আমার হিরোইনচী বায়ার

আমার হিরোইনচী বায়ার
জীবনে সঠিক ক্যারিয়ার খুজে পাওয়া সব থেকে চ্যালেঞ্জিং। এবং আমাদের অধিকাংশই জীবনে সঠিক ক্যারিয়ার খুঁজে পাই না। আর সঠিক পেশা খুঁজে পেতে, অনেক সময় কয়েকটি পেশা বদলাতে হয়। এটা নিয়ে একটা গল্প মনে পড়ে গেল। আচ্ছা তার আগে দেখি বলতে পারেন কি না, বিশ্বে একমাত্র বিশেষ প্রজাতির ডাক্তার আছে, যারা তাঁদের পেশেন্টদেরকে খেতে পারে। বলতে পারবেন কি? উত্তর একটু পরেই দিচ্ছি। একবার এক ছোট ভাই আফসোস করে বলছিল, ছোট থেকেই তার স্বপ্ন ছিল ডাক্তার হবার। সেভাবেই এগচ্ছিল। পড়াশোনায় খুব ভাল রেজাল্ট ছিল। প্রথমবার মেডিকেলে এডমিশন টেস্ট দিয়ে কোথাও টিকল না। দ্বিতীয়বারেও তাই, আর্থিক অবস্থা এত ভাল না যে, বেসরকারি মেডিকেলে পড়বে। ভাগ্য ভাল ভেটেরিনারিতে চান্স হয়েছিল। ফলে মানুষের ডাক্তার হবার বদলে সে হয়ে গেল গরুর ডাক্তার। বিসিএস ক্যাডারে চাকরি হবার পরেও, এটা নিয়ে তার কত আফসোস। গরুর কালো ভুনা, খাসির মাংসের রেজালা, দেশি মুরগির মাংস দিয়ে ভুরিভোজ করতে করতে, সে তার এই দুঃখের কথা বলছিল। আশা করি এতক্ষণে বুঝে গেছেন, কোন প্রজাতির ডাক্তারদের কথা বলছিলাম !
চকারি সুত্রে আমার দেড় বছর একটা মাদক নিরাময় কেন্দ্রের দায়িত্বে থাকার সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য হয়েছিল। যদিও আমি মাদকত দূরে থাক, জীবনে একটা সিগারেটে পর্যন্ত টান দেইনি। অনেকটা আবেগের বশে এবং মানব সেবার জন্য এই দায়িত্ব নিয়েছিলাম। কিন্তু এটা ছিল আমার জীবনের এযাবৎ কালের সর্বশ্রেষ্ঠ ভুল। যে ভয়ংকর অভিজ্ঞতা হয়েছিল, তা হয়ত সারা জীবন তাড়িয়ে বেড়াবে। যে পরিমাণ গল্প জমা হয়েছে, আমি যদি লেখক হতাম তবে হয়ত জনপ্রিয় একজন লেখক হয়ে যেতাম।
ওই চাকরিতে বোনাস হিসাবে যেটা পেয়েছি, সেটা হচ্ছে সন্দেহ রোগ। মানে কেউ একটু উল্টাপালটা কিছু করলেই, মনে হয় সে নেশা করে।সবাইকে সন্দেহ করি। এমনকি আমার খুব কাছের একজনকে অনেক ধরে সন্দেহ করেছিলাম যে সে নেশা করে। কিন্তু পরে দেখি মাঝে মধ্যে পান খাওয়া ছাড়া তার তেমন কোন বাজে নেশা নেই। তবে যখন চাকরি করতাম তখন মোটামুটি কারো সাথে কথা বলে, বা দেখেই বলে দিতে পারতাম সে নেশা করে কিনা। যা হোক ফ্রিল্যান্সিং এর কাছে কৃতজ্ঞ যে, এটা পেশার কারনে এক ধরনের বিচ্ছিন্ন জীবন যাপন করছি। ফলে বাহিরের সমাজের খারাপ মানুষদের সাথে আর মেলামেশার সুযোগ হয় না। ফলে কে নেশা করল আর কে করলা না, সেটা নিয়ে আর মাথা ঘামাই না।
বলছিলাম আমার হিরোইনচী বায়ারকে নিয়ে, তখন ফ্রিল্যান্সিং শুরু করেছি। ৫/১০ ডলারের ছোট ছোট কাজ বেশি করি। একদিন বিশাল এক মেসেজ সহ মাত্র ৫ ডলারের একটা কাজ পেলাম। ভাবলাম মনে হয়, অনেক জটিল কোন কাজ। না হলে বায়ার কেন এত বড় মেসেজ দেবে। কম বাজেট কিন্তু বড় বড় মেসেজ দেয়া বায়ারেরা সাধারণত খারাপ হয়। আমিও ধরেই নিলাম সে একজন খারাপ বায়ার। ওমা কাজ করতে যেয়ে দেখি, এটা আসলে মাত্র দুই মিনিটের কাজ। বেশ অবাক হয়ে গেলাম, বায়ার খুশি হয়ে গরুর রচনা লেখার মত, বিশাল একটা রিভিউ দিল। মাত্র ৫ ডলারের কাজে ২৫ ডলার টিপসও দিল। তখনই সন্দেহ হতে লাগল, ডাল মে কুছ কালা হ্যায়। এর পরে শুরু হল বিশাল বিশাল মেসেজ দেয়া।
 
তার কথাগুলো যেন কীরকম, অনেকটা তাড় ছেড়া, মানে অগোছালো। আর তখনই বুঝ্লাম বায়ার আমার হয়ত নেশা করে বা এক সময় নেশা করত। পরের কয়েকদিন, সে আমাকে বিশাল বিশাল কিছু মেসেজ দিতে লাগল। তার কষ্টের কথা বলতে লাগল। আমিও সহানুভূতি জানালাম। এই ধরণের লোকজন একটু সহানুভূতি পেলেই গলে যায়। বড়লোক বাপের নষ্ট হয়ে যাওয়া এক হিরোইনচী পেশেন্ট একবার তার একটা গল্প বলছিল। সেটা হচ্ছে, ঈদের নামাজ শেষ কর্‌ বাসায় আসার পথে এক ভিক্ষুক তার পাঞ্জাবির প্রশংসা করেছিল, এতে সে এতটাই খুশি হয় যে, সে তার বাবার দেয়া, সেই পাঞ্জাবি খুলে ভিক্ষুককে উপহার হিসেবে দিয়ে আসে, সাথে গেঞ্জিটা বোনাস। পাঞ্জাবির দাম ছিল ৫ হাজার টাকা। তাকে খালি গায়ে বাসায় আসতে দেখেত সবাইত অবাক।
যা হোক আমার বায়াকে কৌশলে জিজ্ঞেস করলাম, সে এখন কি নেয় বা নিত। সে জানাল, সে সেই টিনেজ বয়স থেকেই হেরোইনের নিত। সংক্ষেপে তাঁর ইতিহাস যদি বলি, সেটা হচ্ছে, সে তাঁর বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। বাপের বেশ কয়েক মিলিয়ন ডলারের সম্পত্তি আছে। তাঁর বাকী জীবন কিছু না করলেও চলবে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, সে তাঁর বাবাকে সব থেকে বেশি ঘৃণা করে। সে বিবাহিত এবং তিন সন্তানের বাবা। সন্তানদের দিকে চেয়ে সে ভাল হতে চায়, একটা রিহ্যাব সেন্টারে (মাদকাশক্ত পুনর্বাসন কেন্দ্র) সে প্রায় মাস চারেক ছিল। এখন সে সুস্থ এবং আর নেশা করছে না। তাঁর বাবা তাকে কয়েক লাখ ডলার দিয়েছে, বাবস্যা করার জন্য। কিন্তু সে এটা টাকা দিয়ে কি করবে কিছু বুঝে উঠতে পারছে না। বর্তমানে সে এমাজনে কিছু প্রোডাক্ট বিক্রি করতে চাচ্ছে। এই জন্য আমার সার্ভিস তার দরকার হয়েছিল। আরও জানাল, আমাকে তাঁর খুব মনে ধরেছে। সে আমাকে বাবস্যায়িক পার্টনার হিসেবে চায়। আমার কিছু করা লাগবে না। শুধু বুদ্ধি দিলেই চলবে। প্রস্তাব দিল, আমি চাইলে বেশ কিছু ডলার আমার একাউন্টে রাখতে পারে, আমার বিশ্বাস অর্জনের জন্য। এমাউন্টটা বললাম না। কারন আপনারা বিশ্বাস করবেন না।
একটা কৌতুক মনে পড়ে গেল সাংবাদিকেরা গিয়ছে শহরের সব থেকে বড়লোক ব্যাবসায়ির সাক্ষাৎকার নিতে, সাংবাদিকঃ আচ্ছা স্যার আপনি কিভাবে এত টাকার মালিক হলেন? ব্যাবসায়িঃ ১০ বছর আগে পার্টনারশিপে বাবস্যা শুরু করি বন্ধুর সাথে। তাঁর ছিল টাকা আর আমার ছিল অভিজ্ঞতা। সাংবাদিকঃ এর পর?
ব্যাবসায়িঃ আজ দশ বছর পর আমার হয়েছে টাকা, আর তাঁর হয়েছে অভিজ্ঞতা!
আমার খুব ইচ্ছা হচ্ছিল এই কৌতুকটা ফলো করার। কারণ বাঙালি বলে কথা, কিন্তু তাঁর পরও নিজেকে সংযত করলাম। নিজেকে বুঝালাম এটা ঠিক হচ্ছে না। তাই তাকে এড়িয়ে যাওয়া শুরু করলাম। শুধু থ্যাংকস বলে তাঁর মেসেজের জবাব দেয়া শুরু করলাম। সেও ব্যাপারটা বুঝতে পারল, মনে হয়। আসলে নেশাখোরেরা সব সময় চায়, কেউ তার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনুক। তাকে গুরুত্ব দিক। যেটা আমরা করি না। ফলে তারা অনেক সময় ভায়লেন্ট হয়ে পড়ে। তবে তার জন্য অনেক খারাপ লাগছিল। হয়ত তার এই দুর্বলতার সুযোগ কেউ নেবে। হয়ত সে তাঁর ব্যবসায়িক পার্টনার খুজে পেয়েছে। আর প্রায় পাঁচ বছর হয়ে গেছে। তার কথা এখনো মনে আছে, তাঁর জন্য আসলে মায়া হয়। দোয়া করি যেখানেই থাকুক সে যেন ভাল থাকে। নেশা করলেও তাঁর মনটা খুবই ভাল ছিল। এত ভাল মনের মানুষ হলে, নিজেকে ধন্য মনে করতাম।
ধৈর্য ধরে পড়ার জন্য, ধন্যবাদ!

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *