সব থেকে উত্তম পরিকল্পনাকারী

জগৎ রহস্যময়, জীবন চলার পথে এমন সব রহস্যময় ঘটনা ঘটে যে, আপাত দৃষ্টিতে তা অকল্যাণকর হলেও সেটা আখেরে ব্যক্তির জন্য কল্যাণকর। পবিত্র আল কোরআনের আয়াতে আল্লাহ বলেন “নিশ্চয় আল্লাহ সবচেয়ে উত্তম পরিকল্পনাকারী” আজকে বিশেষ কোন কারন ছাড়াই, হঠাৎ একটা ঘটনা মনে পাড়ে যাওয়াতে ভাবলাম, আপনাদের সাথে গল্পটা শেয়ার করি। এই ঘটনার রহস্য বুঝতে, আমার প্রায় ২ বছর লেগেছিল।
 
আজ থেকে প্রায় ৬ বছর আগের কথা। অনলাইন ফ্রিল্যান্সিংএ সাফল্য মাত্র আসতে শুরু করেছে, প্রচন্ড কাজের ব্যাস্ততায়, দিন রাত একাকার হয়ে গেছে। অবসরের ফুসরত নেই বললেই চলে। লেখালেখির সুবাদে, ফ্রিল্যান্সিং কমুনিটীতে অনেকের সাথে পরিচয় হয়েছে। অনেকের সাথেই নিয়মিত যোগাযোগ হয়। কিন্তু দেখা হবার সুযোগ হয় না। মনে বড় কষ্ট। তাই তক্কে তক্কে আছি, কবে সুযোগ হবে ঢাকায় যাওয়ার। ভাই ব্রাদারদের সাথে দেখা করব। ঢাকায় একটা প্রগ্রামের অংশগ্রহণের সুযোগ এল। প্রায় ১ মাস ধরে প্রস্তুতি নিয়েছি। গাড়ির টিকে অগ্রিম কিনে রেখেছি। মনে আছে যেদিন আমার যাবার তারিখ, সেদিনও সারারাত কাজ করেছি। ফাস্ট ট্রিপের বাস, রাত ৩.৪৫ এ ছাড়ে। আমি আগেই ব্যাগ গুছিয়ে রেখেছি। আমার বিবিজানকে বলে রেখেছি যে আমি ঢাকা যাব।
 
আপন মনে, সারারাত কাজ করেছি। কাজে বসলে আমার কোন হুশ জ্ঞান থাকে না। মেইন রাস্তার সাথে বাড়ি বলে, দিনরাত গাড়ির আওয়াজ পাই। বেশ কিছুদিন ধরেই লক্ষ্য করছি, গভীর রাতে, বাড়ীর সামনে রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে, ট্রাক পিকাপের চাকা ঠিক করে। সেদিনও এমন আওয়াজ আসছিল। বাস আসতে আর বেশি দেরি নাই। কাজ মটামুটি গুছিয়ে ফেলেছি। পিসি অফ করে, বাথরুমে যাবার জন্য যেই চেয়ার থেকে উঠেছি, সাথে সাথেই, আমার বুকের বাম পাশে, প্রচন্ড ব্যাথা শুরু হল। দম নিতে পারছি না এমন অবস্থা। শরীর দিয়ে ঘাম ঝরা শুরু হল। আমি ভয় পেয়ে গেলাম। গ্যাসের সমস্যার কারনে, বুক ব্যাথার সাথে রেগুলার পরিচিতি থাকলেও, এই ব্যাথা পুরাপুরি ভিন্ন রকমের মনে হল। মনে হল বুকে কিছু একটা চেপে বসেছে। বুঝতে পারলাম খারাপ কিছু ঘটতে যাচ্ছে। আমার বাসাতে ইমারজেন্সি ওষুধ মোটামুটি থাকে। আমি দ্রুত প্রেশারের ওষুধ, গ্যাসের ওষুধ খেয়ে নিলাম। বুঝলাম এই অবস্থায় ঢাকা যাবার প্রশ্নই আসে না। আবার বাসার সাবাইকে ডাকলে, সবাই ভ্য় পেয়ে যাবে। কারন বাড়ীতে বয়স্ক পুরুষ বলতে আমি একাই। কাজেই ওসব চিন্তা বাদ দিয়ে, আল্লাহর উপর ভরসা করে, বিছানায় শুয়ে পড়লাম। আমার স্ত্রী জিজ্ঞেস করল, তুমি না ঢাকায় যাবা? উত্তরে বললাম শরীর ভাল লাগছে না। তাই ট্যুর ক্যান্সেল। মজার ব্যাপার হচ্ছে কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই তীব্র ব্যাথা চলে গেল। যেহেতু বাস মিস হয়ে গেছে, তাই আর ঢাকায় যাবার চিন্তা বাদ দিলাম। যদিও মনটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল।
 
সকালে ঘুম থেকে উঠে বিশাল কাহিনী শুনলাম। সেটা হচ্ছে, আমাদের বাড়ীর উল্টাপাশে, রাস্তার ওপারে, আমার এক দূর সম্পর্কের চাচার, গরুর ছোট একটা খামার ছিল। সেখানে দুইটা বিদেশি দুধেল গাই, আর তিনটা বাছুর ছিল। গরুর দুধ বেচে, আর ছোট একটা দোকান দিয়ে, তার সংসার কোনমতে চলে। সেই ৫টা গরু শেষ রাতে, চোরের দল চুরি করে নিয়ে গেছে। তখন শীতকাল ছিল, আর ছিল ঘন কুয়াশা, তাই কেউ বিষয়টা টের পায় নাই। এটা শুনে খুবই খারাপ লাগল। কি আর করার, চাচাকে সান্ত্বনা দিতে গেলাম। দেখি বেচারা খুব মন খারাপ করে বসে আছে। তাকে মন খারাপ করতে নিষেধ করলাম। আল্লাহ যা করে ভালর জন্য করে। হঠাৎ করেই সবার সামনে চাচা বলে উঠল, ভাতিজা তুমি না সারারাত জেগে, কম্পিউটারে কি সব কাজ কর? আমার গরুগুলো যে নিয়ে গেল, একটুও কি টের পেলা না? তুমি আসলে কি কর? তার কথাতে কিছুটা উষ্মা প্রকাশ পেল। আমি আর কি বলব, এক বিব্রত অবস্থায় পড়ে গেলাম। সবাই তার কথাতে সায় দিতে লাগল। ব্যাপারটা এমন যে, আমি সতর্ক থাকলে, গরুগুলো চুরি হত না। এমনিতেই কি করি, সেটা নিয়ে মানুষের কানাঘুষার শেষ নেই। কাউকেই বুঝাতে পারি না, এর পরে এই ঘটনা। যা হোক আমি আর কথা না বাড়ীয়ে, মাথা নিছু করে চলে এলাম।
ছোট বেলা থাকেই রহস্য, রোমাঞ্চ উপন্যাস পড়ার অভ্যাস আমার। কিশোরকালে ডিটেকটিভ হবার স্বপ্ন দেখতাম। বেশ কয়েকবার ট্রাইও করেছি। কিন্তু সেগুলো এত ইজি বিষয় ছিল যে, বাচ্চা পলাপাইনও বুঝে যাবে। কাজেই সেই সব কাজে কোন মজা পাইনি। চাচার কাছ থেকে কিছুটা অপমানিত হবার পর থেকে, বিষয়টা হজম করতে পারছিলাম না। কিছু একটা করার ইচ্ছা হচ্ছিল। এবং আমি ডিটেকটিভ হবার সুযোগটা পেয়েও গেলাম। সেই ঘটানার দুই দিন পরে, শহরে গিয়েছি একটা কাজে। আমার এক বড় ভাইয়ের সাথে দেখা। তাকে নিয়ে মোটরসাইকেলে শহরে ঘুরছি আর গল্প করছি। তাকে আমাদের বাসার সামনে থাকে গরু চুরির ঘটনা বললাম। ঘটনা শুনে তিনি জিজ্ঞেস করলেন এটা গত পরশুর ঘটনা কিনা? আমি অবাক হয়ে বললাম হ্যা। তিনি বললেন গত পরশু, শেষ রাতের দিকে, বাইপাসে টহল পুলিশ ত্রিপল দিয়ে ঢাকা একটা ছোট পিকাপ আটকেছিল। তাতে নাকি কয়েকটা গরু ছিল। টহল পুলিশ নাকি বড় একটা সেলামির বিনিময়ে, গাড়ীটা ছেড়ে দিয়েছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম আপনি এটা কিভাবে জানলেন। তিনি বললেন সেই সময় বাইপাসে কিছু দোকান খোলা ছিল। আর বেশ কিছু লোক উপস্থিত ছিল। তারাই এটা পরে এলাকায় এটা ছড়িয়েছে। সত্যি মিথ্যা জানি না। এটা শোনার পরে, উত্তেজনায় আমার লাফ দিতে ইচ্ছে হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল এখনি বাড়ীর দিকে রওয়ানা দেই।
 
উত্তেজনায় কাঁপতে কাঁপতে, শহর থেকে বাসায় এসেই, প্রথমে গেলাম সেই চাচার কাছে। উত্তেজনায় নিজেকে ধরে রাখতে পারিছিলাম না। সব শুনে বেচারার চোখমুখ উজ্জল হয়ে উঠল। বেচারার এত বড় অবলম্বন হারিয়ে, এমনিতেই মনমরা হয়েছিল। এটা জানার পরে, সে একটা আশার আলো দেখতে পেল। আমি তাকে বললাম আপনি দ্রুত থানায় চলে যান। বিস্তারিত বলেন, আশা করি গরুগুলো উদ্ধার হবে। তিনি বললেন তিনি সর্বচ্চ চেষ্টা করবেন। এর পরে আমি আমার কাজ নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে পড়লাম। ঘটনা প্রায় ভুলেই গেলাম। প্রায় ১ সপ্তাহ পরে, তার সাথে আবার দেখা, জিজ্ঞেস করলাম, গরুগুলোর কোন খোজ পেলেন? তিনি বললেন তিনি সর্বচ্চ চেষ্টা করেছেন। গরুর খোজও পেয়েছিলেন, কিন্তু সেই গরুর উদ্ধার হবার কোন আশাই নেই। তার এক নিকট আত্মীয় পুলিশ সুপার, তাকে দিয়েও ট্রাই করেছেন, সেই টহলপুলিশ দলকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল। তাদের উত্তর ছিল, তার একটা ছোট পিকাপ আটকেছিল। ত্রিপল উল্টীয়ে দেখে (তখন শীতকাল ছিল) তাতে বেশকিছু গরু, জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানায়, তারা গরুর ব্যাপারি, কোন এক হাট থেকে, তারা এই গরু কিনে এনেছে। তাদের কাছে কাগজপত্র ছিল। এই কথার পরে, আর কোন কথা থাকে না। যদিও তারা উৎকোচের কথা পুরাপুরি চেপে গেল।
 
তার পরেও তিনি বিভিন্ন সুত্র মারফত ট্রাই করে, জানতে পারেন যে, তার গরুগুলো চুরি করেছিল এক আন্তজেলা গরু ডাকাতদল। আমাদের বৃহত্তর ময়মনসিংহের বেশির ভাগ গরুগুলো মূলত এরাই চুরি করে। এদের বিশাল সিণ্ডিকেট, প্রচুর ক্ষমতা এবং দাপট। প্রশাসনের সাথে ভাল খাতির। গরু ডাকাতির সাথে সাথেই তারা সেগুলো বিক্রি করে দেয়। এমনকি আগাম টাকাও নিয়ে রাখে। চোরাই গরু রাখার জন্য, গহীন চরে তাদের সেফ স্পটও আছে। মোট কথা, তাদের কাছ থেকে গরু উদ্ধার করতে গেলে, তুলকালাম কান্ড ঘটাতে হবে। তার সেই পুলিশ অফিসার আত্মীয়ই তাকে বলেছে, এই গরুর আশা ছেড়ে দিতে। উদ্ধার করতে গেলে, যে পরিমান খরচ আর হয়রানি হবে, তাতে ওই দিকে পা না বাড়ানোই উত্তম। এটা শোনার পরে, মনটাই খারাপ হয়ে গেল। এই দেশে আমরা কতটা অসহায়, সেটা বুঝতে পারলাম। চাচা আমাকে ধন্যবাদ দিল, যে তার জন্য আমি এতটা করেছি। মন কিছুটা হালকা হল, অন্তত তার জন্য কিছু করতে পেরেছি। ওই ডাকাতির পরে, আমাদের বাসার সামনে, আর কোন ট্রাক বা পিকাপ মাঝরাতে দাড়ীয়ে, আর চাকা ঠিক করতে দেখিনি। আমার ডিটেকটিভ মন বলল, আসলে তারা গাড়ী ঠিক করার উসিলায়, কয়েকদিন ধরে স্পট রেকি করছিল এবং গরু চুরির টাইম ঠিক করছিল। তারা অভিজ্ঞ, অনেক পরিকল্পনা করে, এসব ডাকতি করে, কোন ফাঁকফোকর রাখে না। আর প্রতিটা গরু চুরির পিছনে, তাদের লোকাল ইনফরমার থাকে। না হলে, বাহিরের কেউ এত সহজে, গরু চুরি করতে পারবে না। লোকাল ইনফরমারেরা, ডাকাতির একটা পারসেন্টেজ পায়। আমি এলাকার কয়েকজনকে এই ব্যাপারে সন্দেহও করেছিলাম। কিন্তু শয়তান বদমাশদের সাথে, প্রমান ছাড়া, আন্দাজে লাগতে যাওয়া বোকামি। এতে হিতে বিপরীত হবে, কাজেই ওই চিন্তা একেবারে বাদ দিলাম
 
গল্পটা এতদূর যদি পড়ে থাকেন, তবে আপনার বিরক্ত হবার কথা, মনে মনে হয়ত ভাবছেন, এই পোস্টের হেডলাইন হওয়া উচিৎ ছিল “গরু চুরির সেই রাতের কথা” বা এমন কিছু। আমি কেন অন্য নাম দিলাম। এবার তাহলে আসল ঘটনা খুলে বলি। সেই গরু চুরির ঘটনার প্রায় দুই বছর পরের কথা, তখনও ছিল শীতকাল, ঢাকায় একটা মিটাপে যাব। সেই আগের মতই সব কিছু রেডি। টিকেট কেটে রেখেছি, আল্লাহর রহমতে খারাপ কিছু ঘটল না। বাসা থেকে বের হয়ে, মেইন রাস্তায় দাড়ীয়েছি ফাস্ট ট্রিপের বাসের জন্য। চারিদিকে ঘন কুয়াশা। সব কিছু চুপচাপ নিস্তদ্ধ। এই সময় সেই গরু চুরির ঘটনা মনে পড়ল। মনে মনে ভাবলাম, সেদিন যদি আমি ঘর থেকে বের হতাম, তবে ঠিক এই যায়গায়তেই দাড়াতাম। এবং ঠিক এই জায়গাতেই গরুর ডাকাতেরা, গরুগুলো গাড়িতে তুলছিল। নিজেকে প্রশ্ন করলাম, আমি তখন কি করতাম? আর সেই চিন্তা করার সাথে সাথে, ভয়ের একটা তীব্র স্রোত আমার শিরদ্বাড়া বেয়ে নিচে নেমে গেল। ভয়ে আমি রীতিমত ঘামতে লাগলাম। যারা গরু চুরি করেছিল, তারা মূলত পেশাদার ডাকাত, প্রয়জনে কাউকে জানে মেরে ফেলতে, একটুও দ্বিধা করে না। আমি যদি সেদিন উপস্থিত থাকতাম, তবে নিশ্চিত ভাবে তাদের প্রশ্ন করতাম। আর এই অপরিচিত ডাকাতদের দেখে, সব বুঝে ফেলতাম এবং নিশ্চয়ই চিৎকার দিতাম, বা প্রতিরোধের চেষ্টা করতাম। হয়ত বা সেই সুযোগ তারা আমাকে দিতই না। মহান রাব্বুলআলামিনের প্রতি কৃতজ্ঞতায় আমার অন্তরটা ভরে উঠল। সেদিনের সেই বুকে ব্যাথার মাধ্যমে, মহান রব আমার জীবন রক্ষা করেছেন। অথচ সেটা বুঝতে আমার দুই বছর লেগে গেলে। অথচ সেই প্রোগ্রাম মিস করার কারনে, কতইনা আফসোস করেছি। মানুষ আসলে কতই না অবুঝ, পবিত্র আল কোরআনে আল্লাহ বলেন
 
“হতে পারে কোন বিষয় তোমরা অপছন্দ করছ, অথচ তা তোমাদের জন্য কল্যাণকর। আর হতে পারে কোন বিষয় তোমরা পছন্দ করছ, অথচ তা তোমাদের জন্য অকল্যানকর। বস্তুত আল্লাহ জানেন এবং তোমরা জান না।” (সূরা বাকারা, আয়াত ২১৬)”
 
এর পর থেকে, কোন কিছু হলে, হোক সে খারাপ কিছু, আফসোস করা বাদ দিয়েছি। চেষ্টা করি সব সময় আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করার। বান্দার কিসে ভাল, সেটা আল্লাহই ভাল জানেন। তিনিইত উত্তম পরিকল্পনাকারী। কোন কিছু হলে, সেটা নিয়ে এখন আর মাথা ঘামাই না। সব কিছু আল্লাহর উপর ছেড়ে দিয়েছি। কোরআনে আল্লাহ বলেন। “যে আল্লারহ উপর ভরসা করে, তার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট”।
 
সবাই ভাল থাকবেন।
 
ধন্যবাদ!

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *