পলিটিক্সে পড়ে গেলাম। বস জেনে গেল যে, আমি গোপনে গোপনে ফ্রিলান্সিং শিখছি। ব্যাস নিষেধাজ্ঞা এল যে, রাতে ল্যাপটপ সাথে রাখা যাবে না। ফ্রিলান্সিং শেখা শিকেয় উঠে গেল।

আমি গ্রামের বাড়ি থেকেই, প্রতিদিন মোটরসাইকেলে ২০ কিঃমিঃ পথ পাড়ি দিয়ে শহরে এসে অফিস করতাম। আবার রাতে ফেরত যেতাম। এক দিন সকালে অফিসে আসার পথে, মারাত্বক মোটরসাইকেল এক্সিডেন্ট করি। অল্পের জন্য বেঁচে যাই। পায়ে প্রচন্ড আঘাত পাই।ধরেই নিয়েছিলাম মনে হয় পঙ্গুই হয়ে যাব। যা হোক, আল্লাহর রহমতে তেমন কিছু না হলেও, এখনো আমার পায়ে সমস্যা রয়ে গেছে। বেশি হাঁটলে পায়ে প্রচন্ড ব্যাথা করে।অথচ এক্সিডেন্টের মাত্র ৫ দিনের মাথায় আহত অবস্থায়ই আমাকে অফিসে জয়েন করতে হয়। তাদের যুক্তি হচ্ছে,যেহেতু অফিশিয়াল জব, তাই ডেস্কে বসেই কাজ করতে পারব। আসলে এসব ঘটনায় চাকরীর উপর থেকে মত একেবারে উঠে গেল। বলা যায় রীতিমত চকারিকে ঘৃণা করতে শুরু করলাম। কিন্তু বাধ্য হয়ে চকারি করে যেতে লাগলাম। কিছু করার ছিল না, কারন একটা বড় পরিবারের দেখাশোনা আমাকে করতে হয়।সিদ্ধান্তহীনতায় এভাবেই প্রায় দুই বছর চলে গেল। আসলে বুঝতে

পারছিলাম না কি করব।হাতে কোন সঞ্চয় নেই, কোন বড় ঝুকি নেয়ার প্রশ্নই আসে না।

 

জীবনের মোড় গেল ঘুরে

হথাৎ একটা ঘটনায় জীবনের মোড় ঘুরে গেল। অফিসের কিছু কলিগের পলিটিক্স এর স্বীকার হয়ে,আমাকে সেই সুদুর বান্দরবনে তাদের একটা বড় প্রজেক্টে পোস্টিং দেয়া হল, পানিশমেন্ট হিসেবে। এবার কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেললাম যে, সিরিয়াসলি কোন কিছু ভাল করে শিখে ফ্রিলান্সিং শুরু করব। বুঝলাম চাকরি করে সেটা কোন মতেই সম্ভব না। কাজেই চাকরি ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। সেটা ২০১২ সালের কথা। তখন দেশে ওয়েব ডিজাইন শেখার একটা হিড়িক পরে গিয়েছিল। আমার আসলে এই ব্যাপারে তেমন কোন ধারণাই ছিল না। যার কাছে যাই তারাই এটা শিখতে বলল, এটাতে নাকি অনেক টাকা। আমিও মনে করলাম, যেহেতু এটাতে অনেক টাকা তাই এটাই শিখব। অনেক খুজে শহরের একটা নামকরা ট্রেনিং সেন্টারে গেলাম, তাদের ১ বছর মেয়াদী ওয়েব ডিজাইন এন্ড প্রগ্রামিং এর কোর্স এর ব্যাপারে জানার জন্য। তাদের চটকদার বিজ্ঞাপন আর মিষ্টি মিষ্টি কথায় প্রভাবিত হয়ে গেলাম। ঠিক করলাম এখানেই ভর্তি হব। ভর্তি ফী আকাশচুম্বি, প্রায় লাখ টাকার কাছাকাছি। এত টাকা জোগাড় করার প্রশ্নই আসে না।কিছু দিন পরে,তাদের বছর শেষের একটা ডিস্কাউন্ট চলছিল। ৭৫% ডিস্কাউন্টে তাদের ভর্তি ফী ২৫ হাজার টাকা। আমার হাত তখন পুরা খালি, সংসার চালাতেই হিমশিম খাই,এত টাকা এক সাথে দেয়ার প্রশ্নই আসে না। তাই কিস্তিতে কোর্স ফী দিতে চাইলাম। তারা রাজি হল, তবে শর্ত হচ্ছে আগে টাকা পুরটা পরিশোধ করতে হবে। এর পরে ক্লাশ শুরু করতে পারব।কথাবার্তা চুড়ান্ত হল।

কিন্তু কথা হচ্ছে সংসার চলবে কি করে, কারন আর চাকরি করব না ঠিক করেছি। আর কোর্সের এত টাকাই বা কিভাবে ম্যানেজ করব। হিসাব করে দেখলাম যে, চার মাস বেতনের টাকা পুরাপুরি জমালে, কোর্সের ফী হয়ে যাবে, আর সংসার কোন মতে মাস দুই চলবে। ঠিক করলাম,বাড়িতে এসে ছোটখাট বিজনেস শুরু করব টিকে থাকার জন্য। বাসার সবাইকে আমার সিদ্ধান্ত জানালাম। কেউ রাজি না হলেও, তাদের আসলে কিছু করার ছিল না, কারন আমার উপর খবরদারি করার কেউ নেই, একজন ছিলেন তিনি মারা গেছেন অনেক আগেই, আমার বাবার কথা বলছি। মাকে বললাম আগামী চার পাঁচ মাস, আমি সংসার চালাতে পারব না। তুমি তোমার পেনশনের টাকা দিয়ে যেভাবে হোক সংসার চালাও। প্রেগনান্ট স্ত্রী আর আমার ছোট ছেলেকে, শ্বশুর বাড়ি রেখে বান্দরবন রওয়ানা দিলাম।

 

নতুন আমি

সেখানে আমি প্রায় চার মাস ছিলাম। মানে যতদিন কোর্সের টাকা না জমানো হয় তত দিন চাকরি করলাম। সেখানে কাজের প্রয়জনে, প্রতিদিন পাহাড়ে অসংখ্যবার উঠতে হত। সাথে বিভিন্ন ধরনের শারীরিক পরিশ্রমের কাজ করতে হত।এমন কোন শারীরিক পরিশ্রমের কাজ নেই যে আমি করিনি।মজার ব্যাপার হল, যা ছিল আমার জন্য ছিল শাস্তি, সেটা আমার জন্য আশীর্বাদ হয়ে এল। পরিশ্রমের ফলে ওজন কমে, শরীর আস্তে আস্তে ফিট হতে লাগল। আমার ফিট হবার গল্প এখান থেকে পড়তে পারেন। পাহাড়ি শান্ত মুক্ত পরিবেশ থাকতে গিয়ে, ধীরে ধীরে আত্মবিশ্বাস ফিরে পেতে লাগলাম। নিজেকে নিয়ে ভাবার একটা সুযোগ পেলাম। ফ্রেশ খাবার, আর তরতাজা বাতাসে একসময় আমার এজমার সমস্যাটাও চলে গেলে। তারা জ্বলা রাতে, পাহাড়ে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকতাম, নিজেকে নিয়ে, পরিবারকে নিয়ে ভাবতাম। বুঝতে পারলাম একমাত্র ফ্রিলান্সিংই পারে আমার স্বাধীন হবার স্বাদ পুরন করতে। কারন আর কোন পথ খোলা নেই। শপথ নিলাম আর কোন দিন চাকরি করব না, বরং চেষ্টা করব অন্যদের চাকরি দেয়ার।আমার কোর্সের টাকা আর দুইমাস চলার মত টাকা জমা হয়ে গেল। আমি চাকরিতে রিজাইন দিয়ে চার মাস পর বাসায় ফেরত এলাম। চার মাস আগের আমি, আর পরের আমিতে আকাশ পাতাল পার্থক্য। শরীর পুরাপুরি ফিট, এজমার কোন সমস্যা নেই, আত্মবিশ্বাসে টইটুম্বুর আমি।

 

 নতুন সংগ্রামের শুরু

বাড়িতে আসার ১ মাস পর আমার কোর্স শুরু হল। কিন্তু জমানো টাকা দুই মাসেই শেষ হয়ে গেল। এখন সংসার চলবে কি করে? আগে থেকেই একটা প্লান ছিল, ছেলের নামে করা DPS ভাঙ্গিয়ে প্রায় ৫০ হাজার টাকা পেলাম। সেটা দিয়ে মাশরুমের চাষ শুরু করলাম। উল্লেখ্য যে আমার আগে থেকেই মাশরুম চাষের প্রশিক্ষণ নেয়া ছিল। আত্মবিশ্বাস এতটাই প্রবল ছিল যে, আমার কাছে কোন বাধাই বাঁধা না। প্রায় মাস খানেক সময় দিয়ে নিজ হাতে মাশরুমের ঘর তৈরি করে ফেললাম। মাশরুম উৎপাদন শুরু হল আরও মাস দেড়েক পর। প্রতিদিন সকালে মাশরুম তুলে প্যকেট করে মটরসাইকেল চালিয়ে ২০ কিঃমিঃ দূরে শহরে আসি। দুপুর পর্যন্ত বিভিন্ন অফিসে ঘুরে ঘুরে মাশরুম বিক্রি করি,অনেকটা ফেরিওয়ালাদের মত ফেরি করে বিক্রি করার মত। দুপুরে কোন সস্তা হোটেলে দুপুরের খাবার খেয়ে বিকালে ক্লাশ করি। সন্ধায় বাসায় এসে আবার মাশরুমের সেডে কাজ করি। রাতে ক্লাশ প্র্যাকটিস করি। এভাবেই চলছিল,

 

ছুটি বলে কোন কিছুই ছিল না। শুক্রবার বাসার সবাই মিলে মাশরুমের স্পন বানাতাম।সে এক অমানুষিক পরিশ্রমের কাজ, সারাদিন কষ্ট করতে হত।গরুর খড় ছোট ছোট করে কাটতে হত। এর পরে ড্রামে সিদ্ধ করতে হত।এর পরে তা ঝুলিয়ে রেখে পানি ঝরাতে হত। এর পরে প্লাস্টিকের মধ্যে ভরে, মাশরুমের বিজ দিয়ে বিশেষ ভাবে স্পন তৈরি করতে হত। এর পরে সেগুলোকে অন্ধকারে রেখে দিতে হত ২১ দিনের জন্য। এর পরে সেগুলো রেডি হত মাশরুম উৎপাদনের জন্য। এভাবে মাসের পর মাস যেতে লাগল। মনে একটা আশা, ভাল করে শিখে একদিন ফ্রিলান্সিং করব। আবার সংসারে সচ্ছলতা আসবে। মাশরুম বিক্রি করে খুব একটা আয় হয় না। সারা দিনে চার পাঁচশো টাকা বিক্রি হয় কিনা সন্দেহ। কোন কোন দিন বিক্রিই করতে পারি না।বেশির ভাগ মানুষ একে ব্যাঙের ছাতা মনে করে। এমনকি শিক্ষিত মানুষও নাক সিটকায়। বাসা থেকে বাজারের যে লিস্ট দেয়া হয়,তার অর্ধেকও কিনতে পারি না। ভাল মন্দ কোন কিছু কেনার প্রশ্নই আসে না। উল্লেখ থাকে যে, তখনো আমার গ্রামের বাসায় কোন নেট কানেকশন নেই বললেই চলে। মডেম দিয়ে কোন মতে ২জি নেট পাওয়া যেত, তাও বাসার সামনে রাস্তার ধারে। একটা পেজ ওপেন হতেই প্রায় ৩/৪ মিনিট সময় লাগত। রাতে যখন বাসার সামনে ল্যাপটপ নিয়ে বসতাম, তখন গ্রমের লোকজন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখত। অনেকেই বলাবলি করত, আমার মাথায় মনে হয় সমস্যা আছে। এটা মনে করার আরও একটা কারন ছিল, কারন সবাই জানত আমি ভাল একটা চাকরি ছেড়ে বাসায় চলে এসেছি। একমাত্র পাগলের পক্ষেই এটা করা সম্ভব। মা খুব নিষেধ করত, বাহিরে বসে এসব না করতে সবাই বদনাম করে। বাধ্য হয়ে বাসার সামনে বসা বাদ দিলাম, আন্দাজে ঘরে বসেই প্রাকটিস করতাম।বাহিরের জগতের সাথে কোন যোগাযোগ নেই বললেই চলে।

 

ভয়ংকর সেই দিনগুলো

এভাবে ১ বছর পার হয়ে গেল। আমার মা কোন মতেই বিশ্বাস করতে চাইত না যে, এভাবে ঘরে বসে টাকা ইনাকাম করা সম্ভব। শুধু বলত আবার একটা চাকরি কর। একমাত্র আমার স্ত্রী আমাকে উৎসাহ দিয়ে যেতে লাগল। শহরের এমন কোন ব্যাংক বা অফিস বাদ নেই যে, যেখানে আমি মাশরুম নিয়ে যাইনি। এদেশের মানুষ ভাল কিছু বেশিদিন খায় না। ভাল কাজে উৎসাহ দেয় না। মাশরুমের বিক্রি দিন দিন কমতে লাগল। সংসারে অভাব অনটন দিন দিন বাড়তে লাগল।এর মধ্যে আমার প্রথম মেয়ের জন্ম হল। তার যে আকিকা দেব, সেই সামর্থ্যও নেই। খুব খারাপ সময়ের মধ্য দিয়ে যেতে লাগলাম। এই মাশরুম বিক্রি করতে যেয়ে যে, কত অভিজ্ঞতা হয়েছে সেটা বলে শেষ করা যাবে না। অনেকেই উৎসাহ দিত, আবার অনেক খারাপ অভিজ্ঞতাও হয়েছে। এমনও হয়েছে যে, অপমান করে আমাকে অফিস থেকে বের করে দিয়েছে, শুধু ঘার ধাক্কাটা দেয়নি। আমি কোন কিছু মনে করিনি। মনে আছে একবার এক অফিসে মাশরুম বিক্রি করতে গিয়েছি, একজন মুরুব্বি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন পোড়াশনা কতদুর? বললাম আমি মাস্টার্স পাশ। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল তাহলে চাকরি না করে মাশরুম বিক্রি করি কেন। বললাম এটা আমার ভাল লাগে, স্বাধীন পেশা এই জন্য। সে বলল এটা এক হিসেবে ঠিক আছে। এটা না করলে হয়ত তুমি চুরি ছিনতাই করে সংসার চালাতে। বুঝেন আমাদের মনমানসিকতা।

 

দিন দিন হতাশ হয়ে যেতে লাগলাম। পরিবারে অশান্তি বাড়তে লাগল। ১ বছর হয়ে গেলেও কোর্সের ৬০% ও শেষ হয়নি। কি শিখছি তার মাথামুন্ডু বুঝি না,বুঝব কি করে, ইন্টারনেটের সাথে যে কোন যোগাযোগই নেই। অনেকটা কুয়ার ব্যাঙয়ের মত অবস্থা। একটা জিনিসই বুঝি আমাকে ফ্রিলান্সিং করতে হবে। বিভিন্ন ফ্রিল্যন্সারদের কাছে যাই। প্রায় কেউই হেল্প করে না, সবাই নিরুতসাহিত করে। এতে আরও হতাশ হই। অনেকেই ঠাট্টা করে। একবার একজন ফ্রিলান্সারের কাছে গেলাম হেল্প পাবার জন্য। সে আমাকে বলল কাঁথা বালিশ নিয়ে আসেন, রাত্রে থাকতে হব। না হলে পরামর্শ দেয়া যাবে না। আমি বিবাহিত এবং রাতে বাহিরে থাকা সমস্যা বলাতে বলল, ফ্রিলান্সিং আপনার জন্য না। একবার এক ফ্রিলান্সারকে ফোন দিলাম ভিডিও টিউটোরিয়ালের জন্য। সে আমাকে ফজরের সময় আসতে বলল। আমি ঠিকই ফজরের সময় এসে উপস্থিত। অথচ সে মোবাইল অফ করে দিয়ে ঘুমাচ্ছে। দেশের আনাচে কানাচে গিয়েছি ভিডিও টিউটোরিয়াল কালেক্ট করার জন্য। আরও অনেক বাজে ঘটনা আছে। তখনই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, জীবনে যদি নিজেকে কখনো ফ্রিলান্সার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পারি, তবে অবশ্যই চেষ্টা করব মানুষকে সঠিক গাইডলাইন দেয়ার।

স্রষ্টার একটু করুণা বর্ষণ

মাশরুম দিয়ে আর চলে না। কি করব বুঝতে পারছি না। দিন দিন হতাশ হয়ে যেতে লাগলাম। খোদা আমার উপর একটু করুনা বর্ষণ করলেন। একদিন সকালে আমার এক বন্ধুর ফোন এল। সে আমাকে একটা প্রস্তাব দিল। সে একটা কোম্পানিতে হেড অফ মারেকেটিং হিসেবে জয়েন করেছে, তারা বিভিন্ন মেডিকেল ইন্সট্রুমেন্ট বিক্রি করে। তাদের গ্লুকমিটারের  ডিলার হব কিনা জিজ্ঞেস করল। যেহেতু মার্কেটিং এ চাকরির অভিজ্ঞতা আছে তাই সাহস পেলাম। বললাম আমার কাছে টাকা নেই। বাকিতে দিলে আমি রাজি আছি। সে তার বসকে রাজি করাল। তবে ৫০% বাকী দেবে বাকী টাকা ম্যানেজ করতে হবে। মায়ের পেনশনের টাকা থেকে ৪০ হাজার টাকা ধার করে ব্যাবসা শুরু করলাম। আমার মাশরুমের বেশিরভাগ কাস্টমার ছিল ডায়াবেটিস এর রোগী। ফলে তাদের কাছেই আবার গ্লুকমিটার নিয়ে গেলাম। যেহেতু মার্কেটিং এর ভাল অভিজ্ঞতা ছিল ফলে মেশিন বিক্রি করতে খুব একটা কষ্ট হত না। দিতে ১/২ টা মেশিন বিক্রি করলেও মোটামুটি চলত। তার পরেও সংসার চালাতে হিমশিম খেতে লাগলাম। বাড়িতে এসেছি প্রায় দেড় বছর হয়ে গেল এখনো ফ্রিলান্সিং এর কোন নাম গন্ধ নেই। সবাই হতাশ।উল্লেখ থাকে যে আমি মাশরুম চাষ বা গ্লুকমিটার বিক্রি, এসব করছি শুধু মাত্র টিকে থাকার জন্য। আমি আমার স্বপ্ন থেকে একটুও বিচ্যুত হইনি। আমার ধ্যান জ্ঞান একটাই। সেটা হচ্ছে আমি ফ্রিল্যান্সার হব একটা স্বাধীন জীবন যাপন করব। এসিকে স্ত্রী আল্টিমেটাম দিল তিন মাসের মধ্যে কিছু না করতে পারলে সে বাপের বাড়ী চলে যাবে।

 

আপনি কিন্তু ভুল ভাবছেন

এই পর্যন্ত পড়ে, আপনারা হয়ত মনে করতে পারেন, আমার মনে হয় যাবার কোন যায়গা ছিল না এজন্য এসব করছি। বিষয়টা আসলে ভুল। চাইলেই আমি আগের মার্কেটিং এর জবে যেতে পারতাম। আমার বন্ধুবান্ধবেরা প্রায় সবাই বিভিন্ন কোম্পানির বড় বড় পদে। তারা প্রায়ই আবার জয়েন করতে বলত, অনেকেই ভাল বেতনে, চাকরীর লোভনীয় অফার দিত।কারন তারা জানত আমি সৎ লক।আমার কাজ আমি ঠিক মত করব। এর মধ্যে আমার চাচা শ্বশুর, তার নতুন ব্যাংকে জয়েন করার জন্য বলল। স্যালারি অনেক মোটা অংকের। আমি কোন কিছুতেই রাজি হয়নি। আমি যে শপথ নিয়েছি চাকরি আর কোন দিন করব না। করলে একমাত্র ফ্রিল্যনাসিংই করব। আর চাকরি করলে ফ্রিলনাসিং এর আশা বাদ দিতে হবে। এতদিন ধরে লেগে আছি তাই এর শেষটাও দেখতে চাচ্ছিলাম।

 

বড় এক ধাক্কা

বহু কষ্টে বাসায় ব্রডব্যান্ড কানেকশন পেলাম। এটা ২০১৪ সালের কথা, তৎকালীন ওডেস্ক বা বর্তমানের আপওয়ারকে প্রোফাইল খুললাম। ঘাটাঘটি শুরু করলাম। এবং যে তিক্ত সত্য আমি জানতে পেলাম, সেটার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। দেখালাম আমি গত দেড় বছর ধরে যা শিখেছি, তার ফুটো পয়সা কোন দাম, মার্কেটপ্লেসে নেই। যা শেখানো হয়েছে তা প্রায় ০৫ বছর আগেই এক্সপায়ার হয়ে গেছে। মনটাই পুরা ভেঙ্গে গেল। এ আমি কি করেছি। কার কাছে এর বিচার দেব। গত দেড় বছরের এত কষ্ট এত পরিশ্রম সব বৃথা হয়ে গেল। এটা যে কত বড় মানসিক আঘাত সেটা কি করে বুঝাই। তার পরেও আশা ছাড়িনি, টানা চার মাস বিড করে গেলাম। একটা মেসেজ পর্যন্ত পাইনি। ধরেই নিলাম ফ্রিলান্সিং এর ইতি এখানেই।

 

তার সাথে দেখা

কি করব বুঝতে পারছি না। কারো সাথে পরামর্শ করব তারও উপায় নেই। পরিবারের চাপে মোটামুটি সিদ্ধান্ত নিলাম যে, আগের সেই মারকেটিং এর চাকরীতে ফেরত যাব। যদিও মন তাতে সায় দিচ্ছিল না।কারন আমার সাথের প্রায় সবাই প্রমোশন পেয়ে অনেক বড় বড় পরে। আমাকে হয়ত তাদের আণ্ডারে কাজ করতে হবে। এযে বড় লজ্জার বিয়য়। কিন্তু সংসারত চালাতেই হবে।একদিন কোন একজন  আমাকে পরামর্শ দিল, একজনের সাথে দেখা করার জন্য। তার নাকি ফ্রিলান্সিং এ অনেক অভিজ্ঞতা!অনেকেই তার হাত ধরে ফ্রিলান্সিংএ সফল। শহরে তার একটা প্রতিষ্ঠান আছে।যদিও আমি ভরসা পাচ্ছিলাম না। কারন অনেক বড় বড় তথাকথিত ফ্রিল্যান্সারদের সাথে দেখা হবার বাজে অভিজ্ঞতা আছে। যা হোক তার নাম্বার জোগাড় করে তাকে কল দিলাম। বললাম তার সাথে একটু কথা বলতে চাই।আল্লাহ মনে হয় সঠিক পথ দেখানোর জন্য তাকে নির্ধারণ করে রেখেছিলেন। তার সাথে দেখা না হলে হয়ত আর ফ্রিলান্সার হওয়া হত না। তাকে আমার সব কথা খুলে বললাম। এত এত ফ্রিলান্সারের সাথে কথা বলেছি। কিন্তু কেউ আমার আসল সমস্যা ধরতে পারেনি। সবাই গতানুগতিক কথা বলেছে,তুচ্ছতাচ্ছিল্য হাসি ঠাট্টা করেছে। এই প্রথম কাউকে পেলাম যে আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনল। আমি তাকে আমার সব কথা খুলে বললাম। তিনি বললেন যে আপনি আসলে ভুল প্রতিষ্ঠানে যেয়ে ভুল ভাবে শিখছেন। আপনার সময় নষ্ট হচ্ছে। আমি বললাম আমার দেয়ালে পিঠ থেকে গেছে। মাসে সংসার খরচ চালাবার জন্য অন্তত ১০ হাজার টাকা দরকার। দিনের বেশিরভাগ সময় নষ্ট হয়ে যায় পেটের ধান্দা করতে করতে। এমন কোন কি উপায় আছে যে আমি ঘরে বসে অনলাইনে এই টাকা উপার্জন করতে পারি, সাথে আমার শেখাটাও চলে? তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আমি ফটোশপ পারি কি না? বললাম সামান্য কিছু পারি। তিনি আমাকে বললেন তাহলে আপনি ছবির ব্যাকগ্রাউন্ড রিভমুভের কাজ শেখেন, এটা দিয়ে আপাতত কাজ শুরু করে দেন। মাসে মোটামুটি একটা ইনাকাম হবে। পাশাপাশি আপনি ওয়েবের কাজ বিশেষ করে ওয়ার্ডপ্রেস ভাল করে শেখেন। আশা করা যায় এক বছরের মধ্যেই ভাল কিছু হবে।

 

যাত্রা হল শুরু

আমি আশার আলো দেখতে পেলাম। Fiverr মার্কেটপ্লেস দেশে তখন নতুন। ওডেক্সে কিছুই করতে পারিনি। তাই সাহস করে Fiverr এ প্রোফাইল খুললাম। একটা গিগ দিলাম ছবির ব্যাকগ্রাউন্ড রিমুভের। প্রায় এক সপ্তাহ চলে গেল, কোন রেসপন্স নেই। একদিন সাহস করে বউকে বললাম ক্যামেরা ধর, একটা ভিডিও করি। নিজের একটা একপ্লেনার ভিডিও বানালাম। এটাই আমার সেই ভিডিও! ভিডিও আপলোড দিলাম। 

রাতে মন খারাপ করে বসে আছি। হঠাৎ দেখি একটা নোটিফিকেশন। ভাল করে চেক করে দেখি, এক USA বায়ার একটা ৫ ডলারের জব দিয়েছে। উত্তেজনায় কাপতে লাগলাম। চিৎকার করে বাসায় সবাইকে জাগিয়ে তুললাম। মা বউ অনেক খুশি হল। উত্তেজনায় কাঁপতে কাঁপতেই কাজটা করে দিলাম। ওমা দেখি বায়ার ৫ স্টার রেটিং দিয়েছে। সেদিনের সেই আনন্দের কথা বুঝিয়ে বলার ভাষা আমার নেই। প্রায় দুই বছর লেগে থাকার পর প্রথম অনলাইন থেকে ইনকাম। উত্তেজনায় সারারাত ঘুমাতে পারিনি। পরের দিন আরও বেশ কয়েকটা অর্ডার এল। এভাবে আসতেই থাকল। আস্তে আস্তে কাজের পরিমান বাড়তে লাগল। শুধু ছবির ব্যাকগ্রাউন্ড রিমুভের কাজ করি। কারন এর বাহিরে আর কিছু জানি না। প্রথম মাসে প্রায় ৮০ ডলারের কাজ করে ফেললাম। পরের মাসে প্রায় একশ ডলার। পায়নিয়ার কার্ড পেতে একটু দেরি হল। সময় আর যেতে চায় না। কার্ড হাতে পেলাম। জীবনের প্রথম ইনকাম এটিএম থেকে উঠালাম। জীবনের অনলাইনের প্রথম ইনকাম মায়ের হাতে দিলাম। এই প্রথম তিনি বিশ্বাস করলেন যে ঘরে বসেও ইনকাম করা যায়। একজন মানুষ যখন পানিতে ভেসে যায় তখন সামান্য খড় কুটোও তার কাছে অনেক কিছু মনে হয়। আমার কাছেও এই সামান্য ইনকাম অনেক বড় কিছু মনে হতে লাগল।

 

ফ্রিল্যান্সারের সুখ কেনা

আস্তে আস্তে বাহিরে যাওয়া বন্ধ করে দিতে লাগলাম। দিন নেই রাত নেই কাজ করে যেতে লাগলাম। কাজ অনেক ছোট হলেও ধীরে ধীরে ইনকাম বাড়তে লাগল। ২০১৪ সালের অক্টোবরে আমার ইনাকাম ছিল প্রায় ৪৫০ ডলার। জীবনে এক মাসে এত টাকা ইনকাম করিনি।মনে আছে একদিন ATM থেকে টাকা তুলেছি। প্রায় ১৫ হাজার টাকার মত। সাইকেল চালিয়ে বাজারে গেলাম। অভাবের কারনে গত দুই বছরে বলা যায় ভাল মন্দ কিছুই কিনিনি। মনে আছে আমার মেজ ভাইয়ের বিয়েতে আমি একটা টাকা দিয়ে হেল্প করতে পারিনি। তার শ্বশুর বাড়ির মেহমানেরা আসলে টাকা ধার করে তাদের আপ্যায়ন করতে হয়েছিল।দেখি বাজারে অনেক বড় বড় মাছ। বাজারের সবাই আমাকে চেনে একজন কঞ্জুস হিসেবে। অনেক দরদাম করি। যদি দুটা টাকা সেভ করা যায়। সেই আমি বাজারের সব থেকে বড় মাছের দাম জিজ্ঞেস করলাম। দোকানি আমারা দিকে একরাশ বিরক্তি নিয়ে তাকালো। মনের করেছে আমি মনে হয় এমনি এমনি দাম জিজ্ঞাস করছি। জিজ্ঞেস করল মাছ কিনব কিনা? আমার আতে ঘা লাগল। বললাম কিনব, আর পকেটও তখন গরম। দরদাম করে ১৫০০ টাকায় মাছটা কিনে নিলাম।বাসায় যখন মাছ নিয়ে এলাম, আমার স্ত্রী আর আমার মা প্রথমে বিশ্বাসই করতে চায় না। বাড়ির উঠানে বসে মহা আনন্দে, বউ শাশুড়ি মিলে মাছ কাটতে বসে গেল। মনে আছে আমার মেয়ের সাইজ আর মাছের সাইজ প্রায় সমান ছিল। মাছকে জড়িয়ে ধরে একটা ছবি এখনো পিসিতে পড়ে আছে।আমি দুচোখ ভরে তাদের সেই আনন্দ দেখতে লাগলাম। লোকে বলে টাকায় সুখ কেনা যায় না। এটা পুরাপুরি ভুল কথা। সেদিন দুপুরে সবাই মজা করে মাছ দিয়ে ভাত খেলাম।সেই আনন্দে আমি এখনো অনুভব করি।

আপনাদের দোয়ায় আমাদের ১২ জনের যৌথ ফ্যামিলি, সবাই মিলে এক সাথে থাকি। আমি ছোট থেকেই বাজার করতে পছন্দ করি। এখন বাজার করতে গেলে অন্তত ৪/৫ টা ব্যাগ লাগে। ৫ হাজারের নিচে আমার বাজার হয় না। সপ্তাহে অন্তত দুই দিন বাজার করি। আল্লাহর রহমতে বাজারের ব্যবসায়ীরা এখন ভাল সম্মান দেয়, আগের মত বাঁকা চোখে তাকায় না। কারন তারা জানে এখন আমি বড় কাস্টমার। আমি বিশেষ কোন কিছু কিনতে চাইলে। ব্যবসায়ীরা নিজ উদ্যোগে শুধু আমার জন্য কিনে আনে। মনে আছে আমার সংগ্রামের সময়ে এমন কোন দিন ছিল না, যে আমার বউ বা মায়ের সাথে কথা কাটাকাটি হয়নি। অথচ আজ অনেক দিন হয়, আপনাদের দোয়ার আমাদের ঘরে কন ঝগড়া হয়নি। আমি বুঝি এটা সম্ভব হয়েছে কারন এখন আমার পরিবারের চাহিদা মেটাবার সামর্থ্য আছে। তাই আল্লহর কাছে সবসময় প্রার্থনা করি, আমাদের জীবনে সেই অভাবের দিন গুলো যেন আর কখনোই না আসে।

 

এবার শুধু এগিয়ে যাওয়া

আমি কিন্তু,আমার শপথের কথা ভুলে যাইনি। ২০১৪ সালের শেষের দিক থেকেই বিভিন্ন ফ্রিলান্সিং বিষয়ক ফেসবুক গ্রুপে, লেখালেখি শুরু করতে লাগলাম। উদ্দেশ্য আর কিছুই না। নতুনদেরকে একটা গাইডলাইন দেয়া, যেন কেউ আমার মত ভুল না করে। সেই লেখালেখি এখন পর্যন্ত চালু আছে। প্রতিদিন প্রচুর মানুষের মেসেজ পাই। চেষ্টা করি সবার মেসেজের উত্তর দেয়ার,যথাসাধ্য হেল্প করার চেষ্টা করি। ২০১৫ সালের প্রথম দিকে, ইনকাম কমে যেতে লাগল। কারন এই ধরনের কাজ আরও অনেকেই করে, ফলে প্রতিযোগিতা বাড়তে লাগল। ততদিনে আমার অনলাইনে মোটামুটি ভাল অভিজ্ঞতা হয়ে গেছে। অনলাইন থেকে শিখে শিখে, নিজেকে আপগ্রেড করতে লাগলাম। গ্রফিক্সের ভিন্ন ধরনের সার্ভিস দিতে শুরু করলাম। ইনকাম আবার বাড়তে লাগল। দিন নেই রাত নেই কাজ করে যেতে লাগলাম। এমনও হয়েছে যে,সপ্তাহের একদিনও আমি বাসা থেকে বের হইনি। ফ্রিলান্সিং এর টাকায় সব ঋণ পরিশোধ করলাম। মেয়ের আকিকা দিলাম। সংসারে আবার স্বচ্ছলতা ফিরে আসলে লাগল। নিজের ভবিষ্যৎ এর লক্ষ্য ঠিক করলাম।

 

মায়ের ইচ্ছা পূরণ

উল্লেখ্য ২০১৫ সালের শুরুতেই মাসিক ইনকাম হাজার ডলার পার হয়ে গেল। দেশের বড় বড় ফ্রিল্যনাসিং গ্রুপে নিয়মিত লিখে যেতে লাগলাম। আমার বড় একটা ফ্যান ফলোয়ার তৈরি হল। ২০১৫ সালের শেষের দিকে অবস্থা এমন দাঁড়ালো যে একা কাজ করে কুলাতে পারি না। তাই ২০১৫ সাল থেকে একটা ভার্চুয়াল টীম নিয়ে কাজ শুরু করলাম। ইনকাম আরও বাড়তে লাগল। মনে আছে এক ২০১৬ সালেই আমি প্রায় ২০০০ হাজারের উপর প্রজেক্ট সম্পন্ন করেছিলাম। টিম না থকলে এটা সম্ভব হত না। আমার মায়ের একটা বড় ইচ্ছা ছিল পবিত্র হজ্জ পালনা করার। বাবা বেঁচে থাকলে হয়ত, পেনশনের টাকায় সেটা পুরন হত। কিন্তু বাবা মারা যাওয়াতে সেটা আর সম্ভব হল না। মাকে প্রায়ই দেখতাম এটা নিয়ে হাঁ হুতাশ করতে। আমি বলতাম যে আল্লাহর কাছে দোয়া কর যেন, আমি তোমাকে নিয়ে হজ্জে যেতে পারি। মা বলতেন তোর যে অবস্থা, তাতে কোন দিন হজ্জ করতে পারবি বলে,ভরসা পাই না।আমি বললাম তুমি দোয়া কর, কবুলের মালিক আল্লাহ। আল্লাহ মায়ের দোয় কবুল করলেন। মাকে নিয়ে ২০১৭ সাল হজ্জ করে এলাম। পুরটাই ফ্রিলান্সিং এর টাকায়। আসলে ফ্রিলান্সিং থেকে আমার পাওয়া সাফল্য বলে শেষ করা যাবে না।

 

জীবনের সব থেকে বড় উপহার

২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে আল্লাহ আমাকে দুইটি জমজ কন্যা সন্তান দান করেন। বলা যায় স্রষ্টার পক্ষ থেকে এ যাবৎকালের সব থেকে শ্রেষ্ঠ উপহার ছিল এটা। আমি বাচ্চা খুব পছন্দ করি। তাই আল্লাহ আমার ঘর আলকিত করেছে। এটা যেহেতু তৃতীয়বার সিজার ছিল এবং জমজ বাচ্ছা ছিল, তাই মা এবং বাচ্চাদের অবস্থা খুবই ঝুকিপূর্ণ ছিল। ডাক্তার পর্যন্ত ঘাবড়ে গিয়েছিল। আমি আমার সর্বচ্চটাই করেছি। শহরের সব থেকে ভাল ডাক্তার এবং সব থেকে ভাল হাঁসপাতালের ব্যাবস্থা করেছি। এইজন্য আমি মহান রাব্বুল আলামিনের কাছে কৃতজ্ঞ। ফ্রিল্যান্সিং থেকে ভাল টাকা ইনকাম করতে পেরেছি বলেই, এটা সম্ভব হয়েছে। চাকরি করলে এই বিপুল ব্যয় ভার বহন করা কোন মতেই সম্ভব ছিল না। মনে আছে আমার বড় ছেলে হবার সময়, আমি বাসা ছেড়ে দিয়ে, মেসে উঠেছিলাম খরচ বাঁচানোর জন্য। কারন বাচ্চা হবার সময় যে খরচ হবে, সেটা বহন করার মত সামর্থ্য ছিল না। টাকা জমানোর জন্য এটা করতে হয়েছিল। অথচ আমি তখন তথাকথিত অনেক বড় একটা চাকরি করি।

 

মনে কষ্ট পাওয়ার গল্প

আমার এই জমজ বাচ্চা হবার সময়, একটা কষ্টের কথা শেয়ার না করে পারছি না। সেটা হচ্ছে, নেগেটিভ জিনিস দ্রুত ছড়ায়, অথচ ভাল জিনিস সেভাবে ছড়ায় না। আমি দুই বছর ধরে প্রচন্ড অভাব অনটনের মধ্যে দিয়ে গিয়েছি, সেটা সবাই বিশেষ করে, আমার শ্বশুর বাড়ির সবাই জানে। অথচ ফ্রিল্যান্সিং করে এখন এত সফল হয়েছি সেটা বেশির ভাগই জানে না। বা বিশ্বাস করতে চায় না।তার মনে আমার অবস্থা মনে হয় আগের মতই আছে। আসলে অন্যের দুঃখে দুঃখী হওয়া খুব সহজ, কিন্তু অন্যের সুখে সুখী হওয়া খুবই কঠিন। আমার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। যমজ সন্তান হবার পরে আমার শ্বশুর বাড়ির, দুই আত্মীয় তাদেরকে দত্তক নেয়ার জন্য প্রস্তাব দিয়েছিল। তার হয়ত মনে করেছে যেহেতু আগে আরও দুইটা বাচ্চা আছে, এখন অভাব অনটনে এই নতুন দুই বাচ্চাকে হয়ত লালন পালন করতে পারব না। তারা হয়ত জানে না, আল্লাহ আমকে শুধু চারটা নয় এক ডজন বাচ্চা লালন পালনের তৌফিক দিয়েছেন। যা হোক এই জন্য আমি ফ্রিল্যান্সিং এর প্রতি কৃতজ্ঞ। অবশ্য তাদেরকে আমি ক্ষমা করে দিয়েছি। কারন তারা আসলে আমার ভালই চেয়েছিলেন।

নিজের আত্মপরিচয় তৈরি

আমরা যারা প্রফেশনাল ফ্রিল্যনাসিং করি, তাদের একটা বড় সমস্যা হচ্ছে আমরা আত্মপরিচয় সমস্যায় ভুগি। এক ধরনের হীনমন্যতায় ভুগি। কারন আমাদের সমাজ এখনো এমাদের ব্যাপারে ভাল মত অবগত না। ফলে যেটা হয় প্রায় সময় আমাদের ব্যাপারে সবাই ভুল বোঝে। মনে আছে আমার ছেলে যখন প্রথমে স্কুলে ভর্তি হল তখন তাকে একজন জিজ্ঞেস করল তোমার বাবা কি করে। সে বলল আব্বু কম্পিউটারে বসে বিদেশে কাজ করে। তখন বলল তোমার বাবার ফটোকপির দোকান কোথায়? মানে তারা মনে করেছে আমি মনে হয় ফ্লেক্সিলোড বা ফটোকপি কম্পোজের কাজ করি। এমন হয়েছে নিজের ভাতিজার বিয়ের কথাবার্তা সময় উপস্থিত হয়েছি, কেউ আমাকে পাত্তাই দিচ্ছে না। অথচ নাম সর্বস্ব, কোন দিন বেতন না পাওয়া, বেসরকারি কলেজের টিচারের কি সম্মান। সবাই সমীহ করে কথা বলছে। ফেসবুকে কোন ফ্রিল্যান্সারের প্রোফাইল দেখতে দেখবেন প্রায়ই ইনকামের স্ক্রিনশট, নিজের কাজের যায়গার ছবি, গণ্যমান্য ব্যাক্তিদের সাথে তোলা ছবি ইত্যাদি ইত্যাদি। আসলে সে এক ধরনের হীনমন্যতায় ভুগছে। চাইছে মানুষ যেন বোঝে সে কি কাজ করে।

 

আমার এই ধরনের সমস্যা কোন দিন ছিল না। বছরের পর বছর ঘরে বসে কাজ করেছি। কিন্তু এক সময় বুঝলাম, আমার নিজের আত্মপরিচয় তৈরি করতে হবে।এই সমাজে কেউ জায়গা দেয় না। যায়গা করে নিতে হয়। তাই ২০১৮ সালে নিজের এলাকায় একটা বড় অফিস দিলাম। উদ্দেশ্য উদ্দেশ্য নিজের আত্মপরিচয় তৈরি করা এবং এলাকার বেকার যুবক যুবতীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে কর্মসংস্থানের ব্যাবস্থা করা। এখন গ্রমের সবাই আমাকে চেনে, সম্মান করে, আমি আমার আত্মপরিচয় সৃষ্টি করতে পেরেছি।

ছোট একটু ছন্দপতন

সব কিছুই ভালই চলছিল। কিন্তু ২০১৮ সালের জুলাই মাসে প্রায় ৪৫০০ রিভিউ সহ আমার ফাইবার একাউণ্ট সামান্য কারনে ব্যান হয়ে গেল। অনেক কষ্ট পেলেও ভেঙ্গে পড়িনি। আগেই বলেছি একজন ফ্রিলান্সার হচ্ছে যোদ্ধা। আমি এত যুদ্ধ করে এতদুর এসেছি যে, এতে আমি মোটেও ভয় পাইনি। নতুন উদ্যমে শুরু করলাম। আপওয়ার্কে কাজ শুরু করলাম। পাশাপাশি আবার Fiverএ কাজ শুরু করলাম। আস্তে আস্তে আমার আগের জায়গা অনেকটাই উদ্ধার করলাম। বর্তমানে আপওয়ার্কে টপ রেটেড এবং ফাইবারে লেভেল-২ হিসেবে আছি। ২০১৮ তে আমার নিজের সার্ভিস সাইট চালু করি। উদ্দেশ্য সরাসরি বায়ারের সাথে কাজ করা।এই লেখা লেখার সময়, আমার অফিসে এখন মোট এমপ্লয়ি ০৬ জন। ইচ্ছা আছে সামনে আরও বাড়ানোর।

আমি এখন স্বাধীন

আমি বিশ্বাস করি একজন মানুষ বড় হতে পারে, তার স্বপনের সমান। আমি স্বপ্ন দেখি আরও বড় কিছু করার। যে চাকরীর শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে দাসত্বের জীবন বেছে নিয়েছিলাম ফ্রিলান্সিং আমাকে তা থেকে মুক্তি দিয়েছে। যে স্বাধীনতার স্বাদ আমি পেয়েছি, সেটা এই ফ্রিলান্সিং এই সম্ভব। নিজের মেধার সর্বোত্তম ব্যাবহার করতে পারছি, যেটা আমি চাকরীতে করতে পারতাম না। আমি সেই ২০০৪ সাল থেকেই কম্পিউটার ব্যাবহার করে কাজ করতাম। অথচ অফিসে সবাই হাতে কাজ করত। আমার কম্পিউটারের কাজ নিয়ে সবাই হাসি ঠাট্টা করত। আমার নাম দিয়েছিল “ফরম্যাট ম্যান”। কখনোই কম্পিউটারের দিয়ে কাজ করতে উৎসাহ পাইনি। অথচ এখন এটাই আমার জিবিকার মাধ্যম।

গ্রামের উন্নয়নে ভুমিকা রাখা

যেহেতু গ্রামেই থাকি তাই আমার ইচ্ছা, আমার নিজের গ্রামের যুব সমাজকে নিয়ে কাজ করার। আমাদের সব কিছুই এখন শহর কেন্দ্রিক হয়ে যাচ্ছে। গ্রামের দিকেও আমাদের নজর দেয়া উচিৎ। ২০১৮ সালে ১২ জন বেকার যুবক যুবতীকে আমার প্রতিষ্ঠান থেকে সম্পূর্ণ বিনামুল্যে চার মাস মেয়াদী প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। প্রশিক্ষণের বিষয় ছিল গ্রাফিক্স ডিজাইনিং এবং ফটো ইডিটীং। শুধু তাই নয় এর মধ্য থেকে ০৬ জনের কর্মসংস্থান করি! ২০১৯ সালে নতুন ০৮ জনকে প্রশিক্ষণ দেই। ইচ্ছা আছে সবার কর্মসংস্থান করা। আমাদের গ্রামে ২০১৮ সালের ১৬ ই ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে আয়োজিত প্রোগ্রাম আমরা স্পন্সর করি। এছাড়া আরও সমাজসেবা মূলক কাজ করছি।সেগুলো বলে নিজেকে জাহির করতে চাই না।  

নিজের আরেকটি বড় পরিচয়

আরও কিছু না লিখলে এই লেখা অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে। সেটা হচ্ছে একজন ফ্রিল্যন্সার হবার পাশাপাশি আমি একজন লেখক। ছোট বেলা থেকে আমার প্রচুর পড়ার অভ্যাস। সাথে লেখালেখি। সেই ছোট বেলা থেকেই আমি ডায়েরী লিখি। এর বাহিরে অনেক গল্প কবিতা লিখেচি। কিন্তু কোন দিন কারো সামনে বলার সুযোগ হয়নি। কোথায় ছাপাও হয়নি। কিন্তু বর্তমানের এই অনলাইন জামানায়, লেখালেখি করা এবং প্রকাশ করা এবং হাজারো মানুষের কাছে পৌঁছানো অনেকটাই সহজ। তাই সময় পেলেই আমি লেখালখি করি।

আমার এই লেখালেখি একাকীত্ব কাটানরও মাধ্যম। আমি গ্রামে থাকি। এখানে আমার মত মনমানসিকতার মানুষ কম। ফলে অনেকের মাঝে থেকেও আমি একা। তাই সময় পেলেই লিখি। অনেকের কাছেই সেটা পৌঁছে যায়। তাদের কমেন্ট পরি। তাদের সাথে এক ধরনের হৃদ্যতা অনুভব করি। কোন কারনে মন খারাপ হলেই, লেখালেখি শুরু করে দেই। এছাড়া একটা দায়বদ্ধতাও আছে, যেটা আগেই বলেছি। মুলত ইনফরমেটিভ, গাইডলাইন এবং মটিভেশনাল লেখা বেশি লিখি। আমার লেখার সব থেকে বড় ভক্ত আমি নিজেই। একটা লেখা ফেসবুকে পোস্ট করার পরে নিজেই যে কতবার পড়ি তার কোন হিসাব নেই। এ এক ধরনের আত্মপ্রেম বলা চলে। এই লেখালেখি থেকে আমার প্রাপ্তিও কম না।এই লেখার সুত্র ধরে অনেকের সাথে আমার বন্ধুত্ব হয়েছে, আবার অনেকের চোখে বিশেষ করে অনেক নতুনদের কাছে আমি সেলিব্রেটি। ফেসবুকে আমার ৫ হাজার ফ্রেন্ডলিস্ট পুরা হয়েছে সেই ২০১৬ সালেই। ফলোয়ারের সংখ্যাও প্রায় এই রকম।অর্থাৎ অন্তুত ১০ হাজার মানুষের কাছে আমি পৌঁছাতে পেরেছি। সত্যি বলতে এই জনপ্রিয়তা আমি উপভোগ করি।

কিছু প্রাপ্তিলাভের গল্প

কয়েকটি ঘটনা শেয়ার করি।২০১৬ সালে সুদুর ইটালি থেকে আমাকে একজন ফোন দিয়ে জানিয়েছিল সে আমার লেখার অনেক ভক্ত। আমার লেখা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে সে ঠিক করেছে সে দেশে চলে আসবে। কারন সেখানে সে অনেক খারাপ পজিশনে আছে। আমি তাকে এটা না করতে অনেক বুঝালাম। প্রায় মাস খানেক পরে আবার কল। এখন সে বাংলাদেশে। আমি পুরাই অবাক। বর্তমানে সে অনেক ভাল পরজিশনে আছে। ২০১৯ সালেই তার ইনকাম প্রায় ৩৫ হাজার ডলার ছিল। আমি এর ক্রেডিট নিচ্ছি না। তবে তার শুরু করার অনুপ্রেরণা ছিলাম আমি।

একজন সফল ফ্রিল্যান্সার এবং যার একটি আইটি ইন্সটিটিউট আছে সে একদিন আমাকে ফোন দিয়ে জানিয়েছিল যে, আমার কোন লেখা পাবলিশ হলে, সেটা ক্লাসের প্রজেক্টরে বড় করে পড়া হয়। সবাই অনেক অনুপ্রেরণা পায়। আরেকজন আমাকে বলছিলম সে আমার সব লেখা প্রিন্ট করে ফাইলে রেখে দেয়। সময় পেলেই পড়ে। এটা থেকে শে অনুপ্রেরণা পায়। আমি ঘরকুনো টাইপের লোক। ঘরে থেকে খুব একটা বের হই না। ঢাকায় একবার এক প্রোগ্রামে গেলাম। আমাকে দেখে, দেখি সবাই সেলফি তুলতে ব্যাস্ত। নিজেকে অনেক সেলিব্রেটি সেলিব্রেটি মনে হচ্ছিল। সেদিনের আমার ফেসবুক ওয়ালে দেখি আমার ছবি আর ছবি। প্রতিদিন অন্তত ১০-১৫ জনের  সাথে কথা বা মেসেজ চালাচালি হয়। চেষ্টা করি আমার ক্ষুদ্র জ্ঞান দিয়ে তাদের হেল্প করার। যখন দেখি তার সমস্যার সমাধান হয়েছে তখন খুবই ভাল লাগে।

আরও  কিছু প্রাপ্তির গল্প

আমার অফিসের কয়েকটি ঘটনা না বললে আমার লেখাটা শেষ হবে না। প্রথমে আসি আমার মেজ ভাইয়ের ব্যাপারে। সে ঢাকায় মোটামুটি বেতনে চাকরি করত। তার ফ্যামিলি আমাদের সাথেই থাকে,আমরা ১২ জনের যৌথ ফ্যামিলি। সে একটু রগচটা টাইপের। ঢাকায় রাজনৈতিক কোন গোলযোগ হলেই বা কোন দুর্ঘটনা হ্লেই আমরা সবাই টেনশনে পড়ে যেতাম। বিশেষ করে আমার মা খুবই টেনশন করতেন। আমার খুবই ইচ্ছা ছিলা আমার ভাই বাড়িতে চলে আসুক।সবাই টেনশন মুক্ত হই। যেহেতু আমার নিজেরই কোন আত্মপরিচয় ছিল না তাই তাকে বাড়িতে নিয়ে আসার সুযোগ ছিল না।২০১৮ সালে তাকে রাজি করিয়ে বাড়িতে নিয়ে আসি। বর্তমানে সে আমাদের কোম্পানির মার্কেটিং এর দায়িত্বে আছে।বাড়ির সবাই টেনশন মুক্ত হয়েছি এটাই বড় প্রাপ্তি। আমার অফিসের তিনজন মেয়ের ভাল জায়গায় বিয়ে হয়েছে।যদিও আমি এর ক্রেডিট নিচ্ছি না।তারা আমার অফিসে ছিল,এই পরিচয় হয়ত তদের কোন হেল্প করেছে। কারন গ্রামে কোন অফিসে চাকরি করাকে অনেক সম্মানের দৃষ্টিতে দেখা হয়। অফিসের এমপ্লয়িদের ভাল বেতন দিতে পারি না। যেহতু এটা গ্রাম, খরচ শহরের তুলনায় কম, তাই এই সামান্য বেতন দিয়েই, অনেকেই অনেক কিছু করে। যেমন আমার এক মহিলা এমপ্লয়ী বেতনের টাকা জমিয়ে, তার বিয়ের কিছু গহনা বানিয়েছে। সামনে তার বিয়ে। যদিও এখন সে আমাদের সাথে নেই। আরেকজন টার্কির খামার দিয়েছিল।আসলে এই ধরনের কথা শুনলে মনটা ভাল হয়ে যায়। মনে হয় কিছুটা হলেও, কারো উপকার করতে পেরেছি।

পরিশিষ্ট

কথায় আছে ৪০শের পরে সবাই জীবনের হিসাব মেলানো শুরু করে। যদিও আমার চল্লিশ হতে আরও কিছু দেরি আছে। তার পরেও আমি জীবনের হিসাব মেলানো শুরু করেছি। পিছনের দিকে যদি ফিরে তাকাই তবে দেখি আমার এই ক্ষুদ্র জীবনে অনেক কিছু হারানোর প্রাপ্তিটাও কম নয়। বরং হারানোর তুলনায় অনেক বেশি। এই জন্য মহান রাব্বুল আলামিনের কাছে লাখো কোটি শুকরিয়া/ আমার ভবিষ্যৎ ইচ্ছা একজন উদ্যোক্তা হিসেবে সমাজের সেবা করা, নিজের পরিবার, সমাজ তথা দেশের উন্নয়নে কাজ করা। লেখালেখির মাধ্যমে ভাল কাজের ব্যাপারে সবাইকে উদ্বুদ্ধ করা। সবাই আমার জন্য দোয়া করবেন।

ধন্যবাদ! 

আমার এই গল্প কিন্তু হার্ডকভারের বইতে প্রকাশিত হয়েছে। আরও ১৫ জন সফল ফ্রিল্যান্সারের গল্প নিয়ে প্রিয় আমিনুর রহমান ভাইয়ের লেখা

“দ্য ফ্রিল্যান্সার :লেগে থাকলে সাফল্য আসবেই ২০২০ সালের বইমেলাতে প্রকাশিত হয়েছে।২৫% ডিস্কাউন্ট দিয়ে দাম মাত্র ১৫০ টাকা!

 

অর্ডার করতে চাইলে ক্লিক করুন।https://www.rokomari.com/book/193986

এছাড়া বই মেলাতে “তাম্রলিপির” প্যাভিলিয়ন-১৭ নং স্টলে বইটি পাওয়া যাচ্ছে।

 

 

আমার পার্সোনাল ব্লগঃhttps://zamantalk.com/
আমার ফেসবুক পেজঃhttps://www.facebook.com/zamantalk/
আমার ফেসবুক প্রফাইলঃhttps://www.facebook.com/gk.zaman.3

Similar Posts