ফ্রিলান্সারের প্লান B

 

আপনি যদি একজন ফ্রিলান্সার হন, মাসে যদি মোটামুটি নিদিষ্ট একটা ইনকাম করছেন, তবে বোঝা যায় আপনার প্লান A সফল হয়েছে। কারন ফ্রিলান্সিং এ সফল হওয়া ছিল আপনার প্লান A.  কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে আপনার প্লান B কি রেডি আছে? যদি থাকে খুবই ভাল কথা। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে আমাদের বেশিরভাগ ফ্রিলান্সারেরই কোন প্লান B নেই। কারন আমরা ধরেই নেই এভাবেই মনে হয় আমাদের বাকি জীবন চলতে থাকবে। আসলে এর থেকে ভুল ধারনা আর কিছু হতে পারে না। অনলাইন জগৎ প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হচ্ছে। যারা স্কিল ডেভেলপ করে তাল মিলাতে পারবে, একমাত্র তারাই টিকতে পারবে। বাকিরা ঝড়ে পড়ে যাবে। তাই আপনার প্লান B রেডি থাকতে হবে, যেন প্লান A যদি কোন কারনে ব্যর্থও হয়, তার পরেও যেন আপনি ভাল করে টিকে থাকতে পারেন।
 
অসংখ্য উদাহরণ দিতে পারি, একসময় অনেকেই খুবই সফল ফ্রিলান্সার ছিলেন, কিন্তু এখন তাঁরা বার্থ। ইনাকামের বিকল্প কোন সোর্স রেডি না করতে পেরে তাঁরা এখন সবার করুনা আর উপহাসের পাত্র। নাম না উল্লেখ করে কিছু বাস্তব উদাহরণ দেই
 
১. Elance মার্কেটপ্লসে কাজ করত একজন সফল ফ্রিলান্সার। হাতে গোনা কয়েকজন বায়ার দিয়ে খুবই ভাল কাজ করত। তার বড় একটা টিম ছিল। Elance, oDesk এর সাথে মিলে যাবার পর তার কাজে ধ্বস নামে। একে একে প্রায় সব বায়ার তার হাত ছাড়া হয়ে যায়। প্রায় ০৬ মাস তার কর্মীদের প্রায় বসিয়ে বসিয়ে বেতন দিয়ে, চালাতে না পেরে এক সময় সবাইকে বিদায় দিতে বাধ্য হয়। এখন সে নিজে নিজে কাজ করে, কোন মতে  টিকে আছে।
 
২. আমার পরিচিত একজন, Fiverr এ খুবই ভাল কাজ পাচ্ছিল। খুব সুন্দর একটা অফিসে প্রায় ১২ জনের একটা টিম নিয়ে কাজ করত। প্রায় ১০ লক্ষ টাকা দিয়ে শুধু অফিস ডেকারেশন করেছিল। বেশ কয়েকটা বিদেশি একাউন্ট ছিল VPN, প্রক্সি দিয়ে চলাত। দুঃখজনক ভাবে, একে একে সব ব্যান হয়ে যায়। এখন নামে মাত্র অফিসে থাকলেও, তার মূল ব্যাবসা হচ্ছে ফিলান্সিং টিউশনি, মানে মানুষের বাসায় যেয়ে ফ্রিলান্সিং শেখানো। টিকে থাকার জন্য আসলে সে এই ধান্দাবাজি করছে, অধঃপতন আর কাকে বলে! 
 
৩. কয়েকদিন আগের ঘটনা, একজনের সাথে কথা হচ্ছিল। সে শুধু ছবির ব্যাকগ্রাউন্ড রিমুভের কাজ করেই Upwork থেকে গত কয়েক বছর ধরে ভাল ইনকাম করছিল। এর বাহিরে সে কিছু জানে না, শেখার চেষ্টাও করেনি। কোন কারনে তার একাউন্ট সাসপেন্ড। এখন Fiverr এ এসেছে। অনেক চেষ্টা করেও কোন অর্ডার পাচ্ছে না। খুবই হতাশ।
 
৪. একজন ফ্রিলান্সার লোভে পড়ে, তার পুরো ইনকামের ৫৬ লক্ষ টাকা, শেয়ার বাজারে ইনভেস্ট করে প্রায় পুরটাই খুইয়েছে। যে কাজে ফ্রিন্সান্সিং করত তার চাহিদা কমে গেছে, আর সে নিজেকে আপডেট করতে পারেনি। এখন চাকরীর জন্য বিভিন্ন অফিসে ট্রাই করছে।
 
৫. বছর তিনেক আগে একজন ফ্রিলান্সার , গ্রুপে ইনকামের স্ক্রিনশট দিয়েছিল সেটা তার এক মাসের ইনকাম ১ হাজার ডলারের স্কিনশট ছিল! পোষ্টের হেডিং ছিল পারলে ঠেকা! আসলে তাকে ঠেকানোর কোন সুযোগই এখন নেই, কারন সেই লোকে এখন ফ্রিলান্সিংই করে না 😀
 
৬. আমার পরিচিত এক ছোট ভাই কাজ করতে করতে অসুস্থ হয়ে পড়ল। হঠাৎ একদিন তার ব্রেন স্ট্রোক করল। প্রায় ০৭ দিন হাসপাতালে ভর্তি থেকে এবং মাস ছয় বেড রেস্টে থেকে এখন কিছুটা সুস্থ। ফ্রিলান্সিং তার মাথায় উঠেছে 🙁
 
আসলে লিখতে গেলে এই রকম গল্প অনেক বলা যাবে। তাই আর লিখছি না, সবাইকে বলব সময় থাকতে সাবধান হোন। আপনার প্লান B রেডি করে ফেলেন। কোন কারনে যদি আপনার একাউন্ট চলে যায়, বা ইনকামের সোর্স নষ্ট হয়ে যায়, তার পরেও যেন ভাল করে টিকে থাকতে পারেন। টিকে থাকার জন্য আপনি কি কি করতে পারেন সেই ব্যাপারে আমার কিছু মতামত দিচ্ছি। আপনার কোন আইডিয়া থাকলে কমেন্টে দিতে পারেন।
 
১. আপনার প্রথম ইনকাম চালু হবার সাথে সাথে ব্যাংকে একটা DPS খুলে ফেলেন সামর্থ্য অনুযায়ী। বিশ্বাস করেন,এটা একসময় আপনার বিপদের বন্ধু হিসেবে কাজে দেবে।
 
২. আপনি যে কাজ করেন সেটা আপনার খুব ঘনিস্ট কেউ, যেমন ভাই, বোন, স্ত্রীকে মোটামুটি শিখিয়ে দেন। যেন আপনার অবর্তমানে সে চালিয়ে নিতে পারে। ব্যাক্তিগত কারনে আমার একাউণ্ট প্রায় দেড় মাস বন্ধ রেখেছিলাম। তাখন এটা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি।
 
৩. চীনাদের মত মাসিক সঞ্চয় করুন। তাদের নীতি হচ্ছে আগে সঞ্চয় করতে হবে। এর পরে যদি কিছু বাচে, তবে সেটা খরচ করতে হবে। আমরা করি উল্টা, খরচের পর যদি কিছু থাকে তবে সঞ্চয় করি। এটা উচিৎ না। ব্যাংকে কত টাকা জমাবেন সেটা টার্গেট করেন। সেটা অর্জন না করা পর্যন্ত লেগে থাকেন।
 
৪. ইনকামের আরেকটা সোর্স চালু করেন। Fiverr পাশাপাশি অন্য মারকেটপ্লেস ট্রাই করেন। যেন Fiverr এর প্রফাইল চলে গেলেও টিকতে পারেন।
 
৫.রেগুলার পারমানেন্ট বায়ার তৈরি করেন। একসময় হয়ত আর মার্কেটপ্লেসে কাজ নাও করা লাগতে পারে।
 
৬. জমিতে বিনিয়োগ করেন। জমির বিনিয়োগ লাভজনক। হতে মোটামুটি টাকা হলেই জমি কিনে রেখে দেবেন। আমার পরিচিত যারা এইধরনের বিনিয়োগ করেছেন তাঁরা প্রায় সবাই লাভবান হয়েছেন। শহরে থাকলে ফ্লাটে বিনিয়োগ করতে পারেন। এটাও লাভজনক।
 
৭. কৃষিতে বিনিয়োগ করতে পারেন। এটা এখন খুবই লাভজনক ব্যাবসা। ফিশারিজ, পোল্ট্রি এখন অনেক লাভ জনক। ইকমার্স এর ব্যাবসাও ভাল করছে। সামনে ঈদ, এটা নিয়ে এগুতে পারেন। ভাল লাভ থাকবে।
 
৮.ভুলেও শেয়ার বাজার বা কোন MLM ব্যাবসায় যাবেন না, এমনকি পরিচিত কেউ যদি এসব ব্যাবসা করে তবে তার থেকে ১০০ হাত দূরে থাকুন। কারন আর নাইবা বললাম 🙂
 
৯. আপনি যে সার্ভিস দেন সেটার উপর একটা সার্ভিস সাইট করে রাখেন। একদিন এটা আপনার সম্পদে পরিণত হবে।
 
১০. রেন্ট এ কারে বিনিয়োগ করতে পারেন। ভাল লোক পেলে আপনার ইনভেস্ট লাভ সহ উঠে আসবে। নিজের কাছের কেউ ভাল ড্রাইভিং জানলে এটা নিয়ে এগোতে পারেন।
 
১১. ডিলারশিপের ব্যাবসা করতে পারেন। ভাল কোম্পানির ডিলারশিপ অনেক নিরাপদ ব্যাবসা।
 
আমি বলব, নিজেকে নিজেই মোটিভেট করেন। নিদিষ্ট একটা সময় নির্ধারণ করেন যে, এই সময়ের মধ্যে আপনি কি কি অর্জন করবেন। সেটা কাগজে লিখে ফেলেন, সেগুলো অর্জন করার চেষ্টা করেন। প্রতিটা অর্জনে নিজেকে পুরস্কৃত করেন। এই ব্যাপারে আরও ভাল আইডিয়া পেতে চাইলে, আপনার কাছের কেউ যদি ব্যাংকে চাকরী করে, তবে তার পরামর্শ নিতে পারেন। কারন বৈষয়িক ব্যাপারে আমার মতে, তাদের মত ভাল কেউ জানে না। দেখবেন বেশির ভাগ ব্যাংকার বয়স ৪০ হবার আগেই তার জীবন গুছিয়ে ফেলে, ভবিষ্যতে কি কি করবে সব কিছু তার কাছে ফিলিপস বাত্তির মত পরিস্কার 🙂 তাদের থেকে অনেক ভাল ভাল পরামর্শ পাবেন।
 
অনেক ইয়াং ফ্রিলান্সার আছে অল্প বয়সে ভাল ইনকাম করে, সেই টাকার চূড়ান্ত অপচয় করে। অনেকেই দামি মোটরবাইক কিনে ফেসবুকে পোষ্ট দিয়ে শো অফ করে। আইফোন, মাকবুক কিনে টাকার শ্রাদ্ধ করে! (যদি কাজের খাতিরে দরকার হয় তবে সেটা ভিন্ন কথা) টাকা আজে বাজে কাজে খরচ করে। এসব করা উচিৎ না। টাকা সঞ্চয় করা শেখা উচিৎ।
 
আমাদের দেশে অধিকাংশই ৪০ বছর পার হবার পর পরই জীবনের হিসেব মেলানো শুরু করে দেয়। কি চাইলাম আর কি পেলাম, এসব বলে হা হুতাশ করতে থাকে 🙁 তাই জীবনে যেন হা হুতাশ না করতে হয়, এই জন্য যা কিছু করার ৪০ এর আগেই করে ফেলা উচিৎ। এর পরে আপনার অর্জনগুলো শুধু উপভোগ করবেন। অনেকে মনে করতে পারেন ৪০ আসতে অনেক বাকি। ঠিক আছে আপনি ৩০ এর মধ্যেই সব কিছু করে ফেলেন। আপনাকে কে ঠেকাচ্ছে 🙂
 
একটা সাফল্যের গল্প দিয়ে লেখা শেষ করব। সেদিন কোন এক গ্রুপে একজনের ফ্রিলান্সারের পোষ্ট দেখলাম। সে আগামী আড়াই বছরের জন্য বিশ্ব ভ্রমনে বের হচ্ছে। ভ্রমনের প্লান রেডি। মানে আগামী আড়াই বছর সে বিশ্বের সম্ভব সব যায়গা ভ্রমন করবে। কারন সে এই ইয়াং বায়সেই সবকিছু সুন্দর ভাবে গুছিয়ে নিয়েছে। একটু চোখ বন্ধ করে তার যায়গায় নিজেকে কল্পনা করেন। দেখেন কেমন লাগে 🙂
 
তাই বলব হাতে এখনো সময় আছে। আপনার প্লান B রেডি করে ফেলেন।
 
ধন্যবাদ!

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *