আমার একটা ছোট অভ্যাস আর কিছু অভিজ্ঞতা

আজকে শহরে গিয়েছিলাম একটা কাজে। কাজ ঠিকঠাক মত হলেও বোনাস হিসেবে আমার নতুন কেনা দামী ছাতাটা হারিয়ে ফেললাম। তবে মন খারাপ হল না। কারন অনেক দিন পর কোন কিছু হারালাম। কিছুটা মজা লাগছিল। মজার ব্যাপার হচ্ছে আমার কোন কিছু তেমন একটা হারায় না (কিপটা প্রকৃতির বলে 😀 )। আর হারিয়ে গেলেও ঠিকই ফেরত পাই। না ভাই! আমার অতিপ্রাকৃত কোন ক্ষমতা নেই। তাহলে কেনইবা ফেরত পাই? সেই রহস্য নিয়েই আমার এই লেখা। তাহলে শুরু করা যাক।

আমার এই ক্ষুদ্র জীবনে আমার একটা বড় উপলব্ধি হল, প্রত্যেক মানুষই অনন্য। প্রত্যেক মানুষের ভিতর কিছু অসাধারণ গুণাবলী থাকে, যা অন্যের থেকে একেবারেই আলাদা। কিন্তু সেগুলো আমদের চোখে পড়ে না। আমরা শুধু মানুষের খারাপ দিক গুলোই দেখি। খারাপের নিচে ভাল কিছু চাপা পড়ে যায়। অথচ অন্যের অনুকরণীয় ভাল কিছু যদি অনুসরণ করি তবে তা আসলে নিজের উপকারেই লাগে।

প্রায় বছর দশেক আগের কথা। ঢাকায় মেসে থাকতাম। আমার একজন রুমমেট ছিল। তার অসাধারণ একটা খারাপ গুন ছিল। সেটা হচ্ছে, সে একই সাথে ১০/১২ টা মেয়ের সাথে মোবাইলে প্রেম করতে পারত। এবং কোন মেয়েই ঘুণাক্ষরে টের পেত না যে তারা প্রতারিত হচ্ছে। তখন ছিল ডিজুসের যুগ। বিনামুল্যে সারা রাত কথা বলা যেত। সে কোন মেয়ের সাথে কোন দিন, কি কথা বলেছিল, কি ওয়াদা দিয়েছিল, সেটা হুবহু মনে রাখতে পারত। তার এই অসাধারণ গুনের কারনে, মেয়েদের ধোঁকা দেয়া তার জন্য খুবই সহজ ছিল। আমার সব থেকে খারাপ লেগেছিল, একটা মেয়ের জন্য। অসাধারণ তার গানের গলা ছিল। প্রায় প্রতি রাতেই সেই মেয়ে, তার জন্য গান গাইত। আর সেই বদমাশ লাউড স্পিকার দিয়ে রুমের আমাদের সবাইকে তা শোনাত। সেই মিষ্টি সূরের অসাধারণ গান, আমার কানে করুন বাঁশির সুর হয়ে বাজত। আহা মেয়েটা প্রতারিত হচ্ছে, ভাবতেই খারাপ লাগত 🙁 তবে তাকে আমি ধন্যবাদ দেই তার কার্যকলাপ শুধু মোবাইলেই সীমাবদ্ধ থাকত। সরাসরি কোন খারাপ কিছু করত না।

অথচ ইদানীং কি সব বীভৎস খবর শুনি। সেদিন একটা লেখায় পড়লাম এক প্রতারক মোবাইলে মাধ্যমে মেয়েদের প্রেমের ফাঁদে ফেলে ফুসলিয়ে বাহিরে নিয়ে আসে। এরপর পাচারকারী চক্রের কাছে বিক্রি করে দেয়। তার টার্গেট মাসে অন্তত একটা মেয়েকে বশে আনা। বয়স এবং চেহারার উপর ভিত্তি করে সে ৩০-৪০ হাজার টাকা কমিশন পায়। এটাই তার পেশা। এই পর্যন্ত সে ৪০ টা মেয়েকে বিক্রি করেছে। এই কথা ভাবতেই আমি রীতিমত অসুস্থ বোধ করছি। সেই হারামজাদাকে পেলে কি যে করতাম!  যা হোক আমার সেই রুমমেটের সাথে গত বছর ঘটনাচক্রে হঠাৎ করে কথা হয়েছিল। এখন সে বিয়ে করে সংসারি হয়ছে। আগের সেই ঘটনা এখন অতীত। তবে তার কাজে সে অনুতপ্ত। ভাল লাগল যে সে এখন ভাল হয়ে গিয়েছে। আমি সেই সময় তাকে অনেক বুঝিয়েছিলাম এটা না করতে, সে কথা দিয়েছিল এটা ছেড়ে দেবে। সে তার কথা রেখেছে দেখে ভাল লাগল। সেই মেসে খুব বেশিদিন থাকিনি। চাকরীতে প্রমোশন পেয়ে, মাস কয়েক পরেই ঢাকার বাহিরে চলে যাই। ফলে তার মোবাইল প্রেম সঙ্ক্রান্ত খারাপ কাজ দেখা থেকে মুক্তি পাই।

মজার ব্যাপার হচ্ছে এই পিওর বদমাশের একটা ভাল গুন ছিল। সেই কথাতেই আসছি। একবার ঢাকার নববর্ষের মেলাতে ভার্সিটি এলাকায় সবাই ঘুরতে গিয়েছি। সে রমনার দিকে গেল, আমার গেলাম টিএসসির দিকে। অনেক ঘোরাঘুরি আর মজা করে রুমে এসেছি। কে কি কি করেছি, তার বিস্তারিত গল্প করছি। এর মাঝেই সে বলে উঠল, সে তার অফিসের আর রুমের চাবির ছড়া, রমনাতে হারিয়ে ফেলেছে। এমন ভাবে বলল, যেন কিছুই হয়নি। অথচ আমি জানি চাবির ছড়া হারালে কি হয়। মনে আছে একবার আমাকে, একে একে বারোটা তালা ভাংতে হয়েছিল, চাবির ছড়া  হারাবার কারনে। তাই চাবি হারানোর কথা শুনলেই, গায়ে জ্বর চলে আসে। সে নিশ্চিত ভাবে বলল, আজকে রাতে অথবা কালকে দুপুরের মধ্যে,  সে চাবির ছড়া পেয়ে যাবে। আমাদের বিশ্বাস হল না। সে কি ভাবে নিশ্চিত হল,  জিজ্ঞাস করতেই , একটা রহস্যময় একটা হাসি উপহার দিল। এবং সত্যি সত্যি পরের দিন দুপুর বেলা, একজন লোক তার চাবির ছড়া নিয়ে হাজির,  চাবির ছড়া ফেরত দিয়ে, চা খেয়ে বিদায় নিল। আমরা সবাই অবাক হয়ে গেলাম।

এবার সবাই মিলে, তাকে চাপাচাপি শুরু করলাম, কিভাবে কি হল বিস্তারিত জানাবার জন্য। সে তার আসল রহস্য ফাঁস করল। সেটা আর কিছুই নয়। সে তার প্রত্যেকটা দরকারী জিনিসে তার নাম, মোবাইল নম্বর এবং সম্ভব হলে ঠিকানা লিখে রাখে। ফলে কোন কিছু হারালেম সে সেটা ঠিকই ফেরত পায়। আমি দেখেছি কোন কিছুতে মালিকের নাম ঠিকানা লেখা থাকলে, সেটা একটা সাইকোলজিক্যাল ইফেক্ট দেয়, মানে যে পেয়েছে, সে সেটা চাইলেও শান্তিমত ব্যাবহার করতে পারে না। উদাহরণ দেই, হারানো ছাতায় যদি মালিকের নাম লেখা থাকে,  তবে যতবার কেউ সেটা ব্যাবহার করবে এবং সেটা দেখবে, ততবার তার মনের মধ্যে অপরাধ বোধ কাজ করবে। এক সময় বাধ্য হবে ছাতাটা মালিকের কাছে ফেরত দিতে। যা হোক  বিষয়টা আমার খুব মনে ধরল। এরপর থেকে আমি আমার প্রায় সব কিছুতেই আমার নাম মোবাইল নম্বর, ঠিকানা এবং পারলে কিছু উপদেশ বানী লিখে রাখি 😀 বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না, এই টিপস কাজে লাগিয়ে আমি আমার হারানো প্রায় সব কিছুই ফেরত পেয়েছি। কি ফেরত পাইনি? ছাতা, পেন ড্রাইভ, ব্যাগ, জরুরী কাগজ, ব্রিফকেস, ছাগল আরও কত কি।

এমনকি আমি আমার কলমেও আমার নাম, মোবাইল নম্বর লিখে রাখি। মানে শিসওয়ালা কলমের শিসের সাথে একটা কাগজে নাম মোবাইল নাম্বার লিখে রাখি। আমার এই বাতিক দেখে আমার কলিগেরা অনেকেই হাসাহাসি করত। অনেকেই আবার এটা অনুসরণ করত। তবে অস্বীকার করব না এটা আমার অনেক উপকার করেছে!  খারাপ কথা হচ্ছে এটা আবার আমার অনেকটা বাতিকের মত হয়ে গেছে। আমার নিজের মালিকানার কোন কিছুতে আমার নাম, ঠিকানা মোবাইল নাম্বার না লেখা পর্যন্ত আমি ঠিক শান্তি পাই না। এমন কি আমার ছাগলের গলাতেও আমার নাম ঠিকানা ঝুলিয়েছিলাম 😀 একবার হারিয়ে গিয়েও সেই ছাগল ফেরত পেয়েছিলাম 😀

কাছের বন্ধুরা অনেকেই মজা করে বলত, তুমি সব কিছুতেই নাম ঠিকানা লিখে রাখ, তা ভাবীর ক্ষেত্রে কি করেছ? উত্তরে আমি রহস্যময় একটা হাসি দেই 😀 মালিকানা আমি ঠিকই প্রতিষ্ঠা করেছি। কিন্তু কিভাবে কি করেছি সেটা আর নাই বা বলি। থাকনা এটা রহস্য হিসেবেই। সব কথা কি সব সময় সব যায়গায় বলা যায় 😉

Similar Posts