আমার ঢাকা থেকে পালাবার গল্প

ঢাকা দেশের রাজধানী, দেশের হৃদপিণ্ড বলা যায়। অথচ এই ঢাকাই হচ্ছে বিশ্বের বসবাসের অযোগ্য শহরের মধ্যে দ্বিতীয় 🙁 এর আগের শহরটি হচ্ছে যুদ্ধবিধ্বস্ত দামেস্ক শহর। কাজেই বুঝতে পারছেন ঢাকার অবস্থা। এটা আমার কোন মনগড়া কথা না। বিবিসির কথা, খবরের লিঙ্ক দেয়া হল।
 
আমি ঢাকা ছেড়েছি সেই ২০১০ সালে, ছেড়েছি বললে ভুল হবে, আমি আসলে পালিয়েছি। কারণ আমি ঢাকা ছাড়তে চাইলেও ঢাকা আমাকে ছাড়ছিল না। তাই এক রকম পালিয়েছি। আমার মাথায় আসে না মানুষ কিভাবে ঢাকায় থাকে। আমি সাড়ে ছয় বছরের মত ঢাকায় থেকেছি। কিন্তু আমার এক দিনের জন্যও মনে হয়নি আমি ঠিক কাজ করছি। বরং যেদিন ঢাকা ছেড়ে চলে আসি, কি যে আনন্দ লাগছিল, সেটা বলে বোঝানো সম্ভব না। আমি চোখ বুজলেও সেটা এখন অনুভব করতে পারি। আমি ঢাকার বদনাম করছি না, শুনেছি বড় শহরের এক ধরনের নেশা থাকে। যারা দীর্ঘদিন কোন বড় শহরে থাকে, তারা নাকি অন্য কোথাও বেশিদিন থাকতে পারে না। ঢাকাও এর ব্যাতিক্রম না।
 
কিন্তু কথা হচ্ছে বাস করার জন্য নুন্যতম যে সুবিধা থাকার কথা সেগুলো কি ঢাকাবাসী পায়। শুনেছি কানাডার টরেন্ট শহর আর ঢাকার বসবাসের খরচ নাকি এক। অথচ সুবিধার বিবেচনায় কি আকাশ পাতাল পার্থক্য! বিদেশে আপনি সাপ্লাইয়ের ট্যাপের পানি নিশ্চিন্তে পান করতে পারবেন ১০০% বিশুদ্ধ। লোডসেডিং কি জিনিস সেটা তারা জানে না। জীবন যাত্রার মান কত উন্নত 🙁 যোগাযোগ ব্যবস্থার কথা আর নাইবা বললাম। সব থেকে বড় কথা হচ্ছে জীবনের নিরাপত্তা আছে। ঢাকায় কেউ সকালে বের হলে রাতে সুস্থ শরীরে ফিরতে পারবে কিনা, এর কোন গ্যারান্টি নেই। সব থেকে খারাপ লাগে, ঢাকার মধ্যবিত্ত শ্রেণীর লোকদের জন্য। কারণ তাদের যাবার কোন জায়গা নেই। তারা চাইলেও অনেক কিছু করতে পারে না। সব থেকে আরমে আছে উচ্চবিত্তরা। তাদের টাকার অভাব নেই। চাহিদার সবকিছুই তাদের হাতের নাগালে। আর নিম্নবিত্তরাও ভাল আছে, তাদের ছোট কাজে সমস্যা নেই, ইনকামও মাসাল্লাহ ভাল। ঢাকায় থেকে তাদের অনেকেই দেশে জমিজমা বাড়ি করছে। গ্রামে থাকি তাই এসব ভাল জানি 🙂
 
ঢাকা থেকে সবকিছু ছেড়ে ছুড়ে চলে এলেও, একটা জিনিস সাথে নিয়ে এসেছি। সেটা হচ্ছে শ্বাসকষ্ট বা এজমা! আমার এই রোগ জিন্দেগীতে ছিল না। ঢাকায় এসে এটা হল। পেশার খাতিরে সারাদিন বাহিরে, রাস্তা ঘাটে থাকতে হত। রাস্তার ধুলাবালি আর কালো ধোঁয়া ফুসফুসের সর্বনাশ যা করার করে ফেলল। মনে আছে রাতে বেসিনে যখন হাতমুখ ধুতাম, তখন গলা পরিস্কারের সময়, গলার ভিতর থেকে কালো কালো ধুলা ময়লা বের হত। সে এক কুৎসিত দৃশ্য ছিল >:( এজমার এটাক যখন হয়, তখন সেই রোগী আর মৃত্যুর মধ্যে খুব একটা দূরত্ব থাকে না। সে মৃত্যুর স্বাদ মরার আগেই পেয়ে যায়। একবার নয় বারবার। পৃথিবীর সব থেকে ভয়াবহ রোগ হচ্ছে, বুক ভরে শ্বাস ঠিক মত না নিতে পারা। পরিচিত এক ডাক্তার দেখালাম। ডাক্তার যা বলল, সেটা মানতে হলে আমাকে ঘরের মধ্যে, ধুলাবালি মুক্ত পরিবেশে থাকতে হবে। মুখে মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। আরও কত কি নিয়ম। তাকে সাফ বলে দিলাম এত কিছু মানা সম্ভব না। কারণ মার্কেটিং এর চাকরি করি। বাহিরে বাহিরে, রাস্তা ঘাটে থাকতেই হবে। ডাক্তার ছিল আমার বন্ধু মানুষ, একটা কথাই তখন আমাকে সে বলল, আর সেটা হচ্ছে “ঢাকা থেকে পালিয়ে যান”। ঢাকায় থাকলে আপনার আয়ু কমপক্ষে ১০ বছর কমে যাবে। কাজেই পালান, যতদ্রুত পারেন পালান।
 
সেদিন থেকেই আমার মাথায় একটা কথাই ঘুরপাক খেতে লাগল, পালাতে হবে, যেভাবে হোক ঢাকা থেকে পালাতে হবে। কিন্তু চাইলেই কি আর হয়। এটা একটা জেলখানার মত, চাইলেও বের হওয়া যায় না। চেষ্টায় থাকলাম। কিন্তু সুযোগ আসে না। প্রায় দুই বছর পর সুযোগ এল। অফিসের বসদের একরকম ব্লাকমেইল করে ঢাকার বাহিরে পোস্টিং নিলাম। তাও আবার আমার নিজের জেলায় 🙂 সুযোগ হাতছাড়া করলাম না। সামান্য মালপত্র যা ছিল সেগুলো মোটরসাইকেলে বেঁধে ভোরে রওয়ানা দিলাম। অফিসে কোন কিছু জানালাম না। কারণ যদি তারা সিদ্ধান্ত চেঞ্জ করে 🙂 তাদের কোন সুযোগ দেয়া যাবে না। একে পালান ছাড়া আর কিইবা বলতে পারি 🙁 অর্ধেক রাস্তায় এসে অফিসে জানালাম আমি ঢাকা ছেড়ে যাচ্ছি। যেন আর বলতে না পারে আবার ফিরে এস বাছা 😀 কিজে আনন্দ লাগছিল, ভাষায় প্রকাশ করার মত নয়। মনে হচ্ছিল অনেক দিন পর জেলখানা থেকে মুক্তি পেয়েছি 🙂
 
ঢাকা থেকে পালানো, আমার জীবনের সবথেকে বড় এবং বেস্ট সিদ্ধান্ত ছিল। বলা যায় এই পর্যন্ত আমার জীবনের সবথেকে বড় টারনিং পয়েন্ট এটা। আমি সুযোগ পেলেই অনেককে এই পরামর্শ দেই। ঢাকা ছেড়ে আসার পর কি কি প্রাপ্তিযোগ হয়েছে সেটা আর বলতে চাই না। কারণ আপনাদের আফসোস বাড়বে 🙂 তবে এতটুকু বলতে পারি বুকফুলিয়ে তাজা বাতাস নিতে পারি। শ্বাস কষ্ট এখন আর আমাকে তেমন কাবু করতে পারেন না। নিজের পুকুরের তাজা মাছ, তাজা তরিতরকারী দিয়ে ভাত খাই। আর চাইলেই সাইকেল বা মটরসাইকেলে করে গ্রামের মেঠো রাস্তা দিয়ে যে দিক খুশি চলে যেতে পারি। আর কিছু বললাম না 🙂 সুধু এতটুকু বলব সুযোগ থাকলে ঢাকা থেকে পালান। কি দরকার এত কষ্ট করার। নিজের গ্রামে চলে আসেন। আশা করি জীবনের সব থেকে সুন্দর সময়গুলো এখানেই কাটবে।
 
ধন্যবাদ!

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *