একজন ক্ষুদ্র ফ্রিলান্সারের, ৫ ডলার বিষয়ক অনুভুতি
অনেক আগে প্রথম আলোতে একটা ছবি দেখেছিলাম। একজন বৃদ্ধা মহিলা, শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখের পানি মুছতে মুছতে, একটা কচ্ছপকে বিদায় জানাচ্ছে। ঘটনা হল কচ্ছপটি বিরল প্রজাতির। বাংলাদেশে এর আর কোন বংশধর নেই বললেই চলে। তাই তাকে প্রাণী সংরক্ষণ কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ব্রিড করে ওই কচ্ছপের বংশ বিস্তার করা হবে। দীর্ঘ প্রায় ১৫/২০ বছর লালন পালন করার কারনে, ওই সাধারণ প্রাণীর প্রতি বৃদ্ধার মায়া বসে গেছে। তাই সে কাঁদছে। অনেকের কাছে বিষয়টা হাস্যকর মনে হতে পারে, কিন্তু বৃদ্ধার কাছে প্রাণীটি সন্তানের মত।
প্রশ্ন করবেন এটার সাথে আমার কি সম্পর্ক? ঘটনা খুলে বলি। এটা ২০১৫ সালের শুরুর দিকের ঘটনা। সৌভাগ্যক্রমে একটা বড় প্রোজেক্ট পেয়ে যাই। কাজটা হল একটা পুরা eCommerce সাইটের সব প্রোডাক্ট রিটাচিং করা। প্রায় হাজার ডলারের উপর কাজ। বায়ার খুবই ভাল, আমেরিকান, নাম Rick । পেমেন্ট প্রতি সপ্তাহে ভাগে ভাগে দিত। সুধু এই একটি মাত্র কাজের কারনে কয়েক মাসের ইনকাম ভাল ছিল। তখন বেশির ভাগ কাজ ৫ ডলারের পেতাম। এটাই আমার কাছে, অনেক বড় বলে মনে হত। ৫ ডলার প্রায় ৩০০ টাকা, আমার বাজার খরচ হয়ে যায়। আমি বিষয়টা সেভাবে দেখতাম। সেখানে এত বড় একটা কাজ পাওয়া, আমার মত ক্ষুদ্র একজন ফ্রিলান্সারের জন্য এটা বিরাট এক পাওয়া ছিল। ঈদের আগ দিয়ে সব কাজ শেষ করে ফেলেছিলাম। বায়ার খুবই ভদ্রলোক ছিল, USA এর বায়ারেরা যেমনটা হয়। সরাসরি না বলে বলল যে, আগামি বেশ কিছুদিন সে আর কোন ছবি পাঠাতে পারেবে না। মানে তার কাজ শেষ, আমার সার্ভিস আর লাগবে না।
কয়েক মাস টানা কাজ করার কারনে কাজটার প্রতি একটা মায়া তৈরি হয়ে গিয়েছিল। বায়ার না করে দেয়ার পরে, অন্যরকম অনুভূতি হয়েছিল, অনেকটা ওই বৃদ্ধা মহিলার অনুভূতির মত। মনে হয়েছিল কি যেন হঠাৎ করেই হারিয়ে ফেললাম। খুবই খারাপ লাগছিল, আবার ভাল লেগেছিল যে, অত্যন্ত সফল ভাবে কাজটি করেছি। বায়ার আমার কাজে খুবই সন্তুষ্ট ছিল। একজন বিদেশির কাছে, আমার দেশের মান উজ্জল করেছি ভাবতেই ভাল লাগছিল। এই এক বায়ারের কারনে, আমার সেই বছরের ঈদ অনেক ভাল কেটেছিল। আত্মীয় স্বজন সবাইকে, ঈদের নতুন কাপড় দিয়েছিলাম।
মজার ব্যাপার হচ্ছে এই বায়ারের কাজ শুরু হয়েছিল ৫ ডলার দিয়ে। বেশ কিছু কাজ ৫ ডলার দিয়ে করার পরে, সে ওই বড় প্রজেক্ট আমাকে দেয়। আসলে সে আমাকে যাচাই করছিল, আমি আসলেই এত বড় কাজ করতে পারব কিনা। বলছিলাম ৫ ডলারর কাজ নিয়ে। আমি নিজেও কম রেটে কাজ করার পক্ষপাতি না। যৌক্তিক রেটে কাজ করা উচিৎ। তবে এমন কিছু কিছু কাজ আছে, যেগুলোর রেট আসলেই ৫ ডলার বা তারও কম। এসব ক্ষেত্রে এসব কাজ ৫ ডলারেই করতে হবে। কাজেই বায়ার ৫ ডলারে কাজ মানেই বায়ার খারাপ, এটা মনে করার কোন কারন নেই। অনেকের আর্থিক সমর্থ না থাকতেও পারে। বাজারে গেলে পকেটে টাকা কম থাকলে আমরাও দরদাম বেশি করি। আমার যদি না পোষায় তবে ইন্ডাইরেক্টলি না করে দেব। তবে বায়ারের ব্যাপারে খারাপ ধারণা করা উচিৎ না।
=============== আমার কিছু টিপস ================
গুরুত্ব দিয়ে কাজ করুনঃ
কাজ ৫ ডলারের হোক কিংবা ৫০ ডলারের, সব কাজই সমান গুরুত্ব দিয়ে করুন। কারন আজকের একজন ছোট বায়ার আগামী দিনে বড় বায়ার হতে পারে। আমার এক বায়ার অনেকদিন ৫ ডলারে কাজ দিত। পরে তার ব্যাবসা অনেক বড় হয়। এর পরে কোন কাজ ৫০ ডলারের নিচে ছিল না।
কাজের ক্ষেত্রে সৎ থাকুনঃ
যার নুন খাবেন তার গুন অবশ্যই গাওয়া উচিত। শুরুতে এই বায়ার আমাকে পেমেন্ট বাহিরে দিতে চেয়েছিল। আমি সবিনয়ে তা প্রত্যাখ্যান করেছি। আমার এই সততায় তিনি মুগ্ধ হন, এবং কাজটা আমাকে দেন। এই সততার কথা তিনি অনেকবারই মেসেজে বলেছেন। আমি হয়ত ১৫০/২০০ ডলার লস করেছি। কিন্তু যে সাইটের মাধমে আমি কাজ পাই, তার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকতে চেয়েছি। যদিও আমার এই মতের সাথে অনেকেই দ্বিমত পোষণ করবেন।
চোখ কান খোলা রাখুনঃ
সুযোগ অনেক সময় দরজায় আলতো করে টোকা দেয়। যেকোন ছোট বিষয়কেও গুরুত্ব দিন। কারন এখান থেকেই বড় কিছু হতে পারে। যেমন আমার এই কাজটা শুরু হয়েছিল ছোট একটা মেসেজ থেকে, শেষ হয়েছে হাজার ডলারে।
সবাই ভাল থাকুন, সবার জন্য দোয়া করি, আমার জন্যও দোয়া করবেন। ধন্যবাদ!