গল্পঃ রাজকুমারী

ক্লিনিকের পরিচালক কাম মালিকের রুমে বসে আছি। পরিচালক প্রায় বছর চল্লিশ বয়সের, নাদুস নুদুস সুশ্রী চেহারার, সৌখীন ব্যাক্তি। দামি মার্জিত পোশাক, হাতে লেটেস্ট মডেলের আইফোন। বোঝাই যায়, হাতে প্রচুর কাঁচা টাকা আসছে। কাঁচা টাকা আসবেই না কেন, মফঃস্বল শহরের ক্লিনিক ব্যাবসা সব সময় রমরমা। একটু ধান্দা করতে পারলে, টাকার অভাব হয় না। জানেন কিনা জানি না, এসব ছোট ছোট ক্লিনিকগুলো টিকে আছে, মুলত নারীর জরায়ুকে কেন্দ্র করে। বিষয়টা খুলে বলি, বিয়ের পর নারী যখন মা হতে যাবে, তখন সিস্টেমে ফেলে, ক্লিনিকে তার সিজার অপারেশন করতে হবে। আর একবার সিজার হলে, ধরেই নেয়ায় যায়, পরের গুলোও সিজারের মাধ্যমেই হবে। এই নারীই যখন মধ্যবয়স পার করবে, তখন তলপেটের কোন সমস্যা নিয়ে গেলে, সিস্টেম করে তার জরায়ুটা ফেলে দিতে হবে। কারন এটার আর কোন প্রয়োজন নেই। সব কিছুই হবে ক্লিনিকে। দালাল, ডাক্তার, ক্লিনিকের মালিক সহ আরও অনেক পক্ষই এর সাথে জড়িত থাকে। তাদের সাবাই কোন না কোন ভাবে উপকার ভোগী। শুধু ভুগতে হয় রোগী আর তার আত্মীয় স্বজনদের। এভাবেই রমরমা ক্লিনিক ব্যাবসা চলছে বছরের পর বছর।
 
বুঝলেন ভাই বড় কষ্টে আছি, প্রতিদিন ১৭৪ টাকার ঔষধ খেতে হয়। মারাত্মক এজমা আর এলারজির সমস্যা। মাঝে মাঝেত ইনজেকশনও নিতে হয়। মালিকের কথায় বাস্তবে ফিরে এলাম। তাকে সাহানুভুতি জানালাম, বললাম, আমারও একই সমস্যা ভাই, আপনার কষ্ট আমি বুঝি। কিন্তু মনে মনে একটু পুলক অনুভব করলাম, ব্যাটা অন্যের রক্তচুষে অনেক টাকা কামাও, আবার একটু খরচ করে দেখাও না বাবা। আসলে অন্যের বিপদ দেখলে উপরে যেমন তেমন, মনে মনে আমরা অনেকেই, এক ধরনের আনন্দ অনুভব করি। আমি নিজে একবার বিপদে পরে, কষ্টের কথা কাছের কয়েকজনকে বলেছিলাম, তারা অনেক সহানুভুতি জানালেও, পরে শুনেছিলাম, পিছনে অনেকেই বলেছিল, অনেক বাড় বেড়েছিলে, এবার উচিৎ শিক্ষা হয়েছে। এটাই মনে হয় প্রাকৃতিক নিয়ম।
 
আচ্ছা ভাই গত মাসে, আপনার ক্লিনিকে কতগুলো সিজার অপারেশন হয়েছিল? ৯৭ টা ভাই। আমি আকাশ থেকে পড়লাম, এত অপারেশন? মালিক বলল, এটাত অনেক কম ভাই, বড় বড় ক্লিনিক হসপিটাল আরও অনেক বেশি করে। মনে মনে হিসাব কষা শুরু করলাম, সব খরচ বাদ দিয়ে, সিজার প্রতি গড়ে তিন হাজার করে থাকলেও, মাসে প্রায় তিন লাখ টাকা। এছাড়া জরায়ু, এপেন্ডিস সহ আরও অনেক অপারেশনত আছেই। এই ছোট ক্লিনিকের মাসের ইনকাম হিসাব করতে যেয়ে, মাথা ঘুরে যাবার দশা হল। ভাই আপনি না গত বছর ক্লিনিকে এসেছিলেন? মালিক প্রশ্ন করলেন। জি ভাই, এইত ১৪ মাসে আগে আপনার ক্লিনিকে এসেছিলাম, আমার ভাইয়ের ওয়াইফের সিজার করাতে, আজকে আবার তার ওয়াইফের সিজার হবে। দুপুর দুইটায় টাইম দিয়েছে। মালিককে প্রশ্ন করি, আচ্ছা ভাই এত অল্প সময়ের গ্যাপে আবার সিজার হচ্ছে তাও আবার তৃতীয়বার, কোন সমস্যা হবে নাতো? মালিক হেসে বলল, চিন্তার কোন কারন নেই, এখানে সবাই এক্সপার্ট, এমন ধরনের সিজার প্রায়ই করা হয়। তা ভাই তারা এত তাড়াতাড়ি বাচ্চা কেন নিতে গেল? ক্লিনিক মালিকের প্রশ্ন, আমি আর কি উত্তর দেব। চুপ করে থাকলাম। বলতে ইচ্ছা হচ্ছিল, করোনার কারনে মানুষের কাম কাজ তেমন নেই। হাতে আফুরন্ত অবসর সময়। আর বেশি অবসর থাকলে যা হয়।
 
যা হোক, কথা ঘুরানোর জন্য, বললাম, দেখেন ভাই, সন্তান আল্লাহর দেয়া উপহার। কত জন আছে, হাজারো চেয়ে পায় না। আবার অনেকেই আছে পেয়েও চায় না। মালিক বলল, আপনি ঠিক বলেছেন ভাই, আমার একটাই মাত্র ছেলে। এবার ক্লাশ এইটে উঠল। ছেলেটা হবার পরে, আমার স্ত্রী খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। জরুরী ভাবে জরায়ুতে অপারেশন করতে হয়। এর পরে আর কোন বাচ্চা হয়নি। ডাক্তার বলে দিয়েছে, আর কোন দিন বাচ্চা হবে না। আমরা হাজার চাইলেও আর বাচ্চা হবে না। আহারে, শুনে খুব খারাপ লাগল ভাই। মালিক বলল, খারাপ লাগার কিছু নেই, কপালে যা আছে সেটাত হবেই। আপনি বলছিলেন না যে, অনেকেই আছে বাচ্চা পেয়েও চায় না। আপনাকে একটা মজার গল্প বলি, হাতে সময় আছেত? ঘড়ি দেখলাম দুইটা বাজতে আরও ২০ মিনিট বাকী আছে। আমি সায় দিতেই, তিনি গল্প বলা শুরু করলেন।
 
৫ বছর আগের কথা। শহরের নামকরা এক স্কুলের শিক্ষিকা, আল্ট্রাসনোগ্রাফি করাতে তার ক্লিনিকে এসেছিল। ভার্সিটি পড়ুয়া উচ্চশিক্ষিত, মধ্যবয়সী সন্তান সম্ভবা, সেই মহিলা, সম্ভ্রান্ত ফ্যামিলির। তার হাজবেন্ড পানি উন্নয়ন বোর্ডে চাকরি করে, প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা। তার স্বামী তখন ইংল্যান্ডে প্রশিক্ষণে ছিল, প্রশিক্ষণ শেষে দেশে আসতে আরও ৬ মাস লাগবে। এই দম্পতির আরও তিনটা মেয়ে আছে। সবাই বড় হয়ে গেছে। একটা ছেলের আশায়, পর পর তিনটা মেয়ে হল, তার পরেও তারা আশা ছাড়েনি। তাই এই মধ্য বয়সেও, তারা আবার ট্রাই করেছে। যদি খোদা মুখ তুলে তাকায়, একটা ছেলে যদি দান করে। আল্ট্রাসনোগ্রাফি করার পরে, তার আবারো মেয়ে হচ্ছে, এটা জানানোর সাথে সাথেই, মহিলার মুখ একেবারে কালো হয়ে গেল। সে উন্মাদের মত আচরণ শুরু করল। রুমের ভিতরেই চিৎকার করা শুরু করে দিল, আমি এই বাচ্চা চাই না, এখনই এই বাচ্চা নস্ট করেন। এ আমার সংসার নষ্ট করতে এসেছে। একে কোন মতেই দুনিয়াতে আনা যাবে না। এটা একটা ডাইনি। যত টাকা লাগে আমি দেব। একে দ্রুত নষ্ট করেন, কেউ যেন জানতে না পারে। ক্লিনিকের মালিক বুঝাতে লাগল, ম্যাডাম বাচ্চা মেচিউর হয়ে গেছে, এই অবস্থায় বাচ্চা নষ্ট করতে গেলে, আপনার জীবন ঝুকিতে পড়ে যাবে। অনেক বড় ক্ষতি হতে পারে। কিন্তু মহিলা নাছোড় বান্দা, তার একটাই কথা এই বাচ্চা তার চাই না,বাচ্চা সে কোন মতেই গর্ভে রাখবে না। সে মরে গেলেও, তাকে দুনিয়াতে আসতে দেয়া যাবে না।
 
মালিকের প্রশ্ন, ম্যাডাম আপনাদের সমস্যাটা কি? অনেকেরত ৪/৫ টা মেয়ে থাকে, তাদেরত কোন সমস্যা হয় না। উত্তরে মহিলা বলল, আপনি জানেন না ভাই, আমার স্বামী বিদেশে ট্রেনিঙে যাবার আগে, আমাকে বলে গেছে, এবারো যদি মেয়ে হয়, তবে আমার সাথে, সে আর সংসার করবে না। আপনি জানেন না ভাই, আবারো মেয়ে হবে শুনলে সে, ইংল্যান্ড থেকেই আমাকে তালাক দেবে, সে খুব ঘাড় ত্যাড়া লোক, আমার সংসার আর করা হবে না ভাই। আপনার পায়ে পড়ি, আমার সংসার রক্ষা করেন। আমি এই বাচ্চা চাই না। এটা দুনিয়াতে আসলে, আমার সংসার থাকবে না।
 
ভাবি বিষয়টা একটু বঝার চেস্টা করেন, এই অবস্থায় কোন ডাক্তার এবারশন করতে রাজি হবে না। আর জোর করে করাতে গেলে, আপনার বাচ্চারা মা হারা এতিম হয়ে যেতে পারে। আপনি যদি রাজি হন, তবে আমার একটা প্রস্তাব আছে, সেটা হচ্ছে, আমার স্ত্রী আর কোনদিন মা হতে পারবে না। আমার একটাই ছেলে, একটা মেয়ের আমার অনেক দিনের স্বপ্ন ছিল। কিন্তু সেটা আর সম্ভব না। যদি কিছু মনে না করেন, তবে এই বাচ্চাটা আমি নিতে রাজি আছি। কেউ কিছু জানবে না। মহিলা রাজি হল, তবে শর্ত হচ্ছে, এই মেয়ের চেহারা সে দেখবে না। তার স্বামী এবং পরিবারকে জানাতে হবে, একটা মরা ছেলে বাচ্চা হয়েছে। মালিক আশ্বস্ত করল, আপনি চিন্তা করবেন না ম্যাডাম, আমরা ক্লিনিক ব্যাবসা করি, কিভাবে কি ম্যানেজ করতে হয় সব জানা আছে।
পরের ঘটনা সংক্ষিপ্ত, যথা সময়ে সেই মহিলার সিজার হল। চালাকি করে সিজারটা করা হল, তার পরিচিত অন্য একটা ক্লিনিকে, মালিক আগে থেকেই সব ম্যানেজ করে রেখেছিল। বাচ্চা হবার সাথে সাথেই, তাকে সরিয়ে ফেল হল। একটা মরা ছেলে বাচ্চা আগে থেকেই রেডি ছিল। মহিলার পরিবারের সবাইকে জানানো হল যে, একটা মরা ছেলে বাচ্চা হয়েছে। কেউ ঘুণাক্ষরেও কিছু টের পেল না। আমি হা করে মালিকের গল্প শুনছিলাম, মনে হচ্ছিল আমি মনে হয় অন্য কোন জগতে আছি। এ আমি কি গল্প শুনছি। আমার অবাক হওয়া দেখে, মালিক বলল, আমার মেয়ের ছবি দেখবেন ভাই? কিছু দিন আগে ৫ বছর হয়েছে, অনেক বড় করে জন্মদিনের পার্টি করেছি, সবাই অনেক মজা করেছে। মোবাইল খুলে, সে তার মেয়ের ছবি দেখাল, আমি দেখলাম ফুটফুটে চেহারার এক ছোট্ট রাজকুমারী, রাজকীয় ভঙ্গিতে, তার বাবার কোলে বসে আছে, আর দেখতেও অনেকটা ক্লিনিক মালিকের মত হয়েছে। জানেন ভাই, কেউ এই কথা জানে না, মনটা ভাল ছিল, তাই আপনাকের বললাম, সবাই জানে এটা আমার মেয়ে। আসলে সে আমারই মেয়ে, শুধু জন্মটা হয়েছে অন্যের ঘরে। মেয়েটা আমাকে ছাড়া কিচ্ছু বোঝে না। এই ছোট বয়সেই, সে আমাকে শাসন করে, আমার মাথায় তেল দিয়ে দেয়, চুল আচড়ে দেয়, আমার খোঁজ খবর নেয়, এই কিছুক্ষণ আগেও আমাকে ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করল, দুপুরের খাবার খেয়েছি কিনা। আমার আর কিছু চাই না ভাই। আমার মেয়ের জন্য দোয়া করবেন।
 
একটা ঘোরের মধ্য থেকে, আমি বাস্তবে ফিরে এলাম। আচ্ছা ভাই, সেই মহিলার কি খরব? উত্তরে মালিক বলল, তার সাথে আমার কোন যোগাযোগ নেই । ইচ্ছে করেই করিনি, তবে শুনেছি সে সুখেই সংসার করছে, কিছু দিন আগে ধুমধাম করে, তার বড় মেয়ের বিয়ে দিয়েছে শুনলাম। কথার মাঝেই, মোবাইল ফোন বেজে উঠল, আমার ভাই কল দিয়েছে, ডাক্তার নাকি চলে এসেছে, তার ওয়াইফের সিজার শুরু হয়েছে। মালিককে সালাম দিয়ে, আমি তাড়াহুড়ো করে উঠে পড়লাম। কিছুক্ষণ আগে যাকে রক্তচোষা ক্লিনিক ব্যাবসায়ী মনে হয়েছিল, যার বিপদে মনে মনে খুশি হচ্ছিলাম। এখন এই গল্প শোনার পরে, তার প্রতি ভক্তিতে মাথা নুয়ে এল। কোরানে আল্লাহ বলেন যে, কোন ব্যাক্তি একটা মানুষের জীবন বাঁচালো, সে যেন, দুনিয়ার সমস্ত মানুষের জীবন বাঁচালো। ক্লিনিকের মালিক একটা জীবনকে, নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়েছে। মনের গভীর থেকে তার জন্য দোয়া চলে আসল।
 
দোতালায় ওটি রুমের দিকে যেতে যেতে, মনে মনে ধিক্কার দিলে লাগলাম, ওইসব তথাকথিত উচ্চ শিক্ষিত মানুষরূপি অমানুষদের, যারা সমাজে সবার সামনে ভাল মানুষের মুখোশ পড়ে আছে। তাদের কাছে একটা জীবনের কোন মূল্য নেই, সংসার সমাজ আর সামাজিক স্ট্যাটাসটাই তাদের কাছে বড়। ওটি রুমের কাছে আসতেই বাচ্চার কান্নার আওয়াজ পেলাম। এরা আসলেই এক্সপার্ট, কত দ্রুত সব কিছু করে ফেলে। বেশ কিছুক্ষণ পর, ডাক্তারের অনুমতি নিয়ে, বাচ্চার কাছে গেলাম, অবাক হয়ে দেখলাম, এ দেখি সেই বাচ্চার মত, আমার আরেক রাজকুমারী, কেমন মায়া ভরা দৃষ্টিতে মিট মিট করে আমাকে দেখছে।
 
তোমার আগমনে আমরা সবাই খুশি। আমাদের পরিবারে এমন আরও তিনটা রাজকুমারী আছে, তুমি হলে চতুর্থ। আমাদের পরিবারে এর পরেও যদি আরও অনেক রজকুমারি আসে, তাতে সবাই আরও বেশি খুশি হবে। তোমাতেই যে জান্নাত। দোয়া করি খোদা যেন তোমাকে অনেক বড় করে। ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করলাম, বাচ্চার কোন সমস্যা আছে কিনা। উত্তরে বলল, আল্লাহর রহমতে কোন সমস্যা নেই, সব ঠিক আছে। আমি আলহামদুলিল্লাহ বলে বের হয়ে এলাম। গলাটা শুকিয়ে আসছে, একটা চা খেতে হবে। চায়ের দোকানের উদ্দেশে পা বাড়ালাম।

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *