আসুন এই ঈদে এই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে, সবাই সচেতন হই, অন্যকেও সচেতন করি
আমার জীবনের অন্যতম দুঃখজনক ঘটনা দিয়ে শুরু করি। সাত বছর আগের কথা। এক অদ্ভুত অফিসে চাকরি করতাম। যেখানে অফিসে কোন নিদিষ্ট টাইম ছিল না। প্রায়ই নাইট শিফটে কাজ করতে হত 🙁 এমনকি ঈদের দিনও অফিস করতে হত। তবে ভাগ্য ভাল সেই বছর রোজার ঈদে শুধু ঈদের দিনটি ছুটি পেয়েছিলাম। কিন্তু শর্ত হচ্ছে,পরের দিন যত সকালে পারা যায় আমাকে অফিসে আসতে হবে।
কি আর করার, ঈদের পরের দিন খুব সকালে বাসা থেকে রওয়ানা হলাম। উল্লেখ্য আমি গ্রামের বাড়ি থেকে অফিস করতাম। শহর থেকে প্রায় ২০ কিঃমিঃ দূরে আমার বাসা। মটরসাইকেল ছিল বলে কোন সমস্যা হত না। সেদিন সকাল থেকেই প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছিল। সেই বৃষ্টির মধ্যেই রওয়ানা দিলাম। বাসা থেকে প্রায় ৬ কিঃমিঃ পার হয়েছি। এমন সময় হঠাৎ দেখি একজন জোয়ান লোক, লুঙ্গি গেঞ্জি পুরা ভিজে আছে, কাঁদা দিয়ে একেবারে মাখামাখি অবস্থা, কাঁধে এক বাচ্চাকে নিয়ে জোরে দৌড়াচ্ছে। পিছনে বেশ কিছু মানুষ। আমি মটরসাইকেল স্লো করে কি ব্যাপার জিজ্ঞাস করলাম। কিন্তু ভদ্রলোক উত্তর দেয়ার অবস্থায় নেই।
আশপাশের সবাই যেটা বলল সেটা হচ্ছে এই বাচ্চা মেয়ে পানিতে পড়ে গিয়েছিল, কখন পড়েছে কেউ জানেনা। মাত্র উদ্ধার করা হয়েছে। এখন ডাক্তারের কাছে নেয়া হচ্ছে। সেখান থেকে প্রায় ৪/৫ কিঃমিঃ সামনে বাজার। সেখানে এক গ্রাম্য ডাক্তারের বাড়ি। কিন্তু এত সকালে কোন ভ্যান বা কোন টেম্পু কিছুই নাই। এর উপর প্রচন্ড বৃষ্টি হচ্ছে। আমি তাকে প্রস্তাব দিলাম, এভাবে দৌড়ে আপনি বেশিদূর যেতে পারবেন না, সময় নষ্ট হবে, আপনি আমার মটরসাইকেলে উঠেন। তিনি রাজি হলেন। বাচ্চাকে নিয়ে আমার বাইকে উঠলেন। বাচ্চাটাকে দেখলাম, মেয়ে বাচ্চা, একেবারে নিষ্পাপ সুন্দর চেহারা, বয়স ৫/৬ বাছর হবে। চোখ দুটো ঈষৎ খোলা, মুখ দিয়ে ফেনা বের হচ্ছে। আমার বুকটা হাহাকার করে উঠল। চেহারা দেখে মনে হল অনেক আগেই মারা গেছে। আমার চোখ দিয়ে পানি বের হল। মনটাকে শক্ত করলাম, কারন আমাকে যে ভাবে হোক ডাক্তারের বাড়ি পৌঁছাতে হবে। মোটরসাইকেল স্টার্ট দিলাম। বাচ্চাটার ঠাণ্ডা পিঠ আমার পিঠে লেগে আছে। সেই ঠাণ্ডা আমি অনুভব করতে পারছি, সেই বাচ্চার শরীরের ঠাণ্ডা আমার শরীরেও ছড়িয়ে পড়ছে। সে এক অপার্থিব অনুভুতি। কারো যেন এমন অভিজ্ঞতা না হয়।
আল্লাহর কাছে দোয়া করতে লাগলাম, তিনি যেন বাচ্চাটাকে মায়ের কোলে ফিরিয়ে দেন। ঝড়ের বেগে বাইক চালিয়ে কয়েক মিনিটেই ডাক্তারের বাড়ি পৌছালাম। ডাক্তার কিছুক্ষণ পরীক্ষা নিরীক্ষা করে জানালেন, বাচ্চাটা অনেক আগেই মারা গেছে। আমার সেই সময়ের অনুভুতি বোঝাতে পারব না। চোখ ঝাপসা হয়ে গেল। অসহায়ের মত দাড়িয়ে কতক্ষণ কাঁদলাম জানি না। পরে যেটা জেনেছিলাম। বাচ্চার বাবা সিলেটে থাকেন। বাবুর্চির কাজ করেন। ঈদে অনেক রান্নার প্রোগ্রাম থাকে, তাই সে ঈদে বাড়ী আসতে পারবে না। যেহেতু ব্যাস্ত, তাই বাচ্চা আর বাচ্চার মাকে গ্রামের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন ঈদ করতে। তিনি পরে আসবেন। কিন্তু এরই মধ্যে এই দুর্ঘটনা।
এক পরিসংখ্যানে দেখা যায় আমাদের দেশে প্রতিবছর প্রায় ১৭ হাজার শিশু কিশোর পানিতে ডুবে মারা যায়। এর বড় একটা অংশ মারা যায় ঈদের সময়। আমি এটা নিয়ে অনেক ভেবেছি। এটার বেশ কিছু কারন আমি খুজে বের করেছি। সেগুলো হচ্ছে,
১. আমাদের দেশে একটা ট্র্যাডিশন দাঁড়িয়েছে ঈদ গ্রামের বাড়িতে করা। বাচ্চারা গ্রামের বাড়িতে যেয়ে, আনন্দে খুব উত্তেজিত থাকে। ফলে পুকুর বা নদীতে গোসল করতে যেয়ে দুর্ঘটনা ঘটে।
২. শহরের বাচ্চারা যেহেতু বদ্ধ পরিবেশে মানুষ হয়, তাই তাদের শরীর একটু ভারী প্রকৃতির। ফলে তারা পানিতে কোন কারনে ডুবে গেলে নিজেদের বাঁচাতে পারে না।
৩. শহরের বাচ্চারা সাঁতার শেখার কোন সুযোগ পায়না। ফলে গোসল করতে যেয়ে তারা বিপদে পড়লে কিছুই করতে পারে না।
আরও একটা বিষয় পেয়েছি যেটা অনেকেই হয়ত দ্বিমত পোষণ করবেন। আমি গ্রামের বদনাম করছি না। আমি নিজেই গ্রামের মানুষ এখন গ্রামেই থাকি। বাস্তবতা হচ্ছে গ্রামের মানুষের মনমানসিকতা শহরের মানুষের থেকে কিছুটা নিচু প্রকৃতির, এটা শিক্ষার অভাবের কারনেও হতে পারে। আমি গত নয় বছর ধরে গ্রামে আছি, আমি এটা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। উদাহরণ দেই, গতকালও আমাদের বাড়ির পাশের এক লোককে হাতে নাতে ধরেছি, আমাদের পুকুর থেকে মাছ চুরি করার সময়। এর আগেও সে চুরি করে ধরা পড়েছে। অথচ তার লম্বা দাড়ি আছে। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে 🙁 আসলে গ্রামে কেউ ভাল পড়াশোনা করলে, বা ভাল চাকরি পেলে আর গ্রামে থাকে না, শহরে চলে যায়। ফলে আমার মতে গ্রামে যারা থাকে বেশিরভাগ অল্প শিক্ষিত এবং বদমাশ প্রকৃতির লোক, আর কিছু আছে আমার মত, যাদের বাধ্য হয়ে গ্রামে থাকতে হয়।
গত ৯ বছরে যে নোংরামি দেখেছি, সেটা লিখতে গেলে মহাভারত হয়ে যাবে। ভিলেজ পলিটিক্সের মত নোংরা জিনিস আর হতে পারে না। লিখতে গেলে অনেক আজে বাজে বিষয় শেয়ার করতে হবে। আমি সেদিকে গেলাম না। অনেকেরই গ্রামের জমিজমা নিয়ে শত্রুতা আছে। এছাড়া ঈর্ষা জনিত ব্যাপার স্যাপার আছে। আর শিশুরা যেহেতু অসহায়, তাই তারা সহজ শিকার। ইদানীং শিশুদের প্রতি সহিংসতা অনেক বেড়ে গিয়েছে। কাজেই কেউ যদি কোন বাচ্চাকে পানিতে ফেলে দেয় তবে কিছু করার নেই। আমার মতে অনেক বাচ্চা এইভাবে আক্রোশের স্বীকার হয়। উল্লেখিত ঘটনার শিশুর বাবার সাথে জমিজমা নিয়ে প্রতিবেশীর ঝামেলা ছিল।
তাই আমার সবার প্রতি অনুরোধ এই ব্যাপারটার ব্যাপারে সবাই সচেতন হবেন এবং অন্যকেও সচেতন করবেন। সবার ঈদ যেন সুন্দর ভবে এবং নিরাপদে কাটে এই কামনা করি। সবাই ভাল থাকবেন। ধন্যবাদ!
চোখে পানি চলে আসল।
কঠিন ব্যাপার রে ভাই, মানুষ আসলে এমন করতে পারে যা কল্পনাকে হার মানায়।