মহান রবের নিকট বান্দার প্রার্থনা!

আমরা যারা আস্তিক, সে যে ধর্মেরই হই না কেন, আমরা স্রষ্টায় বিশ্বাসী। আর একজন মুসলমান হিসাবে, সেই পবিত্র সত্তার উপর ঈমান আনা অবশ্যকর্তব্য! তিনি, মহা পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়, আহংকার করা একমাত্র তারই সাজে। তিনি আমাদের প্রতি অনবরত করুণা বর্ষণ করে যাচ্ছেন। অথচ আমরা তার কৃতজ্ঞতা একবারেই স্বীকার করি না। সারাদিনের ব্যাস্ততার মাঝে, একটুও ফুসরত পাই না, মহান রাব্বুল আলামিনকে স্মরণ করার। তার ভান্ডারের কোন শেষ নেই। দুনিয়ার সব মানুষের সব চাওয়াকে তিনি পুরন করে দিলেও, তার ভান্ডারের সামান্য কিছুও কমবে না। অথচ আমরা তার কাছে চাইতে লজ্জা পাই। কিসের এত লজ্জা, আমাদেরত চাওয়ার আর কোন যায়গা নেই। তাহলে তার কাছে কেন চাইব না। অন্তর থেকে চাইলে, নিশ্চয়ই আল্লাহ্‌ সেই চাওয়া আল্লাহ্‌ পুরন করেন। হাদিসে আছে, রাতের শেষ ভাগে, মহান রাব্বুল আলামিন, আরশে আজিম থেকে, প্রথম আসমানে নেমে আসেন। তিনি আহবান করেন তার বান্দার কি কি চাওয়ার আছে, সে যেন আল্লাহর কাছে কিছু চায়। বান্দা মনের গভীর থেকে কিছু চাইলে, তিনি সেই আশা পুরন করেন। আজকের এই পোষ্টে আমার জীবনের ঘটে যাওয়া, মাত্র তিনটি ঘটনা শেয়ার করব। যেগুলো আমি খোদার কাছে, মন থেকে চেয়েছিলাম এবং পেয়েওছিলাম। এই কথাগুলো কখনো শেয়ার করার ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু হায়াত মউতের কথা বলা যায় না। আমি চলে গেলেও, আমার এই লেখা হয়ত রয়ে যাবে। হয়ত আমার মনের কথা, আপনাদের কারও চোখে পড়বে, তার মনে হয়ত, একটু হলেও এই ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তা করতে চাইবে। এটাই বড় প্রাপ্তি হবে। তাহলে শুরু করা যাক।

ঘটনা ১ঃ

আমার মায়ের খুবই ইচ্ছা ছিল পবিত্র হজ্জ পালন করার। কিন্তু আব্বা অবসরে যাওয়ার ১০ বছর আগেই, মারা যাওয়াতে, তার সেই ইচ্ছার পরিসমাপ্তি ঘটে বলা যায়। কারন আমাদের মত নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের গৃহকর্তা, সাধারণত চাকরি থেকে অবসর নেয়ার পর, সেই পেনশনের টাকা দিয়ে হজ্জে যাওয়া হয়। অনেক সময় স্ত্রীকে নিয়ে যাওয়ার আর্থিক সামর্থ্য থাকে না। ফলে তাকে অনিচ্ছা স্বত্বেও একা যেতে হয়। আমার মা প্রায়ই এটা নিয়ে আফসোস করত। একদিন বললাম, তুমি মন থেকে দোয়া কর, আল্লাহ্‌ হয়ত কবুল করবেন। তিনি বললেন তোর যে আর্থিক অবস্থা, তাতে কোন ভরসা পাই না। আমি বললাম তুমি দোয়া কর, কবুলের মালিক আল্লাহ্‌।
২০১১ সালে একটা কাজে আমি বান্দরবন গিয়েছিলাম। সময়টা ছিল বর্ষাকাল। চারিদিকে মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। মনে আছে, একটা পাহাড়ী ছড়ার পাশে, কাঠের তৈরি একটা ঘরে, সবাই মিলে ফজরের নামাজ পড়ছি। উপের শণের ছাউনি দেয়া চালে অনবরত বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছে। পাশের ছড়ার পানি ফুলে ফেপে উঠেছে, অনবরত শো শো শব্দে পানি প্রচন্ড বেগে বয়ে যাচ্ছে। চার্জ প্রায় শেষ হয়ে যাওয়াতে, সোলারের বাতি নিভু নিভু করে জ্বলছে। চারি দিকে আলো আধারির খেলা। সে এক অপার্থিব একটা পরিবেশ। ইমাম সাহেবের সুললিত কণ্ঠে কোরআন তেলওয়াত, মনের মধ্যে এক ভাব গাম্ভীর্যের পরিবেশ নিয়ে এসেছে। মনে হল আমি অন্য কোন জগতে হারিয়ে গিয়েছি। নামাজ শেষে, ইমাম সাহেব অনেকক্ষণ ধরে মোনাজাত করলেন। পরিবেশের কারনে সবাই খুব আবেগপ্রবন। আমি সহ অনেকেরই দুই চোখ বেয়ে পানি ঝড়ে পড়ছে। মোনাজাতের এক পর্যায়ে, ইমাম সাহেব বললেন, মনে করেন আল্লাহ্‌ আপনার সামনে, আপনি তার কাছে আপনার আপনার জীবনের যে কোন একটি মাত্র চাওয়া, মনের গভীর থেকে চান। ইনশাল্লাহ তিনি কবুল করবেন। আমি মনের গভীর থেকে চাইলাম, হে আল্লাহ্‌ তুমি আমার মাকে এবং আমাকে তোমার ঘর তাওয়াফ করার তউফিক দাও, আমাদেরকে হজ্জ করা তৌফীক দাও। আমি জানি না কি হল, আমি স্পষ্ট বুঝতে পারলাম, আমার দোয়া কবুল হয়ে গেছে। মনটা এক অপার্থিব সুখানভুতিতে ভরে উঠল। আমি সেই সময়ের কথা, আসলে ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। এই গল্প আসলে কাউকে শেয়ার করতে পারিনি, বা শেয়ার করা যায় না। এই প্রথমবার আপনাদের সাথে শেয়ার করলাম।
 

সেদিন থেকে আমি এটা মনে প্রানে বিশ্বাস করেছি। এমনকি আমি চোখ বন্ধ করলেও দেখতাম যে, আমি আর আমার মা হজ্জ করছি। অথচ সেই সময়ের আমার যে আর্থিক অবস্থা ছিল, তাতে হজ্জ করার কথা, কল্পনাতেও আনা যায় না। আমার যে শোচনীয় অবস্থা ছিল, তাতে কাউকে যদি এই কথা বলতাম তবে, সে আমাকে নিশ্চিত ভাবে পাগল ভাবত। এমনও সময় গিয়েছে মাত্র ৮ হাজার টাকা দিয়ে, এক মাসে সংসার চালাতে হয়েছে। অথচ এই ঘটনার মাত্র ৬ বছর পর, আল্লাহ্ আমার‌ মাকে নিয়ে, তার ঘর তাওয়াফ করার সুযোগ দেন। আমি এবং আমার মা পবিত্র হজ্জ পালন করি। মহান রাব্বুল আলামিনের দরবারে লাখো কোটি শুকরিয়া! আমিন!

ঘটনা ২ঃ

আমি সৎ আদর্শবান বাবার সন্তান। ফলে ছোট বেলা থেকেই সততার শিক্ষা, হাতে কলমে পেয়েছি। চেষ্টা করি হালাল উপার্জন করার, এবং হালাল ভাবে চলার। এই সৎ ভাবে চলতে গিয়ে, পদে পদে আমি হয়রানির স্বীকার হয়েছি। দুই দুইটা চাকরি ছাড়তে হয়েছে এটার জন্য। কিন্তু তার পরেও আমি নীতি থেকে একটুও সরিনি। জানি না কত দিন এটা ধরে রাখতে পারব। আল্লাহর কাছে দোয়া করি, তিনি যেন সততার উপর অটল রেখে আমাকে মৃত্যু দেন। নীতির প্রশ্নে চাকরি ছেড়ে দিয়ে, স্বাধীন ভাবে কিছু করার চেষ্টা শুরু করি। প্রথমে মাশরুম চাষ করে সংসার চালিয়েছি। এর পরে শুরু করলাম গ্লকোমিটারের বা ডায়বেটিস চেক করার মেশিনের ব্যাবসা, এটা বিক্রি করতে যেয়ে যে কত অভিজ্ঞতা হয়েছে যে, সেগুলো লিখতে গেলে বড় উপন্যাস হয়ে যাবে। আমার ৬ বছরের মার্কেটিং করার অভিজ্ঞতা দিয়েও, অনেক সময়, দিনে একটা মিটার বিক্রি করতে পারতাম না। কয়েকটা উদাহরণ দেই।
 
একটা বড় সরকারী অফিসে গিয়েছি, আমি সাধারণত কোন অফিসে গেলে, প্রধান কর্মকর্তার অনুমতি নিয়ে, এর পরে মার্কেটিং করতাম। কারন, না হলে, পরে অনেকেই ঝামেলা করত। অফিসের বড় অফিসারকে বললাম যে, আমি একটা কোম্পানি থেকে এসেছি, গ্লকমিটারের প্রমোশন করতে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, আমি কি ডায়বেটিস টেস্ট করি কিনা, আমি বললাম হ্যাঁ করি। তিনি সাথে সাথেই খবর দিয়ে তার সব কর্মকর্তা কর্মচারীদের ডেকে পাঠালেন। বললেন আমি নাকি ফ্রিতে ডায়বেটিস পরীক্ষা করতে এসেছি। অথচ এই কথা আমি বলিনি। দেখতে দেখতে আমার সব ডায়াবেটিসের স্ট্রিপ শেষ হয়ে গেল। সব আমার পকেটের টাকা, মনটাই খারাপ হয়ে গেল। আমার মন খারাপ অবস্থা দেখে, এক হুজুর টাইপের অফিসার আমাকে তার রুমে ডেকে নিলেন, বললেন একটা মেশিন আমাকে দেন। আমি খুশি হলাম। তাকে মেশিন বুঝিয়ে দিয়ে, টাকা যখন বুঝে নিচ্ছি, তখন তাকে জিজ্ঞেস করলাম, এই মেশিন কার জন্য? তিনি বললেন এটা এমনিতেই নিয়েছেন। তাদের কারো ডায়াবেটিস নেই। শখের বসে মাঝে মাঝে টেস্ট করবেন। বুজলাম আমাকে খুশি করার জন্য এটা তিনি করেছেন।
 

আবার বিপরীত ঘটনাও আছে, ভার্সিটির এক একাউণ্টেন্ট, তার মায়ের জন্য মিটার নিয়েছেন। তার নাকি টাকার টানাটানি, তাই সরাসরি বাকী চাই্লেন, যেহেতু মাকে উপহার দেবে, তাই রাজি হলাম। মিটার বুঝে নেবার পরে শুরু হল আসল খেলা, টাকার জন্য খালি ঘুরাতে লাগল। অন্তত ১০ বার তার অফিসে গিয়েছি। শেষ মেস ঈদের ছুটির আগের দিন গেলাম, তাকে অনেক রিকয়েস্ট করলাম। তার মন কিছুটা নরম হল, সে ২০০ টাকা কম দিয়ে বাকী টাকা পরিশোধ করল। সাথে দুটী কথা শুনিয়ে দিল, সেটা হচ্ছে, তাকে নাকি বিভিন্ন কোম্পানি এমনিতেই গিফট করে, সে মনে করেছিল, আমি নাকি তাকে ফিগট করেছি। এত উচ্চ শিক্ষিত মানুষের এই ব্যাবহার দেখে মনটাই খারাপ হয়ে গেল। এমন মন খারাপ অভিজ্ঞতা বলা যায় প্রতিদিনই হত।

 

সড়ক ও জনপথ বিভাগে গিয়েছি। দেখছি সবাই ওপেন ঘুষ লেনদেন করছে। সব ওপেন সিক্রেট। কেউ আমার মিটার নেয়ার ব্যাপারে আগ্রহী দেখলাম না, সবাই টাকার ধান্দায় ব্যাস্ত। নূরানি চেহারার, লম্বা দাড়ীওয়ালা বয়স্ক এক হুজুর টাইপের অফিসারের কাছে গেলাম, বেচারা প্রচুর পান খেয়ে খেয়ে, মুখ একেবারে লাল করে ফেলেছে।তাকে দেখে ভক্তিতে মাথা নত হয়ে আসে এমন অবস্থা। জানলাম তিনি ডায়াবেটিসের রোগি। তার দুঃখে দুঃখী হলাম, আবার এতে আমি আশার আলোও দেখতে পেলাম। তাকে গ্লূক্মিটারের গুণগান বুঝালাম, তিনি বুঝলেন। তাকে বললাম একটা মিটার নেন, আপনার কাজে আসবে। তিনি রাজি হলেন, তবে শর্ত হচ্ছে তাকে বাকী দিতে হবে। আমি তাতেও রাজি হলাম, যে নূরানি চেহারা, না কিভাবে বলি। তিনি বললেন মাসে তিনি ৫০ টাকা করে দেবেন। আমিত পুরাই অবাক, প্রায় দুই বছর লাগবে টাকা শোধ করতে। আমি মনে করেছিলাম তিনি মনে হয় মজা করছেন। পরে বুঝলাম তিনি আসলে সিরিয়াসলিই বলছেন। আরও অবাক হয়ে দেখলাম, তিনি আমার সাথে কথা বলছেন, আর কোন ধরনের লজ্জা শরমের তোয়াক্কা না করে, ওপেন ঘুষ নিচ্ছেন। তার খাতা নিচে সমানে টাকা রাখছেন। খাতা বেশি উঁচু হয়ে গেলে, সেগুলো সরিয়ে, টেবিলের ড্রয়ারে রাখছেন। এই সাত সকালেই দেখলাম, তার ড্রয়ার টাকায় প্রায় ভরে গেছে। কত টাকা কামায় এরা। তার এসব কার্যকলাপ দেখে, আমি তার দিকে হা করে তাকিয়ে আছি। আমার এই অবস্থা দেখে সে বলল, সে ৫ তলা বাড়ীর কাজে হাত দিয়েছে। তাই টাকা খুব টানাটানি। তাকে সরি বলে, মন খারাপ করে চলে এলাম।

 

দিনগুলো খুবই খারাপ যাচ্ছিল। একটা মিটার বিক্রি করলে ৫০০ টাকা মত লাভ হত। একটা মিটার বিক্রি করলে, সেদিনের বাজারটা হয়ে যেত। ইনকামের আর কোন সোর্স নেই। যেদিন বিক্রি হত না, সেদিনটা খুবই খারাপ যেত। শুনেছি হাদিসে আছে, দারিদ্রতা কুফরির অন্যতম কারন। আমি এখন সেটা মনে প্রানে বিশ্বাস করি, সংসারের টেনশন, ইনকামের টেনশন এই ধরনের হাজারো টেনশনে, আস্তে আস্তে আমি বেশি বেশি দুনিয়ামুখী হতে লাগলাম, কাজের জন্য একে ওকে ধরতাম। সাহায্যের জন্য এর কাছে যেতাম ওর কাছে যেতাম। প্রায়ই খালি হাতে ফিরতে হত। নামাজ পরা ছেড়ে দিয়েছিলাম অনেক আগেই, শুধু জুম্মা পড়তে মসজিদে যেতাম। বলা যায়, খোদাকে ভুলেই গিয়েছিলাম। এভাবে কষ্টের প্রায় দুই বছর হতে চলল। হাজারো ঝামেলায় আমার দিশেহারা অবস্থা। অভাবের কারনে বাসাতেও অশান্তি লেগেই থাকত। এই রকম একদিন এক বিষণ্ণ সকালে, আমি শহরের কাচারিতে গিয়েছিলাম। পকেট পুরা খালি ছিল, বেশ কয়েক জনের সাথে আলাপ করলাম। কেউ মিটার নিতে আগ্রহ দেখালো না। সুযোগ বুঝে ফ্রিতে কয়েকজন ডায়াবেটিস টেস্ট করে নিল। কয়েকজন আমার সাথে মস্করাও করল। মনটাই খারাপ হয়ে গেল। বুঝলাম আজকে কপালে কোন বিক্রি নেই। দোতালায় গেলাম, সেখানেও একই অবস্থা, কেন যেন মনে হচ্ছিল সবাই আমাকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করছে। খুব খারাপ লাগল, হতাশা, রাগে দুঃখে মনটা খারাপ হয়ে গেল। ব্যাল্কনিতে দাঁড়িয়ে আমি কেঁদে ফেললাম। দুই চোখ দিয়ে অঝোরে পানি পড়তে লাগল। এভাবে কত দিন হয় কাদি না। আর ঠিক তখনই আমার মালিকের কথা মনে হল। মনে পড়ল, গত প্রায় দুই বছরে, আমি আসলে খোদাকে সেভাবে ডাকিনি, তার কাছে কিছুই চাইনি। চেয়েছি শুধু মানুষের কাছে। ওই অবস্থাতেই দাড়িয়ে দাঁড়িয়ে খোদার নিকট নালিশ দিতে লাগলাম। কেন আমার সাথে এমন হচ্ছে, কেন আমি এত ব্যার্থ , তুমি কি পারনা আমার সব সমস্যা মিটিয়ে দিতে? সত্যি বলতে সেদিন আমার মনে দুয়ার খুলে গেল, চোখ বন্ধ করে খোদার কাছে দোয়া করতে লাগলাম। দুই চোখ দিয়ে বাঁধ ভাঙ্গা জোয়ারের মত পানি পড়ছিল। নিজের অভাব অভিযোগ সব প্রভুর নিকট জানালাম।

 
এভাবে কতক্ষণ হয়ে গেল আমি জানি না। যখন হুশ ফিরে পেলাম তখন মনটা প্রশান্তিতে ভরে গেছে। এক মুহূর্তে সব দুঃখ কষ্ট উধাও হয়ে গেছে। আমি স্পষ্ট বুঝতে পারলাম, আল্লাহ্‌ আমার দোয়া কবুল করেছেন, আমার কষ্টের দিন শেষ হতে চলেছে। মনটা অনেক, অনেক হালকা হয়ে গেল। হাসি মুখে নিচে নেমে এলাম। কিছুক্ষণ আগের আমি আর এই আমির মধ্যে অনেক পার্থক্য! মোটরসাইকেল স্টার্ট দিলাম। সোজা বাসায় চলে এলাম। কয়েক দিনের মধ্যে আমার অনলাইনে কাজ পাওয়া শুরু হল। বলা যায় এক মুহূর্তে সব দুঃখ কষ্ট আল্লাহ্‌ দূর করে দিলেন। আপনাদের দোয়ায় গত ৬ বছর হল, আল্লাহর রহমতে কম হোক বেশি হোক আমার কাজ কখনো বন্ধ থাকেনি। তবে এখনো মাঝে মাঝে আমার সেই কষ্টের দিনগুলো মনে পড়লে সিউরে উঠি। মনটা খারাপ হয়ে যায়। খোদার নিকট দোয়া করি সেই খারাপ দিন গুলো যেন আর ফিরে না আসে। আপনাদের জন্য দোয়া করি, আমার জন্যও দোয়ার দরখাস্ত রিইল।
 

ঘটনা ৩ঃ

ছোট বেলা থেকেই যমজদের প্রতি আমার আলাদা একটা আকর্ষণ, আমার মনে হত এদের মন একই, শুধু দেহ দুইটা আলাদা। এটা আসলে একই মানুষ। স্রষ্টার অনুপম সৃষ্টির অন্যতম উদাহরণ এই যমজ। স্কুলে আমাদের উপরের ক্লাশে হবি, কবি নামে দুই যমজ ভাই ছিল। হুবহু এক চেহারা। আমি অবাক হয়ে এদের দেখতাম। কোন দিন ধরতে পারিনি, কোনটা কে। কারন তাঁদের পোশাক আশাক থেকে শুরু করে, চুলের স্টাইল সব ছিল এক। এমনকি কথা বার্তাও মোটামুটি এক ছিল। যমজ ছিল আমার কাছে এক অবাক পৃথিবী। আমার ছোট ভাইও ছিল যমজ, কিন্তু আফসোস তাঁদের জন্মের সময় দাই মহিলা, একজনের মাথা পুরাটা গালিয়ে ফেলে, মেরে ফেলে, আর আমার ভাইয়ের মাথাতেও প্রচণ্ড চাপ লাগে। ফলে সে আংশিক বুদ্ধি প্রতিবন্ধী। আমি এই দেশের রাজনীতি আর রাজনীতিবিদদের সব সময় অভিশাপ দেই। কারন আমার মতে সবার আগে এরা জাহান্নামে যাবে। দেশ ও জনগণের কি পরিমাণ ক্ষতি এরা করে, আমার মনে হয় এরা নিজেরাও জানে না। আমার ভাইদের জন্মের সময়, লাগাতার হরতাল চলছিল, ফলে আমার মাকে হাসপাতালে নিতে পারিনি। ঘরে নরমাল ডেলিভারি করাতে যেয়ে, আমার ভাইকে হারাতে হল। আর আরেক ভাইকে চিরদিনের জন্য, অন্যের উপর নির্ভরশীল হয়ে থাকতে হবে। এই অন্যায়ের বিচার আল্লাহর দরবারে দিয়ে রাখলাম।

 
আমার যমজের আশা পুরন না হলেও আশা ছাড়িনি, একবার কোন এক রচনা লেখায় লিখেছিলাম, আমার জমজ বাচ্চার খুব শখ। আপনারা হয়ত মনে করতে পারেন, আমি হয়ত এসব বানিয়ে বানিয়ে বলছি। চাইলে আমার ফেসুবকের আগের পোষ্ট দেখতে পারেন। আমি কয়েক বছর আগে, জমজদের ছবির কালেকশন দিয়ে পোষ্ট দিয়েছিলাম। আমাদের এক ছেলে আর এক মেয়ের জন্মের পর, জমজের আশা ছেড়েই দিলাম। কিন্তু মনে মনে আমার স্বপ্নটা রয়েই গিয়েছিল। প্রায়ই আমি দুই জমজ মেয়ে বাচ্চাকে কল্পনা করতাম। এটা এক ধরনের ফ্যান্টাসি বলা যায়। বাস্তবে পাইনি তাতে কি হয়েছে, কল্পনা করতেত দোষ নেই। এভাবেই চলছিল। পবিত্র হজ্জ পালনের সময় মা আবদার ধরল, হজ্জ উপলক্ষে তার আরও একটা নাতি চাই, যুক্তি হল আরেকটা ছেলে হলে, আমার মেয়েটাকে দুই ভাই মিলে দেখে রাখতে পারবে। আমি আর না করিনি। পবিত্র ক্বাবা ঘর তাওয়াফের সময়, প্রতিবার একটা নেক পুত্র সন্তানের জন্য দোয়া করেছি। আমার মা আবার মাঝে মাঝে জিজ্ঞেস করত, আসলেই আমি চাইছি কিনা। তবে সত্যি বলতে আমি একবারও মনে থেকে চাইনি।

হজ্জ শেষে বাড়িতে এলাম। আমরা চেষ্টা করতে লাগলাম। কিন্তু দিনের পর দিন, মাসের পর মাস পার হয়ে যায়। কোন সুখবর আসে না। ধরেই নিলাম কপালে কিছু নেই। নিঃসন্তান দম্পতিদের কষ্ট তখন কিছুটা বুঝতে পেলাম। অনেক অপেক্ষার পরে, অবশেষে আল্লাহ্‌ মুখ তুলে চাইলেন। আমার স্ত্রী সন্তান সম্ভবা হলেন। এটা তৃতীয় সিজার ছিল বলে, ব্যাপারটা বেশ ঝুকিপূর্ণ ছিল। কয়েক মাস পরে রুটীন চেকাপ হল এবং আমি জানতে পেলাম, আল্লাহ্‌ আমাদের যমজ সন্তান দান করছেন। যতটা না খুশি হয়েছিলাম, তার থেকে বেশি আতংকিত হলাম। কারন আমার স্ত্রী একেবারেই ছোটখাট গড়নের মানুষ, এর পরে যমজ বাচ্চা, এর পরে আবার তৃতীয় সিজার। ডাক্তার ম্যাডাম রিপোর্ট দেখে আমাকে রীতিমত ধুয়ে দিল, এই ধরনের বোকামি করার জন্য। আমি লজ্জায় মাথা নত করে রইলাম। ডাক্তার বলল মা সর্বচ্চ ঝুকির মধ্যে আছে। কোরআনে আছে আল্লাহ্‌ সর্বোত্তম পরিকল্পনাকারি, এটা যে কত বড় সত্য কথা, সেটা হাতে নাতে পেলাম। আমার স্ত্রীর ডেলিভারির কিছুদিন আগেই আমার Fiverr একাউন্ট ব্যান হয়ে গেল। আমি কয়েকমাসের জন্য পুরা বেকার হয়ে গেলাম। এখন বুঝি, এটা আসলে আল্লাহর পরিকল্পনা ছিল। কারন একাউন্ট চালু থাকলে, আমি কাজ নিয়ে প্রচন্ড ব্যাস্ত থাকতাম, ফলে আমি বাচ্চা এবং মায়ের প্রতি ঠিকমত খেয়াল দিতে পারতাম না। আল্লাহ্‌ যা করে ভালর জন্য করে। আমি আমার যমজ ভাইয়ের ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে, এই নিয়ত করলাম যে, আমি বাচ্চা এবং বাচ্চার মায়ের, চিকিৎসায় কোন কার্পণ্য করব না। আপনাদের দোয়ার আমি আমার ওয়াদা রক্ষা করতে পেরেছি। সব থেকে ভাল হাসপাতাল এবং ভাল ডাক্তারের ব্যবস্থা করতে পেরেছিলাম। এই জন্য আমি ফ্রিল্যান্সিং এর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই।

 

সবাই যেখানে খারাপ কিছুর আশংকা করছিল, সেখানে আপনাদের দোয়ায় আল্লাহর রহমতে, তেমন কোন রকম জটিলতা ছাড়াই, তারা দুনিয়াতে এল, এবং আমি অবাক হয়ে দেখলাম, আমার দুইজন মা, খোদার উপহার হিসাবে দুনিয়াতে এসেছে। এই আনন্দ আমি আসলে কোথায় রাখি। খোদা আমার মনের ইচ্ছা যে এভাবে পূরন করবে, তা কখনো ভাবিনি। আমি যখন আমার যমজ রাজকন্যাদের দিকে তাকাই, তখন বুঝতে পারি, আমি আসলে স্বপ্নে বা কল্পনায় এদেরকেই দেখতাম। আল্লাহর দরবারে লাখো কোটি শুকরিয়া যে, তিনি এই পাপি বান্দার মনের ইচ্ছা পূরন করেছেন, আমার দোয়া কবুল করেছেন। অনেকেই আমার যমজ রাজকন্যাদের ছবি দেখতে চায়, অনেকেই জিজ্ঞেস করে কেন ফেসবুকে আমি বাচ্চাদের ছবি শেয়ার করি না। আমার উত্তর হচ্ছে আমার পরিবার একান্ত আমার নিজের বিষয়। সোশ্যাল মিডিয়া হচ্ছে পাবলিক প্লেস। এখানে ঘরের কোন কিছু শেয়ার করা উচিৎ না। দুইটা আলাদা জিনিস, আলাদাই রাখা উচিৎ। তাই আমিও কখনোই আমার বাচ্চাদের ছবি ফেসবুকে শেয়ার দেই না। আর দেয়ার ইচ্ছাও নেই। আমিও আপনাদেরও এই উপদেশ দেই।

 
পরিশেষে এতটুকুই বলব যে, খোদার কাছে চাইতে হবে এবং চাওয়ার মত চাইতে হবে। তাহলে তিনি অবশ্যই দেবেন। খোদা আমাদেরকে দেয়ার জন্য বসে আছেন। শুধু চাইতে হবে। আর সব সময় শোকরগোজার থাকতে হবে। কেউ আল্লাহর নিয়ামত পেয়ে সেটার শোকর করলে আল্লাহ্‌ তার নিয়ামতকে আরও বাড়িয়ে দেন। আর কেউ যদি অহংকার করে বা শোকর না করে তবে তিনি সেটা কেড়ে নেয়। তাই আসুন সবাই আল্লাহর নেয়ামতের শোকরগোজার করি, তার দরবারে আমাদের নেক চাওয়াগুলো নির্ভয়ে চাই। তিনি নিশ্চয়ই আমাদের দোয়া কবুল করবেন।
সবাই ভাল থাকবেন।
ধন্যবাদ!

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *