নির্বাচনের হাওয়া
গ্রামে এখন নির্বাচনের হওয়া, মানে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন। দেখতে বেশ ভালই লাগে, একটা উৎসব মুখর পরিবেশ। আগে যখন ছোট ছিলাম, নির্বাচন মানে বিশেষ কিছু ছিল। একটা আনন্দ মুখর পরিবেশ হত। সবাই ভোট দিতে যাবে , অনেকেই ছুটি নিয়ে বাড়িতে আসত শুধু ভোট দেয়ার জন্য, একটা ঈদ ঈদ ভাব। এখনত তেমন কষ্ট করা লাগে না। ভোট না দিলেও এমনিতেই অনেক কিছু হয়ে যায়। যা হোক অন্য দিকে যেতে চাই না। আমি আবার একটু ভীরু প্রকৃতির লোক 🙁
গ্রামের ছোট বাজারে গেলাম, কি যেন একটা কাজে। গ্রামের পরিচিত একজনের সাথে দেখা। ভ্যান চালায়, বউয়ের সাথে ঝগড়া করে ভ্যান নাকি বিক্রি করে দিয়েছে। তবে চিন্তা নেই। এখন ধান কাটার মৌসুম। ধান কেটে দিনে কমপক্ষে দেড় হাজার টাকা ইনকাম হবে। আমাকে জিজ্ঞাস করল, এলাকার ভোটার কিনা? আমার হ্যা সুচক জবাবের সাথে সাথে, আমাকে অনেক খতির করে চায়ের দোকানে বসাল। চায়ের অর্ডার করল। আরও কিছু খাব কিনা জিজ্ঞাস করল। আমার ছোট ছেলেটাকেও জোর করে চা খাওয়াতে চাইল। বললাম সে চা খায় না। তাতেও মানে না, জোর করে চা খাওয়াবেই। বাধ্য হয়ে, তার শরীর খারাপ, এই অজুহাত দিয়ে তাকে বিরত করলাম।
এর পর শুরু হল গল্প। একটা পোষ্টার দেখাল, পোষ্টারে গোঁফওয়ালা ভোলাভালা চেহারার এক লোক। এক রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। বেচার নাকি মেম্বার পদে দাঁড়িয়েছে। বলল, গত নির্বাচনে দাড়িয়ে ফেল করে, সে নাকি একেবারে নিঃস্ব হয়ে গেছে 🙁 এইবার শেষ সম্বলটুকু বিক্রি করে নির্বাচনে দাঁড়িয়েছে। এবার যদি না জিততে পারে, তবে তাকে নাকি ঢাকায় যেয়ে কাজ করে খেতে হবে। এখন তাকে এলাকায় রাখতে হলে আমার ভোটের কোন বিকল্প নাই। ভোটে জিতলে তার অবস্থা আবার ফিরবে। আসলে গ্রামে চেয়ারম্যান, মেম্বার নির্বাচন করা মানে হচ্ছে, কে, কিভাবে, তার আখের গোছাবে এসবের হিসাব নিকাশ। এখানে এলাকার উন্নয়ন, সমাজ সেবা একেবারেই গৌণ। কি বুঝলেন?
চা টা প্রায় শেষ করে এসেছিলাম।এরা খাঁটি গরুর দুধের ভাল চা বানায়। জিতলে তার অবস্থা আবার ফিরবে, এই কথা শোনার পর মনে হল কেউ যেন মুখে চিরতা ঢেলে দিয়েছে। চিরতা কি জিনিস, স্বাদ কেমন? না জনলে গুগল করেন 😀 আমি বিল দিতে চাইলাম। নিল না, বলল এটা নির্বাচনের চা, টাকা দিলেও দোকানদার টাকা নেবে না। শেষমেশ আমিও এই ফাও চা খাওয়ার দলে নাম লেখালাম। সে চাপাচাপি শুরু করে দিল। ভোট এই লোককেই দিতে হবে, বলা যায় পিস্তল ধরে বাধ্য করার মত! অনেকদিন শহরে থাকার পর বাধ্য হয়ে, গ্রামে নতুন করে থাকছি। গ্রামের প্রায় কাউকেই চিনি না। কেউ আমাকে পাত্তাও দেয় না। আমি যেন মশা মাছি, কখন আসি কখন যাই কেউ খেয়ালই করে না। কিন্তু এই টাউট প্রকৃতির লোক আমাকে পাত্তা দিচ্ছে। যদিও নিজের স্বার্থে করছে, কিন্তু তার পরেও, লোকটার প্রতি একটা টান অনুভব করলাম। কথা দিলাম তার প্রার্থীকেই ভোট দেব!
আগে গল্প শুনতাম “আজিমপুরি চায়ের”। যারা জানেন না, তাদের বলছি অনেক আগে গ্রামে এই চায়ের অনেক ডিমান্ড ছিল। এটা মুলত গ্রেড ১০ এর নিম্ন মানের চা। মুলত লাশ সংরক্ষণের জন্য বরফের সাথে দেয়া হয়। মনে হয় আজিমপুর গোরস্থানের সাথে নাম মিলিয়ে এই নাম করা হয়েছে। গ্রামের মেম্বার, চেয়ারম্যান প্রার্থীরা ঢাকা থেকে এই চা সস্তায় কিনে আনত। চিনি বা গুড় দিয়ে জাল করে ভোটারদের বড় গ্লাসে চা খাওয়াত। গ্রামের লোকজন সেই চা খেয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে প্রার্থীকে ভোট দিত। মনে হল আমি সেই আজিমপুরি চা মাত্র খেলাম 🙁
এখন দিন বদলেছে। গ্রামের সেই সহজ সরল মানুষেরা এখন জাদুঘরে। গ্রামের মানুষ এখন কি পরিমান চালাক, সেটা দেখতে হলে আপনাকে গ্রামে কিছুদিন থাকতে হবে। সেই আজিমপুরি চা আর নেই। এখন খাঁটি গরুর দুধের চা তেও কাজ হয় না। নগদ ছাড়া কোন কথা নেই। তাও একজনের কাছ থেকে নিলে হত। কত জনের কাছ থেকে নেয় তার ঠিক নাই। কারন ভোটাররাও জানে নির্বাচনের পর তার আর কোন দাম নেই। তাই যত পারো নগদ নিয়ে নাও 😀
পুনশ্চঃ পরে জানলাম, বেচারা ভ্যান বিক্রি করেছে, কারন নির্বাচনে যেন, ঠিকমত সময় দিতে পারে। সে প্রার্থীর দালাল। প্রার্থীর কাছ থেকে ধান্দা করে, যে টাকা এই কয় দিনে ইনকাম করবে , তা দিয়ে আরও অনেকগুলো ভ্যান কিনতে পারবে। বড়ই ধূর্ত এরা। ভাবছি পোস্টারের ওই লোককেই ভোট দেব। বেচারাকে যে এলাকায় রাখতে হবে। কি বলেন আপনারা?