রাজার মোরগের প্রশিক্ষণ আর ফ্রিল্যন্সিং এ আর দক্ষতা অর্জন
এক দেশে ছিল এক রাজা। সেই দেশের জাতীয় খেলা ছিল মোরগের লড়াই। মানে মোরগকে প্রশিক্ষণ দেয়া হত লড়াইয়ের জন্য। রিংয়ের মধ্যে দুইটি মোরগকে ছেড়ে দেয়া হত। তারা প্রাণপণে একজনের উপর আরেকজন আক্রমণ করত। সব শেষে একজন জয় লাভ করত। দেশের আনাচে কানাচে প্রচুর প্রতিযোগিতা হত এই মোরগ লড়াই নিয়ে। রীতিমত জমজমাট অবস্থা, ভাল লড়াকু মোরগ আকাশ ছোঁয়া দামে বিক্রি হত, আর মোরগকে প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্য প্রশিক্ষকের চাহিদাও ছিল আকাশচুম্বী।
রাজার পৃষ্ঠপোষকতায় প্রতি বছর, জাতীয়ভাবে বিরাট এক মোরগ লড়াই প্রতিযোগিতা হত। রাজ্যের বিভিন্ন যায়গা থেকে, এমন কি বিদেশ থেকেও অনেকে এতে অংশগ্রহণ করত। চূড়ান্ত ভাবে যে মোরগ বিজয়ী হত, তার মালিককে পুরষ্কার হিসেবে প্রচুর জমি জমা, সোনা দানা সহ মূল্যবান সামগ্রী দেয়া হত। আর আসল কথাত বলাই হয়নি, যেটা শুনলে আপনদেরও মোরগ লড়াইয়ের আগ্রহ জন্মাবে 😉 আর সেটা হচ্ছে বিজয়ীকে রাজ্যের সব থেকে সুন্দরি মেয়ের সাথে বিয়ে দেয়া হত। ফলে এই মোরগ লড়াই নিয়ে মাতামাতি কেমন হত সেটা বুঝতেই পারছেন। অনেকটা আমাদের দেশের ফ্রিল্যান্সিং নিয়ে বর্তমানে যে মাতামাতি হচ্ছে এই রকম আরকি 🙂
এই মাতামাতি দেখে রাজারও খুব ইচ্ছা হল এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করার। এর আগ পর্যন্ত রাজা কখনো মোরগ লড়াইয়ে অংশগ্রহণ করেনি। যারা মোরগকে প্রশিক্ষণ দিত তাদেরকে মাস্টার বলা হত! রাজ্যের সব থেকে অভিজ্ঞ মাষ্টারকে খুঁজে বের করা হল। যিনি এর আগে অনেকগুলো চাম্পিয়ান মোরগকে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। তার পরামর্শে অনেক খুঁজে, যাচাই বাছাই করে, খুব ভাল জাতের একটা লড়াইয়ের মোরগ খুঁজে বের করা হল। এবার প্রশিক্ষণের পালা। রাজা জিজ্ঞেস করলেন এই মোরগকে চ্যাম্পিয়ন মোরগ বানাতে আপনার কতদিন লাগবে? উত্তরে মাস্টার বললেন ছয় মাস লাগবে! রাজা বললেন আচ্ছা ঠিক আছে ছয় মাস সময় দেয়া হল।
দুই মাস পর রাজা মাষ্টারকে ডেকে পাঠালেন, প্রশিক্ষণের অগ্রগতি জানার জন্য! মাষ্টার বলল রাজামশাই প্রশিক্ষণ ভালই চলছে, তবে আরও সময় লাগবে। কি রকম? উত্তরে মাষ্টার বলল, রাজামশাই, তাকে এখন রিং এর মধ্যে ছেড়ে দিলে, সে অন্য মোরগের উপর সাথে সাথেই ঝাপিয়ে পড়তে চায়। তকে ধরে রাখা খুবই কঠিন। মনে হয় সে প্রতিপক্ষকে ছিঁড়ে ফেড়ে ফেলবে। রাজা বললেন আচ্ছা ঠিক আছে আরও সময় নিন।
আরও দুই মাস পর রাজা আবার মাষ্টারকে ডেকে পাঠালেন। প্রশিক্ষণের কি অবস্থা জানার জন্য। উত্তের মাষ্টার বলল, প্রশিক্ষণ খুবই ভাল চলছে, তার অনেক উন্নতি হয়েছে, তবে তার আরও প্রশিক্ষণ দরকার। কি রকম? উত্তের মাষ্টার বলল তাকে রিংয়ে ছেড়ে দিলে আগের মত উত্তেজিত হয় না বটে তবে প্রতিপক্ষকে দেখলে মাঝে মাঝে প্রচণ্ড রেগে যায়, আর না বুঝেই আক্রমন করতে যায়। রাজা বললেন ঠিক আছে আরও সময় দেয়া হল।
ঠিক ছয় মাসের মাথায় রাজা আবার মাষ্টারকে ডেকে পাঠালেন কি অবস্থা সেটা জানার জন্য! উত্তরে মাষ্টার বলল, রাজা মশাই তার প্রশিক্ষণ সম্পন্ন হয়েছে। সে এখন চ্যাম্পিয়ন হবার জন্য পুরাপুরি প্রস্তুত। রাজা বললেন কি রকম? মাষ্টার বললেন, তাকে এখন রিংয়ের মধ্যে ছেড়ে দিলে সে কিছুই করে না। চোখ বন্ধ করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। প্রতিপক্ষ রিংয়ের মধ্যে ঢুকলে সে ঘাড় আস্তে করে কাত করে, এর পর তার এক চোখ সামান্য খুলে প্রতিপক্ষের দিকে আড় চোখে তাকায়। তার চাহনি দেখেই প্রতিপক্ষ যা বোঝার বুঝে ফেলে। ফলে ভয়েতে তারা লেজ গুটিয়ে রিং ছেড়ে পালিয়ে যেতে চায়। তার খুব একটা লড়াই করতে হয় না। এটা শুনে রাজা খুব খুশি হলেন। মোরগকে প্রতিযোগিতায় পাঠালেন। মোরগ এক রকম হেসে খেলেই চ্যাম্পিয়ন হয়ে গেল।
আসলে এই গল্পের মত ঠিকমত প্রশিক্ষণ পেয়ে দক্ষ হলে, কোন কঠিন কাজই আর কঠিন থাকে না, সেটা পানির মত সহজ হয়ে যায়। একই কথা আমাদের ফ্রিল্যন্সিং এর ক্ষেত্রেও খাটে। আসলে প্রশিক্ষণ যত কঠিন হয় যুদ্ধ তত সহজ হয়! নিদিষ্ট বিষয়ে ভাল করে কাজ শিখে চূড়ান্ত ভাবে দক্ষ হয়ে ফ্রিলান্সিংয়ে যদি আসেন, তবে দেখবেন যত কঠিন কাজই হোক না কেন, সেটা আড় চোখে একবার দেখবেন, আর হালকা মুচকি একটা হাসি দেবেন। মনে মনে বলবেন এটা কোন কাজ হল নাকি বায়ার আপনার সাথে সামান্য কথা বলে, যা বোঝার বুঝে নেবে। কাজ আপনিই পাবেন। বায়ার খালি জিজ্ঞেস করবে কত ডলার হলে কাজটি করবেন? ফলাফল ডলারের বৃষ্টি, গাড়ি, বাড়ী আর সুন্দরী নারী (আমার পরিচিত বড় বড় ফ্রিলনান্সারদের বেশীর ভাগেরই বউ খুবই সুন্দরী )। কিন্তু আফসোস আমাদের অধিকাংশের ক্ষেত্রে এমন হয় না। কোন রকম একটু শিখেই মার্কেটপ্লেসে চলে আসি। পরে সফল না হতে পেরে আফসোস করি। সব কিছুর চৌদ্দগুষ্ঠি উদ্ধার করি, দোষারোপ করি। মানে নাচতে না জানলে উঠান বাঁকা আরকি 🙁
আমার মতে আমাদের দেশে একজন ফ্রিল্যন্সার ফ্রিল্যন্সিং করতে যেয়ে তিনটা স্তর পার করে
১। ফ্রিল্যন্সার যখন প্রথম স্তরে প্রবেশ করে, তখন সে খুব অহংকারী হয়ে উঠে। কয়েকটা কাজ কমপ্লিট করেই মনে করে সে সব কিছু জেনে ফেলেছে, দুনিয়া জয় করে ফেলেছে। পুরাতন অভিজ্ঞ ফ্রিল্যন্সারদের তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে। বিভিন্ন গ্রুপে ইনকামের স্ক্রিনশট দিয়ে বেড়ায়। সবাইকে ফ্রি উপদেশ আর পরামর্শ দিয়ে বেড়ায়।
২। দ্বিতীয় স্তরে প্রবেশ করার পর সে বিনয়ী হয়।
৩। আর তৃতীয় স্তরে প্রবেশ করার পর সে তার অজ্ঞতা উপলব্ধি করতে পারে। সে যে আসলে কিছুই জানেনা সেটা সে বুঝতে পারে। নিজেকে অনেক ছোট মনে করা শুরু করে, তার আগের কাজের জন্য সে লজ্জিত হয়। ভাল করে কাজ না শেখার জন্য সে খুব আফসোস করে। তার ইচ্ছে হয় সব কিছু ছেড়ে ছুড়ে দিয়ে, আবার ভাল করে কাজ শেখা শুরু করার।
জানিনা আপনাদের কার কি অবস্থা! আফসোস লাগে এতদিন পর আমি মাত্র তৃতীয় স্তরে প্রবেশ করেছি 🙁
সবাই ভাল থাকবেন।
ধন্যবাদ!