ফরম্যাট

আজকে Nokia 1100 মোবাইলটা সারভিসিং করে নিয়ে আসলাম। শখ করে এই পুরাতন মোবাইলটা ঢাকা থেকে আনিয়েছিলাম। কিন্তু ভাল পড়ে নাই, নষ্ট ফোন ধরিয়ে দিয়েছিল। তাই প্রায় ৩ বছর ড্রয়ারেই পড়ে ছিল। কিছু দিন আগে চোখে পড়াতে ভাবলাম, ট্রাই করে দেখি ঠিক হয় কিনা। শহরে গিয়েছিলাম ঠিক করাতে, কিন্তু কোন মিস্ত্রি ঠিক করতে রাজি হচ্ছিল না। স্মার্ট ফোনের এই যুগে, এই ধরনের মোবাইল নিয়ে গেলে, দোকানদার আপমানিত বোধ করে। মনটাই খারাপ হয়ে গেল। এর পর গেলাম এলাকার মেইন বাজারে। সেখানেও সেম অবস্থা। অবশেষে বহু খুজে একজনকে পেলাম যে. এই ধরনের পুরাতন মোবাইল ফোন ঠিক করে। তার মাধ্যমে মোবাইলটা ঠিক করলাম। ফোনটা হাতে নিতেই অন্য ধরনের ফিলিংস এল, নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত হলাম। আজ থেকে ১৪ বছর আগের অতীতে ফিরে গেলাম। আমার জীবনের প্রথম কেনা মোবাইল ছিল এই Nokia 1100, অনেক সুখের সৃতি আছে একে নিয়ে। এর পরে অনেক মোবাইল ইউজ করলেও এটা মত মজা আর পাইনি।
 
মনে আছে আমাদের বিয়ের তারিখ যখন ঠিক হল, দেখা গেল আরও ২০ দিন আছে বিয়ের। একেকটা দিন যেন মনে হয় একেকটা বছর। সময় যেন কাটতেই চায় না। আমার ফুফু শাশুড়ি এঙ্গেজমেন্টের পরের দিন, আমাকে কল দিয়ে, আমার হবু বউকে ফোনটা ধরিয়ে দিল। সেই হল শুরু। দিন নেই রাত নেই, সুধু মোবাইলে কথা আর কথা। ইচ্ছে ছিল প্রেম করার, কিন্তু আমার জীবনে প্রেম আসেনি। কারন সেই যোগ্যতা আমার ছিল না। এই দেশে এরেঞ্জ ম্যারেজের ব্যাবস্থা না থাকলে, আমার মত হাভাতের কপালে আর বউ জুটত না। তবে এক হিসাবে বলা যায় বিয়ের আগে আমরা প্রেম করেছি। এবং সেটা এখনো চলমান। মনে আছে, রাত ১০ টায় কথা বলা শুরু করেছি, কখন ভোর হয়ে গেছে টের পাইনি। আর দিনের বেলায় যখন খুশি তখন কলত দিতামই। এভাবে দিন কেটে যাচ্ছিল। মোবাইলটা ছিল বলে, এত অত্যাচার ঠিকই সহ্য করে টিকে ছিল। কখন একটা কল আসবে এই অপেক্ষায় বসে থাকতাম। সময় যেন কাটতেই চাইত না। Nokia 1100 মোবাইলটা ছিল আমার সব থেকে কাছের বন্ধু। যাকে এখনো মিস করি।
 
আপনার শুনে হাসবেন যে, আমার এই কাছের বন্ধুকে, আমি হারিয়ে ফেলি, আমার বিয়ের গেটের ঠিক সামনে থেকে। এর থেকে হাস্যকর আর কি হতে পারে। আমাকে যখন বিয়ের গাড়ি থেকে নামানো হচ্ছিল, ঠিক তখনই ফোনটা পাঞ্জাবীর পকেট থেকে, গাড়ির সিটের উপর পড়ে যায়। এর পরে কোন একজন শুভাকাঙ্ক্ষী সেটা তুলে নেয়। বিয়ের ভিডিওতে সব তোলা আছে। কিন্তু চেহারা না দেখা যাওয়াতে, সেই শুভাকাঙ্ক্ষীর সাথে সাক্ষাতের আর সুযোগ হয়নি। আমাকে যখন বিয়ের আসরে বসানো হল, তখনো টের পাইনি যে, আমার সাধের মোবাইল চুরি হয়ে গেছে। আমার কাছের একজন রাগে গজ গজ করতে করতে আমার সামনে এসে কৈফিয়ত চাইল, এত কল দিচ্ছি মোবাইল ধর না কেন? আর ঠিক তখনই বিষয়টা বুঝতে পারলাম। এমন একটা শুভ দিনে মনটা খারাপ হয়ে গেল। এক অজানা আশংকায় মনটা কেমন যেন করে উঠল। এবং হলও তাই, বিয়ে বাড়িতে বিশাল গ্যাঞ্জাম লেগে গেল। সেই কাহিনী না হয় আরেকদিনের জন্য তোলা থাকল।
 
আমার মন খারাপ দেখে, আশপাশের সবাই বলে উঠল চিন্তার কিছু নেই শ্বশুর আব্বা ভাল একটা মোবাইল কিনে দেবে। পাশ দিয়ে যাবার সময়, শ্বশুর আব্বার মুখে মুচকি হাসি দেখে, মনটা আসস্থ হল। যা হোক ভাল কিছু পেতে যাচ্ছি। ওমা বিয়ের ৭ দিন পার হয়ে গেলেও, ওদিক থেকে কোন খবর নেই। বুঝতে পারলাম কপালে মোবাইল নেই। সাহস করে চাইতেও পারি না, পরে যৌতুকের অপবাদ, না আবার কপালে জোটে। এদিকে মোবাইল না থাকাতে, কাজে সমস্যা হচ্ছিল। কাজেই কি আর করা, মোবাইল কিনতেই হবে। তখন চায়না রঙ্গিন বাটন মোবাইল, মাত্র দেশে আসা শুরু করেছে।এটা সেই ২০০৭ সালের কথা। বন্ধুদের নিয়ে, ঢাকার মোতালেব প্লাজায় গেলাম মোবাইল কিনতে। বিয়ের সেলামি বাবদ ৫ হাজার টাকা আর নিজের ৩ হাজার সহ ৮ হাজার টাকা পকেটে ছিল। বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে, পুরো টাকা দিয়ে একটা চাইনিজ ননব্র্যান্ড মোবাইল কিনলাম। রেডিওর মত প্রচন্ড সাউন্ডে গান শোনা যেত, আরও যেত ছবি তোলা। এটা পেয়ে আমি আমার প্রিয় Nokia 1100 হারাবার সৃতি কিছুটা হলেও ভুলতে পারলাম। এই মোবাইলের প্রথম সৎ ব্যাবহার ছিল, পরীক্ষায় নকল করা। তখন মাত্র প্রমোশন পেয়েছি। ২০ দিনের ট্রেনিং চলছে হেড অফিসে। আগের দিনের পড়ার উপর, পরের দিন সকালে পরীক্ষা হত। বলা বাহুল্য নতুন বউয়ের কল্যাণে কোন পড়াশোনা হত না। আমি সব পড়ার ছবি মোবাইলে তুলে নিতাম। পরের দিন কপি করে পরীক্ষা দিতাম। ফলাফল পরীক্ষায় ফাস্ট 😀
 
দেখতে দেখতে ট্রনিং এর ২০দিন শেষ হয়ে গেল। পোস্টিঙের সময় চলে এল, আমার কপাল খারাপ, পোস্টিং অনেক দূরে রংপুরে হল। এটা ছিল আমার চিন্তারও বাহিরে। নতুন বউকে রেখে, ভাঙ্গা মন নিয়ে চলে যেত হল। মাসে মাত্র দুই বার ঢাকায় আসতে পারতাম। এই সুযোগে বউকে ১দিনের জন্য একটু দেখতে যেতাম, বউ ছিল নরসিংদীতে। সেটা ছিল আরেক পরীক্ষা। সেই কস্টের দিনগুলো, প্রকাশ করার মত ভাষা আমার নেই। নিজেদের অনেক ছবি তুলেছিলাম। আমার বিরহের দিনগুলোতে, সেই ছবি দেখে সময় কাটাতাম। কখন যে নিজের আজান্তেই দুচোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ত, টেরই পেতাম না। মোবাইল টিপাটিপি করতে যেয়ে, একদিন আবিষ্কার করলাম, নতুন বউ, আমাকে না জানিয়ে, আমাকে নিয়ে তার অনেক কথা, মোবাইলে রেকর্ড করে রেখেছে। সেগুলো শুনে আরও বেশি ইমোশনাল হয়ে পড়লাম। বউকে যে নিজের কাছে নিয়ে যাব, সেটার উপায় ছিল না। কারন পরিবারের বাঁধা। ফলে এভাবেই আমাদের দিনগুলো কস্টে কেটে যাচ্ছিল।
 
অফিসের সেলসের প্রেশার সব সময় থাকত। আর এদিকে নতুন প্রমোশন পেয়েছি। অনেক কিছুই বুঝি না। ফলে কাজের প্রেশারে, দিনগুলো খুব কষ্টে কেটে যাচ্ছিল। হেল্প করার মত কেউ নেই। মনে আছে, একদিন রাতে, আমার টীমের ছেলের সাথে খুব রেগে কথা বলছি, কারন সেও আমার মত নতুন আর কাজে খুবই অলস। কথা বলছি আর হাতের মোবাইল আন্দাজে টিপাটিপি করছি। হথাৎ দেখি মোবাইল স্ক্রিনে “Format” লেখা ভেসে উঠল। সত্যি বলতে, তখন পর্যন্ত এটার বাংলা অর্থ আমি জনাতাম না। আমি কিছু না বুঝেই OK টিপে দিলাম। আমার মোবাইলের মেমোরি কার্ড, পুরা ফরম্যাট হয়ে গেল। কি থেকে কি হল, বোঝার আগেই, আমি আমার সব কিছু হারিয়ে ফেললাম। যার ছবি দেখে, আর গলার কণ্ঠ শুনে, সময় কাটত, সব এক নিমিষের চলে গেল। এই কথা শুনে আপনাদের হাসি পেতে পারে। তবে ২০০৭ সালে কিভাবে কি করতে হয় এর কিছু জানতাম না। বাসায় এসে অনেকক্ষণ কাঁদলাম। তার সাথে কথা বলার খুব একটা সুযোগ ছিল না। কারন তাকে কোন মোবাইল কিনে দেয়া সম্ভব ছিল না। বাসার মোবাইলে সে সর্বচ্চ ১/২ মিনিট, হয়ত কথা বলতে পারত, ব্যাস এতটুকুই। সেই বিরহের দিনগুলো, আরও কষ্টে কাটতে লাগল। খোদা মনে হয় আমার মনের কষ্ট বুঝেছিলেন। একদিন রাতে, আমার সেই চায়না মোবাইল চুরি হয়ে গেল। আমি একটা কষ্ট থেকে কিছুটা হলেও বাঁচলাম। এই ছিল আমার ফরম্যাটের কাহিনী।
 
আরও একটা ফরম্যাটের কাহিনী দিয়ে, গল্পটা শেষ করব। সেটা সেই ৯০ দশকের শেষ দিকের কথা। দেশে তখন কম্পিউটার শেখার একটা জোয়ার শুরু হয়েছিল। ব্যাঙের ছাতার মত যত্রতত্র ট্রেনিং সেন্টার গড়ে উঠেছিল। MS Work, Excel, MS Excess আর ফক্স প্রো এগুলো শেখানো হত। SSC বা HSC পরীক্ষার পরে কম্পিউটারের ট্রেনিং করা, একটা ট্রেন্ডে পরিণত হয়েছিল। মনে আছে একটা পিসিতে ২/৩ জন করে বসতে হত। ফলে শেখা যে কি হত, তা বলাই বাহুল্য। আর অধিকাংশ ট্রেইনারেরা নিজেরাই ভাল কিছু জানত না। তবে ট্রেনিং সেন্টারের ব্যাবসা ছিল রমরমা। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সেন্টারগুলো, ছাত্রছাত্রী দ্বারা মুখর থাকত। যা হোক এক ট্রেনিং সেন্টারের গল্প। সদ্য এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে এক ছাত্র ভর্তি হয়েছে। ট্রেইনার মাত্র সবাইকে MS Word এর হাতেখড়ি দিয়েছে। সবাই পিসিতে একটা করে ফাইল খুলে, সেখানে টাইপিং প্র্যাকটিস শুরু করেছে। আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি, I love you এই ধরনের বাক্য দিয়ে, ফাইলগুলো ভর্তি থাকত। ছেলেটা নিজের ফাইলের পাশাপাশি, অন্যের ফাইলগুলো, কৌতূহল বসত ঘাঁটাঘাঁটি করত। আর এটা করতে যেয়ে, একটা ফাইল পেল, যেখানে কেউ তার মনের কথাগুলো, সুন্দর করে গুছিয়ে লিখেছে। বোঝা যায়, সে ভাল করে প্র্যাকটিস করছে। আর লেখার ধরন দেখেই বলে দেয়া যায়, সে হচ্ছে মেয়ে।
 
ছেলেটা মজা করে, তার প্রশংসা করে আরো কয়েকলাইন লিখে দিল। সপ্তাহে তিন দিন ক্লাশ হত। পরের ক্লাশে সে এসে, সেই ফাইল চেক করে দেখে যে, মেয়েটি অনুযোগ করে, তাকে নিয়ে কিছু লিখে গিয়েছে। উত্তেজনায় ছেলেটা নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। সেও নিজেকে নিয়ে আরও কয়েক লাইন লিখল। পারের ক্লাসে এসে দেখল মেয়েটাও, তার মনের অনেক কথা লিখে রেখে গিয়েছে। তখন মেসেঞ্জার বলে কিছু ছিল না। সেই MS Word ফাইলটাই ছিল তাদের মেসেঞ্জার। এভাবে বেশ কিছুদিন চলার পরে, সাহস করে ছেলেটা, তার ভাল লাগার কথা মেয়েটাকে জানাল। আসলে ছেলেটা মেয়েটার প্রেমে পড়ে গিয়েছিল। খুব করে চাইছিল মেয়েটার সাথে দেখা করতে। মেয়েটাও তার ভাল লাগার কথা ছেলেটিকে জানাল। একদিন সাহস করে ছেলেটা লিখেই ফেলল যে, সে তার সাথে দেখা করতে চায়। ট্রেনিং সেন্টারে অনেক মেয়ে। কিন্তু সেই মেয়েটা আসলে কে, সেটা বোঝার কোন উপায় ছিল না। মেয়েটি লিখল, নেক্সট ক্লাশে সে তার নাম পরিচয় লিখবে, সেও খুব করে চাচ্ছে তাদের দেখা হোক। উত্তেজনার ছেলেটি দুই রাত ঘুমাতে পারেনি। সকাল সকাল সে ক্লশে চলে এল। নিজেকে সে আর ধরে রাখতে পারছে না। একেই মনে হয় প্রেম বলে। কৈশোরের প্রেমে আবেগ অনেক বেশি থাকে। সে দ্রুত পিসি অন করল। আর অন করার পর, সে যা দেখল, সেটার জন্য সে মোটেই প্রস্তুত ছিল না। সে দেখল, পিসির স্কিন পুরাপুরি ফাঁকা, ডেক্সটপে কোন ফাইলই নেই। সে লাফ দিয়ে উঠে, ট্রেইনারের কছে গেল। জিজ্ঞেস করল, পিসির ডেস্কটপের সব ফাইল কোথায়? উত্তরে ট্রেইনার বলল, পিসি অনেক স্লো হয়ে যাওয়াতে, সে গত রাতে, পিসিতে নতুন করে উইন্ডোজ দিয়েছে, পিসির ডেক্সটপের সব ফাইল ফরম্যাট হয়ে ডিলিট হয়ে গেছে। আর কোন দিন পাওয়া যাবে না।
 
এটা শুনার সাথে সাথেই, ছেলেটি সবার সামনেই হু হু করে কেঁদে উঠল। তার এই কান্নার কারন কেউ বুঝতে পারল না। সবাই হাসি ঠাট্টা করতে লাগল, সামান্য একটা ফাইলের জন্য এভাবে কেউ কি কাঁদে? কেউ জানল না, সে আসলে কি হারিয়েছে। ছেলেটা কাঁদতে কাঁদতে রাস্তায় বেরিয়ে এল। সে কেঁদেই চলেছে। আশপাশের সবাই অবাক হয়ে তাকে দেখছে। কেউ কেউ জিজ্ঞেস করল, তার কি হয়েছে? ছেলেটি কোন উত্তরই দিল না। কারন এর কোন উত্তর হয় না। কেউ জনল না, সে এই মাত্র, তার জীবনের প্রথম প্রেম, চিরদিনের মত হারিয়ে ফেলেছে। যাকে আর কোনদিন সে পাবে না। এই গল্পটা আমি অনেকবার অনেককে বলেছি। অনেকেই আফসোস করেছে, আবার কেউ কেউ খোঁচা মেরে জিজ্ঞেস করেছে, সেই ছেলেটি আমি কিনা। যা হোক ছেলেটি আমি না হলেও, গল্পটি সত্যি ছিল। আর সেই গল্পটি অন্য ভাবে, আমার জিবনেও আসবে কে জানত। তবে পার্থক্য হচ্ছে, আমার প্রেমের সৃতিগুলো হারিয়ে গেলেও, প্রেমিকা এখনো পাশেই আছে।
 
এভাবে আমাদের জীবন থেকে, আমাদের অনেক প্রিয় জিনিস, চিরজীবনের জন্য ফরম্যাট হয়ে মুছে যায়। যা আর কোন দিন, ফিরে আসে না, শুধু সৃতিটুকুই রয়ে যায়। সেই হারিয়ে যাবার বেদনা, একমাত্র যায় কাছ থেকে হারিয়ে গিয়েছে, শুধু সেই অনুভব করতে পারে। যেমনটা আমি এখনো, সেই দিনগুলোর কথা অনুভব করি।
 
ধন্যবাদ!

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *