বায়িং সিগন্যালঃ সুযোগ যখন দরজায়, আলতো করে টোকা দেয়

 আমার পূর্বের মার্কেটিং এর, কাজের অভিজ্ঞতার আলোকে লেখা “ফ্রিল্যান্সিং স্ট্রাটেজিঃ: ব্লু ওশান Vs রেড ওশান” এ আপনাদের ব্যাপক সাড়া লক্ষ্য করে, দ্বিতীয় কিস্তি লেখা শুরু করলাম। আজকের বিষয় বায়িং সিগন্যাল! বায়িং সিগন্যাল কি? মার্কেটিং এর ভাষায় আপনার বায়ার যদি, আপনার প্রতি নুন্যতম আগ্রহ দেখায়, তবে সেটাই বায়িং সিগন্যাল! এমনকি বায়ার যদি শুধু আপনাকে “হাই” বলে, তবে সেটাও একটা বায়িং সিংন্যাল! একটা বায়িং সিগন্যাল মানে একটা বড় সুযোগ, একটা বড় সম্ভবনা। ব্যাবসায় সাফল্যের মূলসুত্র এই বায়িং সিংন্যালে লুকিয়ে আছে।
 
মার্কেটিং এর ভাষায় বলা হয়ে থাকে, বায়ারের কাছ থেকে বায়িং সিগন্যাল পেলে, আপনার প্রোডাক্ট ৫০% বিক্রি হয়ে গেছে। বাকি ৫০% নির্ভর করে সেলারের উপর। এই বায়িং সিগন্যাল অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এটাকে সুবর্ণ সুযোগ বলা যায়। আমরা যদি আমদের জীবনের দিকে তাকাই, তবে দেখব আমরা কিন্তু টাকা পয়সা হারাবার জন্য যতটা আফসোস করি, তার থেকে অনেক বেশি আফসোস করি, সুযোগ হারানোর জন্য। কারন সুবর্ণ সুযোগ জীবনে বার বার আসে না। অনেক সময় সুযোগ দরজায় আলতো করে টোকা দেয়। বোকারা বুঝতে পারে না। কিন্তু অভিজ্ঞরা দরজায় ঠিকই কান পেতে থাকে। সুযোগ দরজায় টোকা দেয়া মাত্রই সেটা লুফে নেয়। একজন অভিজ্ঞ সেলার নুনতম সুযোগও হাতছাড়া করে না।
 
মার্কেটিং এ চাকরীতে প্রোমোশনের পর, আমার প্রথম পোস্টিং ছিল রংপুর বিভাগে। সেখানে লোক মুখে একটা গল্প শুনেছিলাম। সত্য মিথ্যা জানি না। এরশাদ সরকারের আমালের কথাা, সেই সময়ের রংপুরের বড় ব্যাবসায়ী দুই ভরসা ভাতৃদয়, করিমউদ্দিন ভরসা এবং রহিমউদ্দিন ভরসা, তাদেরই একজনের গল্প। তাঁদের টাকার কোন অভাব ছিল না। দেশের বিড়ির একচোটিয়া ব্যাবসা তাঁদের দখলে ছিল। দুই জনেই নির্বাচনে দাড়িয়েছেন, দুই ভাই ছিল একে অপরের প্রতিযোগী। একজন দেখলেন, গ্রামগঞ্জের কাঁচা রাস্তায়, নির্বাচনের প্রচারের সুবিধার জন্য, মোটরসাইকেল দরকার। দুই ভাইয়ের একজন, মোটরসাইকেল কেনার উদ্দেশে, খুব সকাল বেলা মোটরসাইকেল শোরুমে গিয়েছেস। লুঙ্গী পাঞ্জাবী পড়া খুবই সাধারণ চেহারার একজন মানুষ। তিনি শোরুমের সেলসম্যানকে সরাসরি জিজ্ঞেস করলেন, ভাই এক ট্রাক মোটরসাইকেলের দাম কত? (তার নেতা কর্মীদের জন্য আসলেই এক ট্রাক মোটরসাইকেল লাগবে)। সেলসম্যান তার এই সাধাসিধা অবস্থা দেখে, মনে করল, সে মনে হয় তার সাথে মস্করা করছে। সেলসম্যান খুব খারাপ ব্যাবহার করে, তাকে দোকান থেকে তাড়িয়ে দিল। পাশের মোটরসাইকেলের শোরুমের অভিজ্ঞ সেলসম্যান, পুরা ঘটনা দেখছিল। সে এই বায়িং সিগন্যাল ঠিকই ধরে ফেলল, বুঝল এই বায়ার, যে সে বায়র না। সে তাকে তার দোকানে সাদরে বসাল। তার কি দরকার জেনে নিল। সেই ভাবে তাকে, তার কোম্পানির বিশেষ মডেলের মোটরসাইকেল সাজেশন করল। সেটার গুণগান তাকে বলল। তিনি খুশি মনে এক ট্রাক মোটরসাইকেলের জন্য অর্ডার করে, চেক লিখে দিয়ে চলে এলেন। আগের শোরুমের সেলসম্যান, এই ঘটনা দেখে, আফসোস করে একেবারে শেষ। এত বড় সুযোগ হারাবার জন্য সে কপাল চাপড়াতে লাগল।
 
আমারা যারা ফ্রিল্যান্সিং করি, আমারাও কিন্তু একজন সেলসম্যান, আমাদের সার্ভিস হচ্ছে আমাদের প্রোডাক্ট। অনভিজ্ঞ নতুনেরা বায়িং সিগন্যাল ধরতে পারে না। অনেক সময় অভিজ্ঞরাও ভাল সুযোগ হাত ছাড়া করে। পরে আফসোস করে। একজন পারফেক্ট সেলসম্যান সামান্যতম সুযোগও হাত ছাড়া করে না। আমার একটা লেখায় আমি আমার একটা অভিজ্ঞতা বলেছিলাম। সেটা আবারো বলছি, একদিন এক বায়ার আমাকে Hi লিখে একটা মেসেজ দিয়েছিল। আমি উত্তরে তাকে জিজ্ঞেস করি, তার জন্য কি করতে পারি? সে আমাকে ৫ ডলারের খুব ছোট একটা কাজ দিয়েছিল। এভাবে বেশ কিছুদিন ধরে, সে একই ধরনের কাজ বার বার দিচ্ছিল। তখন আমি আমার অন্য কাজ নিয়ে, খুবই ব্যাস্ত ছিলাম। কিন্তু আমার মনে হচ্ছিল এই বায়রের কাছে হয়ত বড় কোন কাজ আছে। কারন তার কাজের ধরন সেটাই বলে দিচ্ছিল। আমি তার প্রতি বাড়তি মনযোগ দিতে লাগলাম। ফলাফল হাতে নাতে পেলাম। একদিন সে আমাকে অনেক বড় একটা কাজ অফার করল। আসলে সে এতদিন আমাকে যাচাই করছিল যে, আমি এই বড় কাজ করতে পারব কিনা। সেই সময়ে এত বড় কাজ পাওয়া ছিল, আমার ফ্রিল্যান্সিং ক্যারিয়ারের একটা ট্রানিং পয়েন্ট। এমন ঘটনা আপনাদেরও অনেক আছে সেটা জানি।
 
প্রশ্ন হচ্ছে, বেশি বেশি বায়িং সিংন্যাল পেতে কি করতে হবে? উত্তর হচ্ছে আপনার কানেকশন বাড়াতে হবে। যত বেশি কানেকশন তত বেশি সুযোগ। যেমন, আপনি যদি শুধু Fiverr এ কাজ করেন এবং একটা নিদিষ্ট বিষয় নিয়েই পড়ে থাকেন, তবে দেখা যাবে, খুব বেশি সুযোগ আপনার হাতে আসছে না। এখন যদি আপনি অন্য আরও মার্কেটপ্লেসে সক্রিয় হন। আপনার যদি খুব স্ট্রং অনালাইন পোর্টফলিও থাকে, আপনি যদি সোশ্যাল মিডিয়াতে প্রমোশন করেন, পাশাপাশি ইমেইল মার্কেটিং, শুধু তাই না আপনি যদি লিঙ্কডিনে আপনার বায়ারের সাথে কানেকটেড থাকেন। আপনার বায়ার যদি, আপনাকে তার বন্ধুদের কাছে আপনাকে রেফার করে। ইউটীউব, ফেসবুকে যদি আপনার ভাল ফ্যন ফলোয়ার থাকে, তবে অতি অবশ্যই, আপনি প্রতিনিয়ত অসংখ্য বায়িং সিংন্যাল পাবেন। সেগুলোকে সেলসে রূপান্তর করাই, আপনার মূল কাজ হবে। আসলে কখন কোথা থেকে বায়িং সিগন্যাল আসবে কেউ বলতে পারে না। তাই সম্ভব সব রকম উপায়ে কানেক্টেড থাকবে হবে এবং লেগে থেকে, নিরবে কাজ করে যেতে হবে।
 
অনেক সময় সাদা চোখে বায়িং সিগন্যাল দেখা যায় না। অভিজ্ঞ শকুনের চোখ সেটা খুঁজে বের করে। এখন করোনার মহামারি চলছে। চারিদিকে ব্যাবসা বানিজ্যে ধ্বস নেমেছে। কিন্তু আবার এটাই অনেকের জন্য ব্যাবসা করার সুবর্ণ সুযোগ নিয়ে এসেছে। কি সুযোগ নিয়ে এসেছে সেটা আপনাকেই খুঁজে বের করতে হবে এবং কাজে লাগাতে হবে। করোনা আক্রমনের সাথে সাথেই, অনেক ব্যাবসায়ি মাস্ক স্টক করে ফেলেছিল। অনেকেই রাতারাতি মাস্কের ফ্যাক্টরি দিয়ে দিয়েছে। বড় বড় কোম্পানি সাবান, হ্যান্ড সেনিটাইজার উৎপাদন করে স্টক করে রেখেছে। এভাবে বলে শেষ করা যাবে না।
 
এই প্রসঙ্গে একটা গল্প দিয়ে আমার লেখা শেষ করব। শতবর্ষ আগে ব্রিটেনের এক রাজা, মৃত্যুপথযাত্রী অবস্থায় অনেকদিন ধরেই শয্যাশায়ী ছিল। তখনকার সময়ের এক ঝানু ব্যাবসায়ী, রাজার এই অসুস্থতার মধ্যেই বায়িং সিংন্যাল খুঁজে পেল। সে বাজার থেকে কালো কাপড় কিনে স্টক করতে লাগল। কালো কাপড় এমনিতেই চলে না। ফলে খুব সস্তায়, সে সব কালো কাপড় কিনে গুদাম ভরে ফেলল। এসিকে কিছু দিন পরেই, রাজা মারা গেলেন। নিয়ম অনুযায়ী কয়েক মাস ধরে পুরো ব্রিটেন জুড়ে শোক পালন হবে। শোক পালন করতে গেলে, শোকের প্রতীক কালো কাপড় লাগবে। কিন্তু এদিকে মার্কেটে কালো কোন কাপড় নেই। চারিদিকে হাহাকার পড়ে গেল। এবার এই সুযোগে সেই ব্যাবসায়ী গলাকাটা দামে কালো কাপড় বিক্রি করতে লাগল। বলা হয়ে থাকে এই কালো কাপড় বিক্রি করে সে ইংল্যান্ডের সব থেকে বড় ধনী হয়ে গিয়েছিল।
 
আশা করি এখন থেকে আপনার প্রতিটা বায়িং সিংন্যালের ব্যাপারে আরও বেশি সচেতন হবে। প্রতিটা বায়িং সিংন্যালকে সেলসে রূপান্তর করবেন।
 
ধন্যবাদ!
 

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *