ভালবাসা দিবসে কিছু মন খারাপ করার ভালবাসার গল্প
আমি ভালবাসা দিবসে বিশ্বাসী নই। তাপরেও লিখছি। কারন কলম ধরার জন্যও একটা উপলক্ষ লাগে। এখনকার দিনে ভালবাসা নিয়ে যেটা হয় সেটা নোংরামি ছাড়া কিছু না। বর্তমান জেনারেশন প্রকৃত ভালবাসা কি সেটাই জানে না। আজকে আমার কিছু ভাললাগার গল্প সবার সাথে শেয়ার করব। তবে সবার মন খারাপ হবে এটা আগেই জানিয়ে রাখি। তাহলে শুরু করা যাক।
বেশ কিছু দিন আগে ঢাকা ভার্সিটির সাবেক ভিসি ডঃ মনিরুজ্জামান মিয়াঁ মারা গেছেন। তিনি চিরকুমার এবং অত্যন্ত ভাল একজন মানুষ ছিলেন। বিএনপি ঘরানার বুদ্ধিজীবী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। যে দলের জন্য তিনি অনেক ত্যাগ করেছেন। সেই দল তার শেষ সময়ে তার কোন খোজ খবর নেয়নি। শেষ জীবন তার খুবই কষ্টে কেটেছে। তার ঢাকার বাড়ি দখল করার জন্য তার ভাতিজারা তাকে এক রকম বন্দি করে করে রেখেছিল। বলা যায় বিনা চিকিৎসায় তিনি ধুঁকে ধুঁকে মারা যান।
যুবক বয়সে তিনি এক সুন্দরী মেয়ের প্রেমে পড়েছিলেন। সেই মেয়ে ছিল হিন্দু। সেই সময়ে ছেলে মেয়ের প্রেম ছিল প্রায় কল্পনার বাহিরে। আরে হিন্দু মুসলমানের প্রেমত প্রশ্নই আসে না। কিন্তু তাদের সেই প্রেম ছিল পবিত্র, তারা একে অপরকে গভীর ভাবে ভালবেসেছিলেন। তাদের এই প্রেম সমাজ মেনে নেয়ার প্রশ্নই আসেনা। তাই তার ঠিক করলেন তারা পালিয়ে যেয়ে বিয়ে করবেন। যেই বলা সেই কাজ।পরিকল্পনা মাফিক মেয়ে তার ব্যাগ গুছিয়ে নিয়ে রেল ষ্টেশনে হাজির। কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস মনিরুজ্জামান স্যারের পরিবার কিছু একটা আচ করতে পেরেছিল, ফলে তা্রা তার যাত্রায় বাঁধা দিল। অনেক কষ্টে সবাইকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে ষ্টেশনে আসতে তার কিছুটা দেরি হয়ে গেল। তিনি যখন ষ্টেশনে আসেন তখন তাদের নির্ধারিত ট্রেন প্লাটফর্ম ছেড়ে চলে যাচ্ছে। পরের ঘটনা আরও করুন। তার আসার দেরি দেখে মেয়েটি চিন্তিত হয়ে পড়ল। যখন ট্রেন ছেড়ে দেয়ার হুইসেল বাজল, তখন সে নিশ্চিত হয়ে গেল যে তার প্রেমিক তার সাথে বিশ্বাসঘাতগতা করেছে। আর পালিয়ে এসে, একজন হিন্দু মেয়ের পক্ষে তার সমাজে ফিরে যাওয়া অকল্পনীয়। তাই নিজের সম্মান রক্ষা করার জন্য সে ট্রেনের নিচে ঝাপ দিয়ে আত্মাহুতি দিল। অথচ আর কয়েক মিনিট আগে আসলে এই করুন পরিনতি হয়ত হত না। তার প্রেমিকার এই আত্মাহুতিতে তিনি মনে প্রচণ্ড আঘাত পান। তার প্রেমিকার সম্মানার্থে তিনি চিরকুমার রয়ে যান। শুধু তাই নয় তার প্রমিকা বিড়াল খুব পছন্দ করত, তাই তিনি আজীবন অনেকগুলো বিড়াল পুষেছেন।
এবার আসি নিজের দেখা সত্যি একটা ঘটনায়। অনেক আগের কথা তখন আমি ক্লাস টেনে পড়ি। দক্ষিণাঞ্চলের এক মফঃস্বল শহরে থাকতাম। ছোট বেলায় বাবার বদলির চাকরীর সুবাদে একটা যাযাবর জীবনযাপন করেছি। আমার প্রতিবেশী এক বড়ভাই ছিলেন। তার মত ভাল ছেলে আমি আমার জীবনে দেখিনি। আমি তাকে অন্ধের মত অনুসরণ আর অনুকরণ করতাম। তার প্রভাব আমার জীবনে এখনো প্রবল। আমরা এক সাথে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তাম, এক সাথে ঘুরতাম। তখন ছিল শরৎ কাল। বিশাল একটা হাওড় ছিল। পানি ছিল কাচের মত পরিষ্কার। ঘাটে বাঁধা কোন নৌকা পেলে তাতে উঠে পড়তাম। দাড় বেয়ে অনেক দূর চলে যেতাম। অনেক কথা হত, অনেক গল্প হত। জীবনটা ছিল অনেক সুন্দর। একদিন আসরের নামাজ পড়ে হাটতে বের হয়েছি। আমাদের পাশ দিয়ে একজন বৃদ্ধ লাঠিতে ভর দিয়ে যাচ্ছিল। তিনি তাকে সালাম দিলেন। কিছুদূর যাবার পর আমাকে প্রশ্ন করলেন এনাকে চেন? আমি বললাম না। তখন তিনি বললেন এই বৃদ্ধের জীবনে খুব একটা করুন গল্প আছে। তুমি কি শুনবে? আমার না বলার কোন কারন নেই।
তিনি গল্প শুরু করলেন। ব্রিটিশ আমালের শেষের দিকের কথা। এই বৃদ্ধলোক তখন বয়সে তরুণ। মাত্র বিয়ে পাশ করেছেন। তখনকার দিনে ২০/২১ বছরেই বিয়ে পাশ করা যেত। এখনকার মত কোন সেশন জট ছিল না। ভাল একটা সরকারি চাকরী নিয়ে তিনি এই এলাকায় আসেন। তার বাড়ি উত্তরাঞ্চলে, অনেক দূরে। যেহেতু ব্যাচেলর মানুষ থাকার সমস্যা। তবে তখনকার দিনের মানুষের মন অনেক বড় ছিল। ব্যাচেলার বলে এখনকার দিনের বাড়িওয়ালার মত তাদের ঘৃণা করত না।
এলাকার এক সম্ভ্রান্ত লোকের বাড়িতে তিনি এক রুম ভাড়া নিলেন। নিজেই রান্না করে খেতেন। এভাবে দিন ভালই চলছিল। কিন্তু নিয়তি ছিল ভিন্ন। সেই বাড়িওয়ালার খুব সুন্দরী একটা মেয়ে ছিল। একমাত্র মেয়ে। তিনি সেই মেয়ের প্রেমে পড়ে গেলেন। তিনি দেখতে ছিলেন সুপুরুষ এবং খুবই ভাল একজন মানুষ। কাজেই এমন কারো প্রেমে না পরার কোন কারন নেই। তাদের সেই প্রেম ছিল পুত পবিত্র। মাঝে মধ্যে দেখা সাক্ষাৎ আর চিঠি চালাচালির মধ্যেই ছিল সব। কিন্তু বিধিবাম, বাড়ীওয়ালা টের পেয়ে গেল। কোন উপায় না দেখে তিনি বিয়ের প্রস্তাব দিলেন। তখনকার দিনে দুরে মেয়েদের বিয়ে দেয়ার প্রচলন ছিল না। আর একমাত্র মেয়ে বলে কথা। বাড়ীওয়ালা কিছুতেই তার কাছে মেয়ে বিয়ে দেবেন না। তাকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়া হল । বাড়ীওয়ালা তড়িঘড়ি করে ভাল একটা ছেলে দেখে জোর করে তার মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিল। এটা ছিল তাদের জন্য বড় একটা আঘাত। প্রকৃত প্রেমিক প্রেমিকে একে অপরকে ছাড়া কিভাবে থাকতে পারে? এই আঘাতে তারা উভয়েই একেবারে ভেঙ্গে পড়ল। প্রেমিকা খাওয়া দাওয়া একেবারে ছেড়ে দিল। সে সারদিন কাঁদত। ফলে দ্রুত তার শরীর ভেঙ্গে পড়ল। বিয়ের মাত্র মাস খানেকের মধ্যেই শোকে দুঃখে সে মারা গেল।
এত বড় দুঃখের খবর জানতে পেরে প্রেমিক একবারে ভেঙ্গে পড়ল। সারাদিন, সারারাত প্রেমিকার কবরের পাশে কান্নাকাটি করত। তার প্রেমিকাকে ছাড়া সে কোথাও থকতে পারবে না। তার চাকরী চলে গেল, আর কখনো তার নিজের বাড়িতে ফিরে যাওয়া হয়নি। ঝড় বৃষ্টি, শীতেও তিনি প্রেমিকার কবরের পাশে থাকতেন। এলাকাবাসী অনেক বুঝিয়েছিল, কিন্তু তার একটাই কথা তার প্রেমিকাকে একা ছেড়ে সে কোথাও যাবে না। এখানেই সে মরবে, তাকে যেন তার প্রেমিকার কবরের পাশে কবর দেয়া হয়। পরে এলাকাবাসী বুদ্ধি করে কবরের পাশে একটা ছাপড়া তুলে দিয়েছিল। যেন রোদ বৃষ্টিতে সেখানে তিনি আশ্রয় নিতে পারেন। লোকজন তার খাবারের ব্যাবস্থা করত। সবাই তাকে খুব সম্মন করত। এক সময় প্রেমিকার কবরের বাঁশ থেকে বিশাল বাঁশঝাড় গড়ে উঠল। তখন তিনি সেই বাঁশ থেকে লাঠি বানিয়ে নিজের কাছে রাখতেন যেন তার প্রেমিকার স্পর্শ সবসময় তার কাছে থাকে। মনে আছে আমি যখনই তাকে দেখেছি, তার সাথে সব সময় একটা বাঁশের লাঠি দেখেছি। এভাবে বহু বছর পার হয়ে গেল। তিনি তার প্রেমিকার কবরের আশপাশেই থাকতেন। দূরে কোথাও যেতেন না।
এত দিনে তার আর বেঁচে থাকার কথা না। তার শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী তার প্রেমিকার কবরের পাশে তাকে কবর দেয়ার কথা। এই নিষ্ঠুর দুনিয়া তাদের মিলন হতে দেয়নি। কিন্তু নিশ্চয়ই ওপারে তারা মিলিত হয়েছেন। ওপারের জীবন তাদের সুখে কাটুক এই কামনা করি। তাদের ভালবাসায় কোন অপবিত্রতা ছিল না। পবিত্র ভালবাসার স্থান এক মাত্র স্বর্গ। আশা করি স্বর্গে তারা অনেক ভাল আছে।
আরও কয়েকটি গল্প বলার ইচ্ছা চিল। কিন্তু আমি জানি আপনাদের মন খারাপ হয়ে গেছে। থাকনা কি দরকার সবার মন আরও খারাপ করার। মন খারাপ করা ভালবাসার অনেক গল্প আমার জানা আছে। মাঝে মাঝে আমি চোখ বন্ধ করে সেই সব গল্প কল্পনায় দেখি। মনটা খারাপ হয়ে গেলেও, কেমন জানি একটা ভালো লাগা কাজ করে। মনে হয় আমিও সেই সব প্রকৃত প্রেমিক প্রমিকার প্রকৃত ভালবাসার কিছুটা হলেও ধারন করি।
সবাই ভাল থাকবেন। ধন্যবাদ!