করোনা কালের এক সন্ধ্যায়
ছোট বেলা থেকেই আমার ঠাণ্ডার সমস্য, অল্পতেই হাঁচি কাশি শুরু হয়ে যায়। করোনা কালের এই সময়ে, তাই আরও বেশি সাবধান থাকতে হচ্ছে। কিছু হলে বিনা বিনা চিকিৎসায় চলে যেতে হবে। বাসা থেকে বের হওয়া একেবারেই নিষেধ। গত তিন দিন পর, বাসার সিড়ির সামনে ১০/১৫ মিনিট বসেছিলাম মাত্র। গত তিন দিনে বাহিরে বের হওয়া বলতে এতটুকু।
কিন্তু আজকে সন্ধ্যায় বের হতেই হল। একজন কিছু টাকা পায়, তাকে দিতে হবে। তার দোকান দেখি বন্ধ, এশার নামাজ পড়তে গেছে। আমাদের এই গ্রাম কট্টর, আহলে হাদীস সম্প্রদায়ের এলাকা। এরা ধর্মান্ধ, কোন কথাই কানে নেবে না। করোনার এই সময়ে মসজিদে লোকজনত কমেই নাই, বরং আরও অনেক বেড়েছে। এরা কোন আইনের তোয়াক্কা করে না। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়া দেখতে খুব খারাপ লাগছিল। কত দিন হয় মসজিদে নামাজ পড়ি না। ভাবতেই মনটা খারাপ হয়ে গেল। আমি ভিতু প্রকৃতির লোক। জানি না আবার কবে, কোন ভয় ডর ছাড়া, মালিকের ঘরে সেজদা দিতে পারব। আদৌ কি সেই সুযোগ পাব 🙁 নামাজ শেষ হতে দেরি আছে। কি করা যায় ভাবছি, দেখি রাস্তার ধারের মুদির দোকানের ঝাপ একটু খোলা। ভিতরে আওয়াজ হচ্ছে। একটু আশার আলো দেখতে পেলাম। বুঝলাম, চাইলে পেটে কিছু দানা পানি দেয়া যেতে পারে। কাছে যেয়ে আস্তে করে জিজ্ঞেস করলাম, কফি হবে কিনা। তার থেকেও আস্তে ,উত্তর এল, “হবে”। আমাদের এই গ্রামে কিন্তু, উৎকৃষ্ট মানের নেসক্যাফে কফি পাওয়া যেত। কফিতে অনেক দিন পর, তৃপ্তির চুমুক দিতে দিতে, চোখ বন্ধ করে, এর স্বাদ আস্বাদন করছিলাম।
চোখ খুলতেই দেখি, একটা কুকুর করুন দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে আছে। দেখেই বুঝা যায় অভুক্ত, পেটে সারা দিনে কিছু পড়েনি। পড়বে কি করে, দোকান পাট সব যে বন্ধ থাকে। এদের কে খাওয়াবে। দেখে মায়া হল। দোকানদারকে জিজ্ঞেস করলাম, রুটি আছে কিনা, জানাল নেই, সাপ্লাই দেয় না। কি আছে জিজ্ঞেস করলাম। বলল বিস্কুট আছে। এক প্যাকেট বিস্কুট নিয়ে বেচারাকে খেতে দিলাম। একটা একটা করে বিস্কুট দিচ্ছি, সে অবাক হয়ে কৃতজ্ঞচিত্তে সেটা লুফে নিচ্ছে। অনেকেই অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করছে, কেন এটা করছি। বিশেষ করে দুইজন মুরুব্বী। এই সুজগে তাঁদের কাছে, ধর্মের কিছু বানী বিলোলাম। এক পতিতা মহিলা, এক অভুক্ত কুকুরকে পানি খাইয়ে, জীবন বাঁচিয়ে, বেহেশত পেয়েছিল, সেই গল্প বললাম। তারাও একমত হল, কারন গল্পটা সবার জানা। তাঁদেরকেও কফি অফার করলাম। তারা না করল না। বিস্কুট খাওয়ানো শেষ হয়ে এসেছে, এমন সময় দেখি, সবাই চোর চোর বলে দৌড়াচ্ছে। ইতিমধ্যে নামাজ শেষ হয়ে গেছে। ফলে মুসল্লিরাও চোর ধরায় সামিল হয়েছে। এলাকাটা একেবারে লোকে লোকারণ্য।
আমার পাওনাদারকে পেলাম, মসজিদ থেকে সে মাত্র বের হয়ে, দোকানে না গিয়ে, চোর ধরায় সামিল হতে যাচ্ছে। তার হাতে টাকাগুলো গুজে দিয়ে, দ্রুত বাড়ির দিকে হাটা দিলাম। করোনার কালে, এত লোক সমাগমের মধ্যে যাওয়ার কোন ইচ্ছাই নেই। কিন্তু চাইলেও এড়ানো যায় না। পথে অনেকের সাথেই দেখা হল। জিজ্ঞেস করল, কেন আমাকে এলাকায় দেখা যাচ্ছে না। কারন বললাম। শুনলাম দুইটা চোর নাকি পালিয়ে, ঝোপের মধ্যে লুকিয়ে আছে। সবাই তন্ন তন্ন করে ঝোপ ঝাড়, ধানক্ষেতে খুঁজছে। তাঁদের ধরে ফেলতে বেশি সময় লাগার কথা না। দ্রুত পা চালিয়ে বাসায় চলে এলাম। আমি এসব মারধোর সহ্য করতে পারি না। বাসায় আসার সাথে সাথেই, চারিদিকে উতফুল্ল জনতার প্রচন্ড চিৎকার শুনতে পেলাম। বুঝলাম এটা বিজয়ের চিৎকার। শুনলাম চোর দুইটা ধরা পড়েছে, ধান খেতে লুকিয়ে ছিল। এলাকার সবাই সবাইকে চেনে। কাজেই চোরের বেশিক্ষণ লুকিয়ে থাকতে পাবার কথা না। হৈ হৈ করে সবাই চোর দুটোকে স্কুল ঘরের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। নিশ্চয়ই খুব উত্তম মাধ্যম চলছে। মা, আর বঊ হাঁয় হাঁয় করে উঠল। মেয়ে মানুষ বলে কথা, এদের মনে অনেক মায়া, মা আফসোস করে বলছে, মনে হয় পিটিয়ে মেরেই ফেলছে। অন্য সময় হলে আমি বের হতাম। চেষ্টা করতাম বাঁচানোর। কিন্তু এখনত করোনার কাল, সময় খারাপ। কিছু করার নেই। মন খারাপ করে ঘরে বসে রইলাম। চোরগুলোর কি হয়েছে, জানতে চাই না, ইচ্ছাও নেই। আমাদের এলাকায় তেমন চুরি হয় না। বোঝাই যাচ্ছে সামনে খারাপ সময় আসছে। কপালে কি আছে জানি না। খোদা আমাদের উপর রহম করুন।
আমিন।
(ঘটনাগুলো আজকে সন্ধ্যার)