ফ্রিল্যান্সিং স্ট্রাটেজিঃ ব্লু ওশান vs রেড ওশান

blue vs red ocean stratagy
ফ্রিল্যান্সিং স্ট্রাটেজিঃ ব্লু ওশান vs রেড ওশান ওশান মানে সমুদ্র। মার্কেটিং এর ভাষায় ওশান দুই ধরনের, একটা হচ্ছে ব্লু ওশান, আরেকটি হচ্ছে রেড ওশান। এই স্টাটেজি বিশ্বের সব দেশের মার্কেটিং বিষয়ক সাবজেক্টে অবশ্য পাঠ্য। এগুলো আমার বানানো কোন থিওরি না। ব্লূ ওশান হাচ্ছে বিশাল বিস্তৃত সমুদ্র যেখানে মাছ খুব একটা নেই। আর মাছ থাকলেও, হাঙরের মত শিকারি মাছ বা মানুষ এখনো সেটা খুজে পায়নি। ফলে সমুদ্র শান্তই আছে, অর্থাৎ নীল আছে। বিপরীতে রেড ওশান হচ্ছে, সেই খুব ছোট সমুদ্র যেখানে প্রচুর পরিমানে মাছ আছে। ফলে সেখানে হাঙরের মত হিংস্র বড় বাড় শিকারি মাছ প্রচুর, তারা প্রচুর পরিমানে শিকার করছে। এমনকি নিজেদের মধ্যেও মারামারি করছে। ফলে শান্ত নীল সমুদ্র রক্তের লাল রঙে লাল হয়ে গেছে। এটাই হচ্ছে রেড ওশান। এখানে যেমন খাবার অনেক বেশি, তেমনি প্রতিযোগিতাও অনেক বেশি। ফলে একমাত্র শক্তিশালী প্রবল প্রতিপক্ষই এই সমুদ্রে টিকে যাবে। বাকী শিকারিদের হয় চলে যেতে হবে, অথবা মারা যেতে হবে। ব্লু ওশানের তুলনায় রেড ওশান খুবই ক্ষুদ্র।
 
প্রশ্ন করতে পারেন, আমি এসব জানলাম কোথা থেকে? আসলে ফ্রিল্যান্সিংএ আসার আগে, প্রায় ১০ বছর চাকরি করেছি। তার মধ্যে ৭ বছর ছিলাম মার্কেটিংএর চাকরিতে। দেশে এবং বিদেশে বেশ কিছু মার্কেটিং ট্রেনিংএ অংশগ্রহণ করার সুযোগ হয়েছে। অনেক বড় বড় মার্কেটিং ট্রেইনার ছিলেন এসব ট্রেনিংএ। সত্যি বলতে এই ধরনের তত্ব কথা খুব একটা কাজে লাগেনি। কিন্তু যে দিন থেকে ফ্রিল্যান্সিং শুরু করলাম, সেদিন থেকে বুঝতে পারলাম এগুলো আসলেই ঠিক। এমনকি এসবের অনেক কিছু আমি বাস্তবে কাজে লাগিয়েছি। ইচ্ছা আচ্ছে আমার প্র্যাক্টিক্যাল অভিজ্ঞতা থেকে এসব স্ট্রাটেজির উপর কিছু সামনে লেখার।
 
কেউ যদি রেড ওশানে সম্পদ আহরণ করতে যায়, তবে তাকে প্রবল শক্তিশালী হতে হবে। যেন সে তার প্রবল প্রতিপক্ষকে হারিয়ে, যায়গা দখল করতে পারে। এখানে হেরে যাবার সমুহ সম্ভবনা আছে। তবে জিততে পারলে লাভ হবে ষোল আনা। অন্যদিকে ব্লু ওশানে রিস্ক নেই বললেই চলে। কিন্তু এখানে সম্পদের খোঁজ পেতে গেলে অনেক অনুসন্ধান করতে হবে এবং অনেক স্টাডি করতে হবে। এখানেও ফেল করার সম্ভবনা বেশি। হয়ত সময়ের অপচয় হবে। তবে একবার সম্পদের খোঁজ পেয়ে গেলে, আর কিছু লাগে না। বলা যায় ফাঁকা মাঠে গোল দেয়া। তবে কথা হচ্ছে একসময় এই ব্লু ওশান রেড ওশানে রূপান্তর হবে। কারন শিকারিরা আস্তে আস্তে এর কথা জেনে যাবে। তারাও চাইবে শিকারের ভাগ নিতে। ফলে শান্ত সমুদ্র একদিন রক্তের রঙে লাল হবে।
 
এর পারফেক্ট উদাহরণ হতে পারে Fiverr. ২০১০ সালে যখন Fiverr যাত্রা শুরু করে। তখন এটা ছিল ব্লু ওশান। এই দেশে তেমন কেউ এটার কথা জানত না। বাংলাদেশ থেকে অনেকেই তখন কাজ করত। আমি যখন ২০১৪ সালে শুরু করি। তখনো তেমন প্রতিযোগিতা ছিল না। বলা যায় আমরা শুয়ে বসে কাজ করতাম। প্রতিদিন অন্তত ৫ জন বায়ারকে আমার সময় নেই বলে, না করে দিতে হত। অথচ এখন কাজের জন্য সবার কি হাঁ হুতাস। আমি তখনই অনেককে Fiverr এর কথা জিজ্ঞেস করেছি। অনেকেই হেসে উড়িয়ে দিত। বলত ৫ ডলারের মার্কেটপ্লেস। অথচ তারাই এখন, Fiverrএ কিভাবে কাজ পাওয়া যায় তা জানার জন্য, বিভিন্ন গ্রুপে সাহায্য চ্যেয়ে পোষ্ট দেয়।
এখন সেই Fiverr আর নেই। এটা এখন রেড ওশান, প্রচন্ড প্রতিযোগিতা এখানে। হাজার হাজার ট্রেনিং সেন্টার, এমনকি সরকারের বিশেষ ট্রেনিং প্রজেক্ট এই মার্কেটপ্লেসকে টার্গেট করে এগোচ্ছে। ফলে এখন এখানে লক্ষ লক্ষ ফ্রিলান্সার। কাজেই একমাত্র প্রবল যোগ্যতা এবং দক্ষতা সম্পন্ন প্রতিযোগী এখানে টিকে থাকবে। দুর্বলের কোন খাওয়া নেই এখানে। দ্রুত ঝরে পড়ে যেতে হবে। হয়ত ৫/১০ ডলার ইনকাম করে, নিজের নামের আগে ফ্রিল্যান্সার পদবী লাগানো যেতে পারে। তবে দিনের পর দিন একটা নিদিষ্ট এমাউন্ট ইনকাম করে, নিজের অবস্থান পাকা করা আকাশ কুসুম স্বপ্ন হবে। তবে হতাশ হবার কিছু নেই। Fiverr কে যদি আমরা সমুদ্র হিসেবে কল্পনা করি, তবে এখনো এখানে বিশাল ব্লু ওশান পড়ে আছে, আবিষ্কারের অপেক্ষায়। শত শত সাব ক্যাটাগরি আছে যেখানে কম্পিটিশন খুবই কম। সে দিকে নজর দিতে হবে। প্রচুর স্টাডি করতে হবে এবং চোখ কান খোলা রাখতে এবং নিজের ব্রেনকে কাজে লাগাতে হবে।
এটা নিয়ে একটা মজার গল্প মনে পরে গেল। (গল্পটা কিঞ্চিৎ ১৮+ দয়া করে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন)। এক ব্যাবসায়ি ভদ্রলোক কোন এক সেমিনারে এটেন্ড করতে, কোন এক ৫ স্টার হোটেলে গিয়েছে। প্রোগ্রামের মাঝে, তার প্রচন্ড প্রস্রাবের বেগ চেপে বসল। এতটাই তার চাপ ছিল যে, সে হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে, একটা দামি হোটেল সুইটের দরজা খোলা দেখে, সোজা সেখানে ঢুঁকে পড়ল। এর পরে সোজা ওয়াশ রুমে ঢুকে পড়ল। ঢুকেই সে দেখল এক সুন্দরী বাথটাবে গোসল করছে। সেই সুন্দরী তাকে হঠাৎ করে এভাবে দেখে, চিৎকার দিয়ে উঠল।
সুন্দরীর মাথাটা শুধু বাথটাবের বাহিরে বের হয়ে আছে। বাকী দেহ বাথটাবের পানির মধ্যে। এখন যে কোন সময় হোটেলের লোকজন চলে আসবে। ব্যাবসায়ী সেই সুন্দরীর সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে, তার আসল কাজের কথা বামালুম ভুলে গেল। এখন সে সুন্দরীর ব্লু ওশান, যেটা বাথটাবের নিচে আছে, সেটা আবিস্কার করার লোভ সামলাতে পারল না। হাতে সময় খুব কম, হোটেলের কর্মচারীদের ছুটে আসার শব্দ সে পাচ্ছে। মিনিটের চেয়েও অনেক কম সময় হাতে আছে। যা করার এই সময়ের মধ্যেই করতে হবে। আবার এদিকে, নিজেকে কোন বিপদে ফেলা যাবে না। যে যেটা করলা, সেটা হচ্ছে, সে সটান হয়ে দাড়িয়ে উচ্চস্বরে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া শুরু করল। আর জাতীয় সঙ্গীত বাজলে কি করতে হয়, সেটা আপনারা ভাল করেই জানেন। সুন্দরীও দেশের সম্মান রক্ষার্থে সেটা করল। ফলে সে তার উপস্থিত বুদ্ধির জোরে, ব্লু ওশান আবিস্কার করে ফেলল। (এই গল্পটা আমাদের এক ট্রেইনার, চীনের কুনমিংএর কোন এক মার্কেটিং ট্রেনিং সেশনে, বলেছিল)
সেই ব্যাবসায়ির মত, আপনিও আপনার মাথা একটু খাটিয়ে, একটু স্টাডি করে সহজেই ব্লু ওশান আবিস্কার করতে পারেন। আমি অনেককেই দেখেছি এমন এমন কাজ করে ভাল ইনকাম করছে, যেগুলো সম্পর্কে আমাদের কোন আইডিয়াই নেই। এমন অনেক সেক্টরে দেখেছি যেখানে বাংলাদেশেই হাতে গোনা ২/৩ জন কাজ করে। কাজেই বলব, ফ্রিলান্সিংএ আপনার স্টটেজি কেমন হবে, সেটা আপনাকেই ঠিক করতে হবে। আপনি যদি চাহিদা সম্পন্ন কাজে ভাল দক্ষ হন এবং প্রবল প্রতিযোগিতায় জয় লাভ করার সাহস থাকে, তবে রেড অশন স্টাটেজি নিতে পারেন। আর না হলে ব্লু ওশান স্টটেজি। ব্যাক্তিগত ভাবে আমি ব্লু ওশান স্টাটেজি ফলো করি। একটু কষ্ট হলেও, আখেরে এখানেই লাভ বেশি। Fiverr এ ব্লু ওশান আবিস্কার করার কিছু টিপস শেয়ার করছি।
  • ফ্রিল্যান্সিং এর কোন কোন বিষয়ে আপনার ভাল দক্ষতা আছে, সেটা ভাল করে নোট করুন।
  • Fiverr এর ফিল্টারিং সিস্টেম এখন অনেক এডভান্স। ফিল্টারিং করে আপনি খুব কম প্রতিযোগিতার ক্যাটাগরি খুজে বের করুন.
  • বিভিন্ন ধরনের কীওয়ার্ড দিয়ে সার্চ করুন।
  • ভিভিন্ন ক্যাটাগরির সাব ক্যাটাগরিগুলো ভাল করে স্টাডি করুন।
  • ফ্রিলান্সিং রিলেটেড বিভন্ন গ্রুপে বেশি বেশি একটিভ থাকুন।
  • অন্য ফ্রিলান্সারেরা কি করছে বা মার্কেটের ট্রেন্ড কোন দিকে সেগুলো ভাল করে খেয়াল করুন।
  • সব শেষে নিজের মাথটা ভাল করে খাটান।
আশা করা যায় আপনার ব্লু ওশান খুজে পাবেন। এর পরে সেখনে ভাল করে কাজ শুরু করেন। মনে রাখবেন আজকের ব্লূ ওশান একদিন রেড ওশান হতে পারে। অন্যদের শকুনের দৃষ্টি একদিন পড়বেই পড়বে। তাই চেষ্টা করবেন, এখান থেকে সরবচ্চ সবটূকু নেয়ার। আর এটা কারো সাথে শেয়ার করারও দরকার নেই । আমার ফ্রেন্ডলিস্টের অনেক ফ্রিল্যান্সার আছে, তারা কি করে জানি না। অনেকে চেষ্টা করেও অনেকের কাছ থেকে সেটা জানতে পারিনি। আশা করি বিষয়টা বুঝেছেন।
ধন্যবাদ!
(লেখাটি আমার ব্যাক্তিগত ব্লগে পূর্ব প্রকাশিত)
Facebook Comments