আমার সাংবাদিক হবার গল্প

 
ছোট বেলা থেকেই আমার বই পড়া, আর সাথে লেখালেখি করা অনেক ভাল লাগে। সেই স্কুল লাইফ থেকে নিয়মিত ডায়েরী লিখি। স্কুল লাইফে থাকতেই বিদেশে নিয়মিত চিঠি পাঠাতাম। অনেক উপহার পেয়েছি বিদেশ থেকে। বিশেষ করে বিদেশের বাংলা ভাষার রেডিও চ্যানেল বেশি বেশি শুনতাম আর নিয়মিত চিঠি লিখতাম। আমার ৩টা চিঠি চীনের রেডিও বেইজিংএর বাংলা চ্যানেল থেকে পড়ে শোনানো হয়েছিল। তখন মনে হয়েছিল ইশ যদি কোনদিন চীনে যেতে পারতাম। আল্লাহ আমার দোয়া কবুল করেছিলেন, ২০১০ সালে চীন থেকে ঘুরে আসি। তখন সেই চিঠির কথা মনে হয়েছিল।
 
এসব কথা লিখছি এটা বোঝাবার জন্য যে লেখালেখি আমার ভাল লাগে। এবার আসি সাংবাদিক হবার গল্প বিষয়ে। সে এক তিক্ত অভিজ্ঞতা। ৭ বছর আগের কথা। চাকরি ছেড়ে বাড়িতে থাকা শুরু করেছি। ভিলেজ পলিটিক্স বলে একটা কথা আছে। সেটার পাল্লায় অনেক আগেই আমার পরিবার পড়ে গিয়েছে। আমি বাড়িতে যেয়ে সেটা হাড়ে হাড়ে টের পেলাম। এর থেকে নোংরা জিনিস আর হতে পারে না। আমাদের পিছনে ঈর্ষাবশত কিছু বাজে লোক লাগিয়ে দেয়া হল, যেহেতু আমরা শিক্ষিত আর শহরে মানুষ হয়েছি। এটাই আমাদের অপরাধ। তাদের কাছে আমরা বহিরাগত। দিন নেই রাত নেই বিভিন্ন ভাবে হয়রানি করতে লাগল। আমার বাবা ছিলেন পুলিশের একজন সাব ইন্সপেক্টর। একজন নিরীহ সাধাসিধে মানুষ বলতে যা বোঝায় তিনি ছিলেন তা। জীবনে কারো গায়ে হাত তুলেছেন কিনা সন্দেহ। ঘুষ খাবারত প্রশ্নই আসে না। কিভাবে পুলিশের চাকরীতে এল সেটা একটা গবেষণার বিষয় ছিল। তাকে প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক হিসেবে ভাল মানাত। ভুল করে এই প্রফেশনে চলে এসেছিলেন। সেই আব্বাও বেঁচে থাকতে কিছু করে যেতে পারেননি। আপানার শুনলে হাসবেন, আমার আব্বা চাকরিরত থাকা অবস্থায়, থানার দারোগা প্রতিপক্ষের কাছ থেকে ঘুষ খেয়ে আমাদের বাসায় এসে, আমার মা ভাইকে হুমকি ধামকি দিয়ে গিয়েছিল। এমনকি পারলে আমার ভাইকে থানায় ধরে নিয়ে যায়। লোকে বলে কাকে কাকের মাংস খায় না। এটা পুরাপুরি ভুল কথা।
 
যা হোক আব্বা হঠাৎ করেই মারা গেলেন। আমরা আরও বিপদে পড়ে গেলাম। আব্বা থাকতে অন্তত থানায় যেয়ে, বলতে পারতাম আমরা পুলিশের সন্তান কিছু একটা করেন। এখন তিনি চলে যাবার পরে, একেবারে অসহায় হয়ে পড়লাম। শুনলাম নতুন ওসি সাহেব এসেছেন। লোক নাকি ভাল। সাহস সঞ্চয় করে ছোট ভাইকে নিয়ে থানায় গেলাম, যদি কোন হেল্প পাই। ওমা তিনি যে পরামর্শ দিলেন সেটা শুনলে আপনারাও অবাক হবেন। তিনি বললেন তোমরা তোমাদের শরীরে কিছু ডিপ ইনজুরি তৈরি করে, সরাসরি থানায় চলে আস, বাকিটা আমি দেখছি। ওদের জেলের ভাত কিভাবে খাওয়াতে হয় সেটা আমি দেখব। নিজেদের শরীর নিজেরাই কাটাকুটী করা ইচ্ছায় হয়নি, আর তাই অমুখোও হইনি। কিন্তু প্রতিপক্ষও বসে নেই, দিন নেই রাত নেই হুমকি ধামকি তার ঝগড়া চলতেই থাকল। জীবন প্রায় ওষ্ঠাগত। ঠিক তখনই এই সাংবাদিক হবার চিন্তা মাথায় এল। সেটা লেখালেখি করে দেশ ও দশের উপকার করব এই জন্য না। শুনেছি সাংবাদিকদের সবাই সমীহ করে এমনকি পুলিশও ভয় পায়। তাই ভাবলাম সাংবাদিক হব, তাহলে এলাকার সবাই ভয় পাবে, একটু নিরাপদে থাকতে পারব।
 
আমার এক বড় ভাই, বড় একজন সাংবাদিক। তাকে ধরলাম, একটা ব্যাবস্থা করে দেয়ার জন্য। তিনি আমাকে সুপারিশ করলেন আমার উপজেলার এক বড় সাংবাদিক নেতার কাছে। যথারীতি তার সাথে দেখা করলাম। কেন সাংবাদিক হতে চাই জিজ্ঞেস করলেন। সরাসরি বলে ফেললাম যে এলাকায় থাকতে সমস্যা হচ্ছে। একটা সংবাদিক পরিচয় পেলে উপকার হত। তিনি বললেন দেখেন শিয়ালের হাত থেকে বাঁচতে যেয়ে আপনি বাঘের মুখে পড়বেন। এটা কেন, জিজ্ঞেস করতেই বললেন, দেখেন আমাদের মধ্যে অনেক গ্রুপিং আছে। এই উপজেলায় তিনটা গ্রুপে আছে। আপনি আমাদের গ্রুপে আসলে, বাকী গ্রুপের শত্রু হয়ে যাবেন। তারা আপ্রান চেষ্টা করবে আপনার ক্ষতি করার। আরও যোগ করলেন, আপনি হয়ত ভাবেছেন আমরা ভাল বেতন পাই। এটা পুরাপুরি ভুল ধারণা। এই থানায় টিভি পত্রিকা মিলে ৪২ জন সাংবাদিক আছে, তাদের মধ্যে একমাত্র আমিই পত্রিকা অফিস থেকে কিছু বেতন পাই। আর কোন সাংবাদিক বেতন পায় না। আমিত পুরাপুরি অবাক। উপস্থিত অন্য সাংবাদিকদের দিকে তাকালাম। তারা মুচকি হেটে সম্মতি দিলেন। জিজ্ঞেস করলাম আপনাদের চলে কি করে? একজন মুচকি হেসে বললেন বুইঝা লন, দেখালাম তার মোটরসাইকেলটাই সব থেকে দামি। সবাই আমাকে নিরুৎসাহিত করতে লাগল। কিন্তু আমি নাছোড় বান্দা, বললাম আমাকে সাংবাদিক হতেই হবে। নেতা বললেন ঠিক আছে, আমাদের সাথে থাকতে থাকেন, দেখেন টিকতে পারেন কিনা। পরের দিন তাদের সাথে আবার দেখা করতে এসেছি। হঠাৎ এক সাংবাদিক এসে আমার মোটরসাইকেল চাইল। বললাম দেখেন ভাই, এটা আমার মরহুম আব্বার মটরসাইকেল, কাউকে দেই না। বলেন কোথায় যেতে হবে। আমি নিয়ে যাচ্ছি। একটু ইতস্থত করে বললেন ঠিক আছে চলেন। আমাকে নিয়ে একটা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে এল। আমাকে বলল এখানে একটু দাড়ান। সে ভিতরে চলে গেল। প্রায় ১০ মিনিট পরে বের হয়ে আসল, সেন্টারের মালিক তাকে এগিয়ে দিল। আমাকে আরও এক জায়গায় নামিয়ে দিতে বলল। যেতে যেতে আমাকে বলল, আসলে আমাদের একটা প্রোগ্রাম আছেত তাই বড় ভাই আমাকে পাঠিয়েছে ডোনেশনের জন্যে। মালিক খুশি হয়ে ১০ হাজার দিয়েছে। বুঝলাম নিরভেজাল চাঁদাবাজি চলছে। তাকে আরেকটা ব্যাবসা প্রতিষ্ঠানে নামিয়ে দিয়ে চলে এলাম। মনে হল আজকে তাদের কালেকশন ডে চলছে।
 
আরও কয়েকদিন তাদের সাথে চললাম, এবং ভিতরের বিভিন্ন জঘন্য আর নোংরা বিষয় জেনে, মনটা এতটাই বিষিয়ে উঠল যে, আমার সাংবাদিক হবার ইচ্ছা অঙ্কুরেই নষ্ট হয়ে গেল। সেসব আর বিস্তারিত বলব না। কারনটা বুঝতেই পারছেন। তাদের সাথে প্রায় ৭ দিন ছিলাম। আমার এই সাত দিনের ছোট সাংবাদিক ক্যারিয়ারে আমি একটা রিপোর্টও করেছিলাম। আর সেটা ছিল, আমাদের বাড়ির অদুরে এক CNG এক্সিডেন্টে, এক বাচ্চা মেয়ের মারা যাওয়ার ঘটনা। আমি খবর শুনে দ্রুত সেখানে গেলাম। মনটা খারাপ হলেও, জীবনের প্রথম রিপোর্ট কাভার করতে যাচ্ছি, ভাবতেই উত্তেজনার কাঁপছিলাম। সাথে আমার ছোট সামাসাং ক্যামেরাটাও নিয়ে নিলাম, যদি ছবি তোলা যায়। ঘটনাস্থলে যেয়ে, নিজেকে সাংবাদিক পরিচয় দিলাম। ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইলাম। ওমা দেখি কেউ আমাকে পাত্তাই দিচ্ছে না। আমি ডেড বডির কাছে যেতে চাইলাম, আমাকে তারা যেতেই দেবে না। পরে একজন জানাল ৬০ হাজার টাকায় ঘটনা সেটেল হয়ে গেছে। এত দ্রুত সেটেল কিভাবে হল সেটা এক গবেষণার বিষয় বটে। বাচ্চাটা গরিব ঘরেরর বুদ্ধিপ্রতিবন্ধি মেয়ে ছিল। রাস্তার ধারে বসে খেলছিল। একটা CNG আরকেটার সাথে পাল্লা দিতে যেয়ে, অভারটেকের সময় তাকে পিষে ফেলে। সবাই দেখালাম বলছে ভালই হয়েছে,। সে তার বাপ মাকে মুক্তি দিয়ে গেছে। বেঁচে থালে বোঝা হয়ে থাকত। কি বিচিত্র আমাদের চিন্তাধারা। শুনেছিলাম হাতে কিছু টাকা পেয়ে মেয়ের বাপে নাকি খুশিও হয়েছিল। মনে করছে এত টাকা পেয়েছে এই জন্য এত খুশি হয়েছে। আপনারা আসলে ভুল ভাবছেন। ৬০ হাজার টাকার সামান্যই সে পেয়েছিল। বাকী টাকা মাতবর, টাউট বাটপাড় থেকে শুরু করে পুলিশ, সাংবাদিক পর্যন্ত ভাগ হয়ে গিয়েছিল। প্রমান পেলাম যখন সাংবাদিক ভাইকে ঘটনা জানালাম। তিনি এমন ভাব ধরলেন যেন কিছুই হয়নি। বললেন চলে আসেন, এসব বাদ দেন। আমি পিড়াপিড়ি করতে লাগলাম। বললাম এত বড় অন্যায় হল আর কোন বিচার হবে না। আমার চাপাচাপিতে তিনি বললেন আচ্ছা একটা রিপোর্ট লিখে মেইল করেন। আমি যা যা দেখেছি তা যতটুক পারি গুছিয়ে তাকে ইমেইল দিলাম। আমার সেই রিপোর্ট আর কোন দিন ছাপা হয়নি। ধারনা করি সেই টাকার ভাগ সংবাদিকেরাও পেয়েছিল, না হলে কেন এত অনিহা ছিল এই রিপোর্ট প্রকাশের। আসলে সেদিন থেকেই মন উঠে গেল। বার বার জিজ্ঞেস করেও যখন জানলাম আমার রিপোর্ট ছাপা হয়নি। তখন সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেললাম। আর সেই দিন থেকে, সংবাদিকতা থেকে আমার নামটাও কাটা গেল। আর কোন দিন তাদের ছায়াও মাড়াইনি।
 
পরিশেষে একটা কথা বলব, আমাদের দেশের অন্যান্য পেশার মত এই পেশাটাও পুরাপুরি নষ্ট হয়ে গেছে। প্রকৃত সাংবাদিক দেখতে হলে, আমার মনে হয় যাদুঘরে যেতে হবে।
 
ধন্যবাদ!

Similar Posts