যে ফ্রিল্যান্সার কখনো ফ্রিল্যান্সার হতে চায়নি
জী আমি নিজের কথাই বলছি। একজন প্রফেশনাল ফ্রিল্যান্সার হবার ইচ্ছা আমার কোন কালেই ছিল না, ফ্রিল্যান্সিং সেক্টরে এসেছি অনেকটা বাধ্য হয়ে। এই কথাগুলো অনেক আগেই আমার ফ্রিল্যান্সার হবার গল্পে আমি শেয়ার করেছি। ফ্রিল্যান্সিং সেক্টরে ৯ বছর পার করে ফেলার পরে, একটা বিষয় বুঝেছি, সেটা হচ্ছে বেশিরভাগ সফল ফ্রিল্যান্সার অনলাইন ফ্রিল্যান্সিং সেক্টরে আসে অনেকটা ঘটনা চক্রে। প্লান করে আসে খুব কম লোকই।
গ্রাজুয়েশনের শুরুতেই ফ্রিল্যান্সার হবার ইচ্ছা নিয়ে স্কিল ডেভেলপ করে এমন পাবলিক আমি খুবই কম দেখেছি। সবাই বিভিন্ন দিক ট্রাই করে, সব শেষ অপশন হিসাবে ফ্রিল্যান্সিংকে বেছে নেয়। আবার অনেক ইয়াং আছে যাদের ভাল যোগ্যতা আছে, শখের বসে ফ্রিল্যান্সিং শুরু করে সফল হয়ে সেটাকেই পেশা হিসাবে বেছে নেয়। আমি বিস্তারিত বিষয়ে গেলাম না।
একটা কথাই বলব ফ্রিল্যান্সিং পেশা হিসাবে ঝুকিপূর্ণ, একমাত্র সাহসী কেউ যার ঝুকি নেয়ার ক্ষমতা আছে তাদের জন্যই ফ্রিল্যান্সিং বা যে কোন মুক্তপেশা। কাজ কর্ম না থাকায়, আজকে আমার নিজের কিছু গল্প শোনাতে চাই। যদি ধৈর্য থাকে তবে লেখাটা পড়তে পারেন।
আমাদের স্টূডেন্টদের অধিকাংশেরই জীবনের কোন লক্ষ্য নেই। গ্রাজুয়েশন শেষ করে কি করবে সে সেটা জানে না। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে আমার জীবনের একটা লক্ষ্য ছিল। আমি বোটানির স্টুডেন্ট ছিলাম, অনার্স দ্বিতীয় বর্ষ থেকেই আমার ধ্যানজ্ঞান ছিল যে আমি ফারমাসিউটীক্যাল সেক্টরে আমার ক্যারিয়ার গড়ব।
কারন সরকারী চাকরী করব না এটা অনেকে আগে ঠিক করে রেখেছিলাম। আব্বা ছিলেন একজন সৎ পুলিশ অফিসার, তার অনেক কষ্ট হত আমাদের সংসার চালাতে। বেশি সহজ সরল ছিলেন বলে তাকে সব সময় ডিউটি আর পোস্টিং এর উপর থাকতে হত। আব্বা আমাদের ছাড়া থাকতে পারতেন না। তাই তার সাথে আমারাও যাযাবরের মত ঘুরেছি। আব্বার অকালে চলে যাওয়াটা ছিল এই চাকরীর কারনে।
ডায়াবেটিস এর রোগী ছিলেন, তাকে দিন রাত ডিউটী দিয়ে দিয়ে আর থানার ওসিকে চাহিদা মাফিক টাকা দিতে না পারায় মেন্টালি টর্চার করে করে তাকে মেরে ফেলা হয়েছে। এটা ছিল মূলত একটা মার্ডার। কিন্তু দুনিয়ার সবাই জানে আমার আব্বা অসুস্থ হয়ে মারা গেছে। তারা আরো ১২ বছর চাকরির বাকী ছিল। তিনি এতটাই সৎ ছিলেন যে আমি লোণ করে তাকে একটা সেকেন্ডহান্ড মটোর সাইকেল কিনে দিয়েছিলাম।
কারন থানার সাব ইন্সেপেক্টর হবার পরেও তার মোটরসাইকেল ছিল না এই জন্য থানার ওসি রেগুলার গালমন্দ করত। যা হোক ফারমাসিউটীক্যাল সেক্টরে চাকরী করার ইচ্ছার বিভিন্ন কারন ছিল তার মধ্যে অন্যতম ছিল তারা দামী মোটরসাইকেল চালায়, সুটেট বুটেড হয়ে চলাচল করে, তাদের স্যালারি হ্যান্ডসাম। সব মিলিয়ে তাদেরকে আমার হীরো মনে হত। আমি সময় পেলেই তাদের সাথে কথা বলতাম। তাদের কাছ থেকে টিপস নিতাম। মাঝে মাঝে স্বপ্ন দেখতাম আমি মোটরসাইকেল চালিয়ে চোখে সানগ্লাস দিয়ে হিরোর মত রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি।
মানুষ মন থেকে আল্লাহর কাছে যা চায় আল্লাহ্ তাকে সেটাই দেন। আমার অনার্স রেজাল্ট বের হবার ১০ দিনের মাথায় আমি জব ইন্টারভিউ দেয়ার জন্য বের হই। ২০০৪ সালে ইন্সেপ্টা ফার্মসিউটীক্যালস ছিল বাংলাদেশের ২য় বৃহত্তম ফার্মা কোম্পানি। প্রথম জব ইন্টার ভিউতেই আমি টিকে যাই। তখন এত বাধ্যবাধকতা ছিল না। আমাকে ইন্টাভিউ বোর্ডে জিজ্ঞাস করা হয়েছিল, আপনার চাকরীর এতটাই দরকার যে আপনার সার্টিফিকেট এখনো বের হয়নি, রেজাল্ট সিট নিয়ে চলে এসেছেন।
উত্তরে আমি আমার সপ্নের কথা বললাম, ফ্যামিলি প্রবলেমের কথা বললাম। যা হোক প্রায় ২ মাসের ট্রেনিংএ আমি ২০০ জনের মধ্যে তৃতীয় হলাম। আমার পোস্টিং ঢাকার পিজি হাঁসপাতালে হল। আমি স্পেশাল টীমে ছিলাম, মানে কোম্পানির মধ্যে এলিট ক্লাশের জব। মূলত কারডিওলজি আর নিউরোমেডিসিন ডিপার্টমেন্ট দেখতাম। এই জব আমি প্রচন্ড ইনজয় করতাম। প্রতিটী দিন ছিল আমার জন্য চ্যালেঞ্জ। ডাক্তারদের সাথে সুসম্পর্ক করতে আমার বেশি সময় লাগল না। আমার বস ছিলেন অমায়িক মানুষ আমাকে কাঁদামাটি থেকে তিনি তৈরি করেছিলেন। কলেজ লাইফে আমার তেমন কোন বন্ধু ছিল না।
মাত্র ৩/৪ জনের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। বাকীরা মূলত ছিল সহপাঠী তাদের সাথে খুব একটা মিশতাম না। পুরা কলেজ লাইফে আমি নিজেকে গুটিয়ে রেখেছিলাম। কারন একজন ব্রিলিয়ান্ট স্টূডেন্ট হবার পরেও ভাল কোথাও চান্স না পাওয়া, আর পারিবারিক এবং ব্যাক্তিগত কিছু সমস্যার কারনে সব সময় হীনমন্যতায় ভুগতাম। এমনকি মাঝে মাঝে সুইসাইড করার ইচ্ছাও মনে জাগত। সব মিলিয়ে কলেজ লাইফে আমি মূলত ছিলাম অগোছালো, দাড়িগোঁফ না কামানো, উষ্কখুষ্ক চুলের একজন ছেলে, যার উপস্থিতি ক্লাশের কোন যায় আসে না। জীবনে কোনদিন প্রেম করিনি।
মেয়েদের সাথে কথা বলতে প্রচন্ড ভয় পেতাম। আমার স্ত্রী হচ্ছে প্রথম মেয়ে মানুষ যার সাথে ভালভাবে কথা বলেছি। সেশনজটে ৩ বছরের অনার্স কোর্স সাড়ে ৫ বছরে এভাবেই শেষ করেছি। আমার ক্লাশের অনেকেই আমার নামটা পর্যন্ত জানত না। ফাইনাল ইয়ারের ফেয়ারওয়েলে অনেকেই আমার নাম স্মরণ করতে পারছিল না। মাস্টার্স করার জন্য আরো দেড় দুই বছর অপেক্ষা করা আমার সম্ভব ছিল না।
আমি আমার নিজেকে আবিস্কার করি এই ফার্মা সেক্টরে এসে। প্রচন্ড পরিশ্রম এবং কঠোর অধ্যাবসায় আমাকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে লাগল। আমি বসদের খুব প্রিয়পাত্র ছিলাম। ডাক্তারেরা আমাকে পছন্দ করত। পিজি হাঁসপাতালের (বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়) বড় বড় ডাক্তারেরা আমাকে এখনো স্মরণ করেন। অথচ আমি সেখান থেকে চলে এসেছি ১২ বছর হয়ে গেছে। আত্মবিশ্বাস লেভেল এতটা হাই ছিল যে, নতুন কোন মেডিসিন আসলে আমি বাংলাদেশের মেডিকেল সেক্টরের বড় বড় প্রফেসরদের প্রোডাক্ট নিয়ে ব্রিফ করতাম।
তাদের যে কোন দরকার আমার ডাক পড়ত, এখনো তাদের নাম্বার মোবাইলে সেভ করা আছে। মাত্র দেড় বছরে আমি পুরা অন্য মানুষে পরিণত হলাম। চাকরীরত অবস্থায় মাস্টার্স দেই। আমার কথাবার্তা আর এটিচুড দেখে আমার সহপাঠীরা সবাই অবাক। আমার এই রূপ তারা কখনো দেখেনি। চাকরিতে প্রতিদিন আমার জটিল জটিল পেশাগত প্রবলেম সলভঁ করতে হত। ফলে যে কোন সমস্যা সেটা যতই বড় হোক না কেন, আমি আত্মবিশ্বাসের সাথে সলভঁ করতে পারতাম। সেই আত্মবিশ্বাস আমার এখনো আছে।
আমার মাস্টার্স পরীক্ষা নিয়ে কিছু জটীলতা চলছিল। কারন আমি ঠিক মত ক্লাশ করিনি প্র্যাক্টীকাল করিনি। একজন স্যার আমার পরীক্ষার বীরধী ছিলেন, কিছু কিছু সহপাঠি আপত্তিও করেছিল। অথচ আমি মাত্র এক রাতেই সব ঝামেলা সলভ করে ফেলি। অনার্সের ভাইভাতে যেখানে টেনেটূনে পাশ করেছিলাম, সেখানে মাস্টার্সে ১০ টা প্রশ্নের মধ্যে মাত্র ২ টার এন্সার দিয়ে হাইয়েস্ট নাম্বার পেয়েছিলাম। কারন পুরা ইন্টারভিউ বোর্ড আমি কন্ট্রল করছিলাম, এতটাই আত্মবিশ্বাস ছিল আমার। মাস্টার্সে আমি আমার ডিপার্টমেন্ট থেকে হাইয়েস্ট নাম্বার নিয়ে পাশ করেছিলাম। সব কিছু সপ্নের মত ছলছিল।
তিনটা সাফল্য আমার এক সাথে ধরা দিল, মাত্র আড়াই বছরে চাকরিতে আমার প্রোমোশন হল, বিয়ে করলাম, এবং আমার সপ্নের নতুন মোটরসাইকেলটা পেলাম। প্রোমোশন হবার পরে ১১ জনের বিশাল একটা টিম চালাতাম, ঢাকা মেডিকেল, পিজি হাসপাতাল, ল্যাবএইড, সেন্ট্রাল হসপিটাল সহ ঢাকার বড় একটা অংশ আমি দেখতাম। বলা যায় রকেট গতিতে আমার উন্নতি হচ্ছিল। ২০০৭ সালে অফিশিয়ালি ইন্ডীয়ান ট্যুরে দিয়ে এলাম। ২০০৮ এ নেপালে ৭ দিনের ট্যুর, ২০১০ সালে ৫ দিনের চায়না ট্যুর দিয়ে এলাম।
ভাল পারফরমেন্সের পুরষ্কার ছিল এগুলো। এই একটা চাকরী থেকে এত কিছু পেয়েছি সেটা বলে শেষ করতে পারতাম না। আমি নতুন রিক্রুটারদের ট্রেনিং নিতাম। প্রায় ১০০/১৫০ লোকের ট্রেনিং নিয়মিত নিতে হত। ঢাকার এমন কোন ৫ স্টার হোটেল নেই যে যেখানে আমি প্রোগ্রাম করিনি। এভাবে বলতে গেলে আসলে বলে শেষ করা যাবে না। অথচ তখন আমার অধিকাংশ সহপাঠী চাকরী খুজতে ব্যাস্ত।
বলা হয় যে যিনিস যত দ্রুত উপরে ওঠে তার পতনও তত দ্রুত হয়। ২০০৮ সালে আমার আব্বা হঠাৎ করে মারা গেলেন। এত বড় আঘাত সহ্য করার ক্ষমতা আমার ছিল না। নিজের এবং বাড়ির দুইটা পরিবারের দায়িত্ব কাঁধে এসে পড়ল। বসেরা আমাকে আরো একটা কারনে ভালবাসতেন কারন আমি সৎ ছিলাম। যেখানে আমার কলিগেরা দামী দামী নোকিয়া মোবাইল ফোন চালাচ্ছেন, টাকা জমিয়ে প্লট রাখছেন, তখন আমি নোকিয়া ১১০০ মডেল নিয়েই সন্তুষ্ট ছিলাম। ৭ বছরের চাকরী জীবনে কোন সঞ্চয় করতে পারিনি। আমার বস প্রোমোশন নিয়ে চলে গেলেন। নতুন একজন বস এলেন।
তিনি আমাকে বুঝতে পারলেন না। আব্বা মারা যাওয়ায় মানসিক ধাক্কায় আমি মানসিক রোগী হয়ে গেলাম। প্রচন্ড ডিপ্রেশনে চলে গেলাম। যে সময় আমার সাপোর্টের দরকার ছিল, সেই সময় সেই বস আমার উপর মানসিক টরচার করতে লাগলেন। আমার নামে আজে বাজে কথা উপরের বসদের কাছে দিতে লাগলেন। বলা যায় তার গুটীবাজির কারনে আমার পুরা ক্যারিয়ার হুমকিতে পড়ে গেল।
বাড়িতে জমিজমা নিয়ে সমস্যা। আম্মাকে বললাম ঢাকায় আমার কাছে চলে আসতে। তার বক্তব্য ছিল আব্বা যেহেতু গ্রামের নতুন বাড়িতে তাকে উঠিয়ে দিয়ে গেছে, কাজেই উনি এখান থেকে কখনো যাবেন না। এক মাত্র বাড়ি থেকে তার লাশ বের হলেই তিনি বের হবেন। আব্বার শোকে আম্মা মানসিক সমস্যায় ভুগতে লাগলেন। পাশাপাশি হাই প্রেশারের কারনে যে কোন সময় তার স্ট্রোক হতে পারে। একবার হাঁসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছিল। বুঝতে পারলাম আমি মায়ের পাশে না থাকলে হয়ত মাকেও হারাবো। অবস্থা এমন হয় চাকরী না হয় পরিবার। তাই কঠিন একটা সিদ্ধান্ত নিলাম, আমি আমার পরিবারকে বেছে নিলাম। জোর করে নিজের এলাকায় পোস্টিং নিলাম।
বসেরা আমার উপর খুব অসুন্তস্ট হলেন। আর কিছু দিন ঢাকায় থাকলে আমার আরো একটা প্রোমোশন হতে পারত। ২০১০ সালেই আমি কোম্পানি থেকে হয়ত গাড়ি পেতাম। কিন্তু তত দিনে আমার চকারি থেকে মন উঠে গেছে। পরিবার রক্ষা করা আমার প্রধান কাজ ছিল। বাড়ীতে আসার পর আম্মা ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠলেন। ভিলেজ পলিটীক্সে জড়িয়ে আমার মেজ ভাইয়ের পড়াশোনা প্রায় ধবংস হয়ে গিয়েছিল। আমি বাড়ীর দায়িত্ব নেয়ার পরে, তাকে বললাম পড়াশোনায় মনোযোগ দিতে। সে পড়াশোনায় মনোযোগ দিয়ে ভাল ভাবে পাশ করল।
আমি যে উদ্দেশে বাড়িতে এসেছিলাম তাতে আমি শতভাগ সফল। কিন্তু নিজের এলাকায় সেলস খুব খারাপ হতে লাগত। কারন পুরা রিজিয়নের সবাই লুটপাট আর দুর্নীতির সাথে জড়িত ছিল। আমি একা আর কত যুদ্ধ করব। উপর থেকে সেলসের প্রেশার বাড়তেই লাগল। বুঝতে পারলাম এই চাকরী আমার জন্য না, আর ঢাকায় ফেরত যাবার কোন উপায় নেই, কারন বসেরা আমার উপর অসুন্তস্ট। ইচ্ছা করলে মাটি কামড়ে পরে থাকতে পারতাম।
কিছুদিন পরে হয়ত সব ঠিক হয়ে যেত। কিন্তু চাকরী আমার আর ভাল লাগছিল না। স্বাধীনতা খুব করে চাইছিলাম। তাই বসদের অনিচ্ছা স্বত্তেও সসম্মানে চাকরী থেকে ইস্তফা দিয়ে মাথা উচু করে চলে আসি। বসরা অনেক বুঝিয়েছিলেন এমন সিদ্ধান্ত না নিতে। কিন্তু আমি আমার সিদ্ধান্তে অটল ছিলাম।
সেই চাকরী জীবনে আমি অসংখ্য বন্ধু আর শুভাকাঙ্ক্ষী পেয়েছিলাম। তারা ছিল আমার প্রকৃত বন্ধু। চাকরী ছাড়া নিয়ে আমার কোন আফসোস নেই। কিন্তু তাদের হারানো ছিল আমার জীবনের অন্যতম কষ্টের কারন। যাদের সাথে প্রতিদিন দেখা হত, সুখ দুঃখ আনন্দ ভাগ করে নিতাম। যাদের সাথে পারিবারিক সম্পর্ক ছিল, তাদের সাথে দেখা না হওয়াটা খুব কষ্টের ছিল। কতদিন অজান্তে চোখ দিয়ে পানি বের হয়েছে আমি জানি না।
নতুন জায়গায় পোস্টিং হয়েছিল থাকার যায়গা ঠিক হয়নি। আমি কলিগের বাসায় কয়েক মাস থেকেছি। এক্সিডেন্ট করে রাস্তায় পড়েছিলাম। শুধু মোবাইলে একটা কল দিয়েছিলাম সাহায্যের জন্য। এর পরে আর কিছু মনে নেই। তারা আমার চিকিৎসার ব্যাবস্থা করেছে, দিনের পর দিন সেবাশুশ্রূষা সব করেছে কোন দাবী ছাড়াই। ঢাকায় আন্দলনের সময় আটকা পড়ে গিয়েছি, কলিগের বাসায় দিনের পর দিন থেকেছি কিছু বলেনি। আর্থিক কষ্টে পড়েছি, সবাই নির্দ্বিধায় টাকা ধার দিয়েছে।
আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে, পরে শুনী পাত্রি ভেগে গেছে, মানসিক ভাবে ভেঙ্গে পড়েছি। বড় ভাই কলিগ আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বুকে আগলে রেখেছে। এভাবে বলতে গেলে বলে শেষ করা যাবে না। তারা ছিল আমার একান্ত কাছের আপনজন। ফ্রিল্যান্সিং সেক্টরে এসে এটা খুবই মিস করি। সত্যি বলতে হাতে গোনা কয়েকজন ছাড়া ফ্রিল্যান্সিং সেক্টরে আমার বন্ধু বলে কেউ নেই। এখানে সবাই স্বার্থবাদি। খারাপ সময়ে এসের আসল রূপ দেখা যায়। এসব ভার্চুয়াল ফ্রেন্ডেদের ফুটাপয়সার দাম আমার কাছে নেই। এদের আমার ভাল করে চেনা হয়ে গেছে।
গত মাসের শেষের দিকে ঢাকায় গিয়েছিলাম। প্রায় ১২ বছর পর আমার সেই সব বন্ধু কলিগ বসদের সাথে আবার দেখা। দেখালাম তারা সবাই আগের মতই আছে, আমি শুধু সাইজে ডবল হয়ে গেছি। সেই আগের আন্তরিকতার সাথে সবাই আমাকে আপন করে নিল। এটা যে কতটা ভাল লাগার সেটা বলে বোঝাতে পারব না। আমার মনেই হয়নি আমি তাদের থেকে অন্য জগতে চলে গেছি। এতদিন পরেও সবাই আমাকে মনে রেখেছে এখনো আমার খোঁজ সবাই রাখে দেখে খুবই ভাল লাগল। আসলে এই বন্ধন কখনো ছেড়ার নয়।
আমি তাদের যেমন প্রচন্ড ভালবাসি মিস করি, আমি জানি তারা আমাকে স্মরণ করে মিস করে। আমার ফ্রিল্যান্সিং সাফল্যের কথা শুনে তারাও গর্বিত হয়। চ্যানেল আইয়ের অফিস আর আমার ইন্সেপ্টার অফিস একই সাথে। যখন জানল আমি চ্যানেলে একটা সাক্ষাৎকার দিতে এসেছি শুনে সবাই খুবই খুশি হল। আমার লেখা বইয়ের কয়েকটা কপি বসদের দিলাম তারা খুব খুব খুশি হলেন। এমন বড় কোম্পানি থেকে সাধারণত ২নাম্বারি করে সবাই চাকরী ছাড়ে। কিন্তু আমি ছেড়েছিলাম মাথা উচু করে বীরের মত। কোন ধরণের অসততার কালি আমার গায়ে লাগতে দেইনি। এটাই আবার বড় সাফল্য।
আমার কলিগেরা কোম্পানির সব বড় বড় পদে আছে। এমনকি আমার অনেক জুনিয়র যাদের ট্রেনিং আমি দিয়েছিলাম, তারাও অনেক বড় বড় পদে আছে প্রত্যেকের অফিস থেকে গাড়ী আছে। প্রতিবছর তাদের একাধিক বিদেশ ট্যুর থাকে, কোম্পানি থেকে দামী গাড়িতে চলাচল করে। একেক জনের আন্ডারে শত শত মানুষ কাজ করে। এটা অত্যন্ত গর্বের বিষয়। আগেই বলেছি ফ্রিল্যান্সার হবার কোন ইচ্ছা আমার ছিল না। খোদার পরিকল্পনা ছিল ভিন্ন।
আব্বা এত দ্রুত মারা না গেলে হয়ত এখনো আমি সেলসেই থাকতাম। সেলসের সর্বচ্চ পর্যায়ে যাবার ইচ্ছা ছিল আমার। এতদিনে হয়ত সেই পর্যায়ে বা তার কাছাকাছি চলে যেতাম। কিন্তু বিশ্বাস করেন এসব নিয়ে এখন আমার বিন্দুমাত্র আফসোস নেই। আমি এখন যা আছি এবং এই পর্যন্ত যা পেয়েছি তাতে আমি আল্লাহর দরবারে লাখ কোটি শুকরিয়া আদায় করি। কারন আল্লাহ্ আমার জন্য যা রেখেছেন তাতেই আমার সর্বচ্চ কল্যান রয়েছে। আমার বন্ধুরা আমার শুভাকাঙ্ক্ষীরা ভাল পজিশনে আছে এটা আমার জন্য খুবই গর্বের বিষয়। তাদের জন্য মনের গভীর থেকে দোয়া করি। তারা যেন আরো ভাল থাকে আরো উন্নতি করে।
অনেকেই চাকরীর বদনাম করে। আমি বলি সবার জন্য সব কিছু না। সবাই যদি ফ্রিল্যন্সার বা উদ্যক্তা হয় তবে চাকরী করে করবে। একজন উদ্যোক্তা হওয়া যে সে ব্যাপার না। মাত্র ১% লোক এটা হতে পারে। কাজেই সব চাকরী যে খারাপ এটা ভুল ধারনা। ভাল ভাবে সততা এবং নিষ্ঠার সাথে কাজ করলে চাকরিতেও যে কেউ ভাল করতে পারে। আমি আমার আগের জব এবং বসেদের কাছে কৃতজ্ঞ আমাকে পুরা আলাদা একটা মানুষে পরিণত করার জন্য। আমার এই পর্যন্ত যা অর্জন সেটা সেই বসেদের এবং চাকরীর কারনেই। এই কৃতজ্ঞতা আমার আজীবন থাকবে।