৭১ এর নেড়ি কুকুরদের গল্প
আগের কোন একটা লেখায় হয়ত বলেছিলাম আমি মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তান। আমার নানার পুরো পরিবার মুক্তিযুদ্ধের সাথে জড়িত ছিল। আমার দুই মামা যুদ্ধাহত মুক্তিযুদ্ধা ছিলেন। আর নানা যুদ্ধরত অবস্থায় ধরা পড়ে বন্দী হয়ে পাক বাহিনীর হাতে দীর্ঘদিন নির্যাতনের স্বীকার হয়েছিলেন। তাকে মেরে ফেলার আগ মুহূর্তে সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যান। আমার পুরা শৈশবকাল মায়ের মুখে ৭১ এর যুদ্ধের গল্প শুনে কেটেছে। তিনিও মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার আনা নেওয়া সহ বিভিন্ন কাজে সক্রিয় ছিলেন। তাই মুক্তিযুদ্ধ আমার কাছে অনেক বেশি বাস্তব!
আমার আজকের গল্প অন্য বিষয় নিয়ে। নেড়ি কুকুর আমরা সবাই চিনি। রাস্তার ধারে বেড়ে ওঠা অপুষ্ট সেই কুকুরগুলো! কোন এক লেখকের লেখায় পড়েছিলাম এরা রাস্তায় জন্মে, রাস্তায় সংসার পাতে, রাস্তাতেই মিলিত হয়, বাচ্চা উৎপাদন করে। এক সময় রাস্তাতেই মরে যায়। এদের কোন খোজ কেউ রাখে না। এদের মারলেও প্রতিবাদ করে না। কেউঃ কেউঃ আওয়াজ করে শুধু কাঁদতেই পারে। না খেতে পেরে কঙ্কালসার দেহ নিয়ে, আমাদের করুনার পাত্র হয়ে পথে পথে ঘুরে বেড়ায়। সমাজে এদের তেমন কোন অবদান নেই। কেউ কোন খবর রাখে না। বেচারাদের জন্য মায়া হয় 🙁 একজন আমাকে উপদেশ দিয়ে বলেছিল আমরা অনেকেই এই নেড়ি কুকুরদের মতই জীবন যাপন করি। কবে বিয়ে করলাম, কবে বাচ্চাকাচ্চা হল আর কবেইবা মারা গেলাম কেউ খবর রাখে না। মানুষ হতে হবে, মানুষের মত বাঁচতে হবে। তার কথায় যুক্তি আছে বৈকি 🙂
কিন্তু ৭১ সালে এই নেড়ি কুকুরদের গল্প ছিল ভিন্ন। যুদ্ধ পুরাদমে চলছে, চারিদিকে মানুষ মাড়া পড়ছে।মাঠে ঘাটে, খাল বিলে শুধু লাশ আর লাশ! সেই বছর বৃষ্টিও হয়েছিল প্রচুর! নদীর ধারে ভাটার সময়, কেউ বসে থাকলে ঘণ্টায় কয়েকশ লাশ গোনা কোন ব্যাপারই ছিল না। কথায় আছে কারো পৌষ মাস কারো সর্বনাশ! ৭১ আমাদের জন্য অবর্ণনীয় কষ্ট আর বেদনা নিয়ে এলেও, কারো কারো জন্য ছিল পৌষমাস। রাস্তার এই নেড়ি কুকুরদের জন্য যুদ্ধ নিয়ে এল অপার সম্ভবনা। যে কুকুরগুলো দিনের পর দিন খেতে পেত না। সেই তাদের জন্যই তখন খাবারের কোন অভাব নেই। চারিদিকে শুধু লাশ আর লাশ। মনের আনন্দে তারা লাশ খেতে লাগল! হাড় জিরজিরে নেড়ি কুকুরগুলো কিছু দিনের মধ্যেই হৃষ্টপুষ্ট হয়ে গেল। ভয়ংকর তাদের চাহনি। রাতের বেলা তাদের চোখ আক্ষরিক অর্থেই জ্বল জ্বল করত। মানুষের মাংসের স্বাদ পেয়ে তারা আরও হিংস্র হয়ে উঠল। মানুষ দেখলেই তেড়ে আসত। একা পেলেত কথাই নেই। পাক হানাদার, আর তাদের দোসর রজাকার আলবদরের পাশাপাশী এরা ছিল মূর্তিমান আতংক! ওরা এইসব কুকুরদের মারত না। কেন মারত না, কারন সহজেই বুঝা যায়।
মরা মানুষ খেয়ে খেয়ে নেড়ি কুকুরগুলোর অরুচি ধরে গেল। জীবিত মানুষ দেখলেই তেড়ে আসত। গোলাগুলিতে আহত হয়ে কেউ পড়ে থাকলে কোন কথাই নেই, দল বেঁধে তারা হায়েনার মত ঝাপিয়ে পড়ত। পুরা ৭১ সাল এমন কি তার পরবর্তী বেশ কিছুদিন এই হিংস্র নেড়ি কুকুরগুলো ছিল মূর্তিমান আতংক। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে! ৭১ এর নেড়ি কুকুরদের গল্প এখানেই শেষ! দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে অনেক দিন হল। সেই ভয়ংকর নেড়ি কুকুর আর নেই। কিন্তু ইদানিং তারা আবার ফেরত আসতে শুরু করেছে, কিন্তু কুকুরের রূপে না সাক্ষাৎ মানুষের রূপে। কয়েক বছর আগেও যারা ছিল সবার করুনার পাত্র, যাদের আমরা গোনায় ধরতাম না। এখন তারা হিংস্র নেকড়ে >:( কোন আইনই তাদের জন্য আইন না। মনে আছে কিছুদিন আগে চালক শ্রমিকদের অবরোধ চলছিল। কিন্তু আমাকে চিকিৎসার জন্য দ্রুত ঢাকা যেতেই হবে। তাই অবরোধের মধ্যেই বের হয়ে পড়লাম! কপাল খারাপ গাড়ি রস্তায় আটকে দিল। এক বাচ্চা ছেলে গাড়ির জানালার কাছে এসে গালি দিয়ে মুখ খারাপ করে বলল, গাড়ি থামাবি নাকি গাড়ী জ্বালায় দেব >:( গাড়ি সবাই মুখ বুজে সহ্য করলাম। কিছু করার নেই। আরেকজন এসে আলকাতরা নিয়ে হুমকি দিল, এক কদম বাড়ালে মুখে আলকাতরা মাখিয়ে দেব 🙁
আমি যেহেতু রোগী সবাই আমাকে ধরল, বলল শ্রমিক নেতার কাছে যান। রিকয়েস্ট করলে হয়ত গাড়ি ছেড়ে দেবে। বাধ্য হয়ে আমি তার কাছে গেলাম। বুকে প্রচণ্ড ব্যাথা করছিল, শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। তাকে রিকয়েস্ট করলাম গাড়ি ছেড়ে দিতে। বললাম আমি খুব অসুস্থ, দ্রুত ঢাকায় যেতে হবে! তার উত্তর হচ্ছে আপনার মরা দিয়ে আমাদের কোন যায় আসে না। গত দুইদিন গাড়ি চালাতে না পেরে আমরা না খেয়ে মরছি। আমাদের বাঁচা আগে। কিসের ভিতর কি >:( এই মূর্খ তথাকথিত নেতাকে কি করে বোঝাই। সে বলল এখানে উপস্থিত সবার কাছে যান। সবাই যদি বলে তবে গাড়ি ছেড়ে দেব। তাকিয়ে দেখলাম ২০/২৫ জন চালক, শ্রমিক উপস্থিত! সবাই আমাকে দেখে হাসছে, মজা নিচ্ছে। কিছুই করার নেই। রাস্তার পাশে অসহায়ের মত দাড়িয়ে রইলাম। চোখ কিছুটা আদ্র হয়ে পড়ল। কি দেশে বাস করি, দেশে কি কোন আইন নেই, কিছু বলার নেই 🙁 এই রকম গল্প আরও অনেক, অনেক বলা যাবে!
এই রকম মানুষরূপী হিংস্র নেড়ি কুকুর এখন আমাদের চারিপাশে প্রচুর পরিমানে! আমাদের কষ্টের টাকায়, কষ্টের সম্পদে এরা ফুলেফেপে হাড় জিরজিরে নেড়ি কুকুর থেকে এখন হিংস্র হায়েনায় রুপান্তরিত হয়েছে। কোন কিছুই তাদের জন্য বাঁধা না, কোন আইনই তাদের জন্য প্রযোজ্য না। এদের থেকে নিস্তারের কোন উপায় দেখছি না। ৭১ সালে এদেশের মানুষ মনে করেছিল এই যুদ্ধ শেষ হবার নয়। কিন্তু ঠিকই যুদ্ধ শেষ হয়েছিল, স্বাধীনতার সূর্য উকি দিয়েছিল। তাই আমি হতাশ হই না, আশা করি একদিন সমাজের এই অবস্থার উন্নতি হবে। আমরা হয়ত দেখে যেতে পারব না। কিন্তু আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম হয়ত দেখবে। সেই দিনের আশায় রইলাম।
ধন্যবাদ!