ফ্রিল্যান্সারের ভ্যাকেশন ভাবনা
ফ্রিলান্সিং এর আগে যখন জব করতাম, তখন ছুটি ছিল না বললেই চলে, এটা ছিল সোনার হরিণের মত। মনে আছে শুক্রবার ছুটির দিন কচ্ছপ গতিতে এসে, খরগোশ গতিতে পার হয়ে যেতে। আর লম্বা ভ্যাকেশনটা খুবই মিস করতাম। একবার অফিসে যাওয়ার পথে, মারাত্মক মোটরসাইকেল এক্সিডেন্ট করেছিলাম। বাম পাটা প্রায় দুই টুকরা হয়ে যায় এমন অবস্থা। অথচ শুনলে আবাক হবেন, আমার মনে মনে বেশ আনন্দ হচ্ছিল এই ভেবে যে, যাক বেশ কিছু দিন ছুটি পাওয়া যাবে। কিন্তু কপাল ছিল খারাপ, মাত্র ৪ দিন রেস্ট নেয়ার পরেই, সেই আহত অবস্থায়ই অফিসে জয়েন করি। তাদের যুক্তি হচ্ছে এটা যেহেতু অফিশিয়াল ডেস্ক জব, তাই ভাঙা পা নিয়েও, বসে বসে কাজ করা যায়। আসলে তখন থেকেই চাকরীর প্রতি এক চরম বিতৃষ্ণা কাজ করা শুরু করে। একটু স্বাধীনতা পাবার আশায় ফ্রিলান্সিংএ আসলাম। স্বাধীনতা পেলেও, সেই ভ্যাকেশন কি আদৌ পেয়েছি? আমার মনে হয় না। আমার মত যারা ফুলটাইম ফ্রিলান্সিং করেন, আমার মনে হয় তারাও একমত হবেন।
মজার কথা হচ্ছে, বছরের সব সময় সমান ভাবে কাজ আসে না। বায়ারেরাও ভ্যাকেশন নেয়। কাজেই একটু মাথা খাটালে, ফ্রিলান্সিং এর এই ব্যাস্ত জীবনের পাশাপাশি একটু ভ্যাকেশনও উপভোগ করা যায়। আর এটা নিয়েই আমার আজকের এই লেখা। গত কিছুদিন আগে USA তে থ্যাংকস গিভিং ডে গেল, পরের দিন ছিল ব্লাক ফ্রাইডে, এই দুই দিন সরকারী ছুটি। এর পরে আবার শনি এবং রবি বার সাপ্তাহিক ছুটি। মোট চার দিন টানা ভ্যাকেশন ছিল। বায়ারেরা সবাই ছুটিতে ছিল। বিদেশে ছুটি মানে ছুটি। দুনিয়া উল্টে গেলেও, তারা ছুটি উপভোগ করবে। অন্য কিছু করবে না। আমি জানি, এই চার দিনের ছুটির কথা অনেকেই জানেন না। বিশেষ করে নতুনেরা। অনেকেই হয়ত পিসির সামনে বিনিদ্র রজনী কাটিয়েছেন, যদি কোন অর্ডার আসে। এই কয় দিন আমিও তেমন অর্ডার পাইনি। আপনাদের কি অবস্থা জানি না। যা হোক আমার ফ্রিলান্সিং লাইফের শুরুর দিকের একটা রহস্যময় অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে পারি।
সেটা ২০১৪ সালের কথা। ফ্রিলান্সিং লাইফ শুরু হয়েছে। Fiverr এ প্রোফাইল খুলে গিগ দিয়েছি। সেই সময়ের Fiverr আর বর্তমান Fiverr এর মধ্যে বিস্তর তফাৎ। এখনকার মত মাছের বাজার ছিল না। প্রফেশনালি গিগ দিলেই কাজ পাওয়া যেত। বলা যায় আমরা ফাঁকা মাঠে গোল দিতাম। যা হোক, Fiverr এ গিগ দেয়ার পর থেকেই ভাল কাজ পাচ্ছিলাম। যেহেতু নতুন তাই খুবই এক্সাইটেড ছিলাম। কিছুদিন পর দেখি কাজ আস্তে আস্তে কমা শুরু হয়েছে। সেটা নভেম্বরে্র একেবারে শেষের দিকের কথা। ডিসেম্বরে এসে ভয়াবহ অভিজ্ঞতা হল। যেখানে দিনে ২/৩ টা কাজ পেতাম, সেখানে সপ্তাহে ২/৩ টা পাই কিনা সন্দেহ। খুবই খারাপ লাগত তখন। বায়ারদের মেসজ দেয়া শুরু করলাম। প্রায় কেউই রিপ্লাই করে না। ধরে নিলাম ফ্রিলান্সিং এখানেই শেষ। জানুয়ারির শুরুতেও একই অবস্থা। জানুয়ারির শেষের দিক থেকে, অবস্থা আস্তে আস্তে ঠিক হতে শুরু করল। আবার অর্ডার পাওয়া শুরু করলাম। ফেব্রুয়ারীতে এসে আবার সব ঠিক হল, এবং বছরের বাকী সময় অর্ডার এবং ইনকামের পরিমান বাড়তেই থাকল। ডিসেম্বর, আর জানুয়ারি এই দুই মাস খুব খারাপ সময় গিয়েছে। তবে ধৈর্য হারাইনি (যেটা একজন ফ্রিলান্সারেরে সবথেকে বড় গুন)। এই সময় বসে না থেকে কাজ শিখেছি এবং নিজেকে আপগ্রেড করেছি। যার সুফল এখনো পাচ্ছি।
এখন প্রশ্ন হল, কেন এমন হয়েছিল? মনে আছে, আমার এক রেগুলার বায়া্ ছিল নাম Julie, আমেরিকান। প্রতি সপ্তাহেই ২/৩ টা কাজ দিত। সেই দুই মাসে Julie র ও কোন খবর নাই। পরে বিভিন্ন ফোরাম, ব্লগে, ঘাটাঘাটি করে আসল কারন জানলাম। আর সেটা হচ্ছে, Fiverr এর বেশির ভাগ বায়ার আমেরিকান। ডিসেম্বর, জানুয়ারীতে, ওখানে প্রচুর ঠাণ্ডা পড়ে, তুষারপাত হয়। প্রায় সবাই বাড়িতে আটকা পড়ে থাকে, কাজ নাকি তেমন একটা করতে পারে না। এছাড়া এটা উৎসবের মৌসুম। ক্রিস্টমাস , নিউ ইয়ারত আছেই। তখন অনেকেই লম্বা ছুটিতে বেড়াতে যায়। যেমন Julie তার ফামিলি নিয়ে ২ মাসের ছুটিতে বেড়াতে গিয়েছিল। তাই এই সময়টা ফ্রিলান্সারের জন্য ডাল সিজন। দেশের অনেক ফ্রিলান্সারের সাথে আলাপ করেও এর সত্যতা পেয়েছি। এই সময় কাজ অনেক কমে যায়। অবশ্য সবার ক্ষেত্রে এটা নাও হতে পারে। এটা মূলত আমার মত খুদ্র ফ্রিলান্সারের জন্য বেশি প্রযোজ্য, যারা বিভিন্ন ছোটখাট কাজ করে মার্কেটে টিকে আছে। বড় ফ্রিলান্সাররা যারা অনেক বড় বড় চাহিদা সম্পন্ন কাজ করে থাকেন, তাদের ক্ষেত্রে এটা খাটবে না। গত পাঁচ বছর মোটামুটি এই ধারাই দেখে আসছি।
তবে কিছু কথা থাকে। এই ডাল সিজনেও অনেকের ভাল ইনকাম হয়। যেমন যারা এডসেন্স, এফিলিয়েট মারকেটিং করেন বা ড্রপ শিপিং এর কাজ করেন। তাদের ডিসেম্বরে প্রচুর ইনাকাম হয়, যেটা বছরের অন্য সময় হয় না। কারন ডিসেম্বর হচ্ছে কেনা কাটার মাস। গত পাচ বছরের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, আরও কিছু দিন কাজ আসবে বিশেষ করে ক্রিসমাস এবং নিউইয়ার রিলেটেড অনেক কাজ বায়ারেরা ফ্রিলান্সারদের দিয়ে করিয়ে নেবে। এর পরে তারা লম্বা একটা ছুটিতে যাবে। বছরের শুরু দিকেও কিছু দিন কাজ কম আসবে। এর পরে আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে। কাজেই এটা নিয়ে চিন্তার কিছু নেই।
এখন কথা হচ্ছে ফ্রিল্যান্সার হিসেবে আমরা এই সময়টাতে কি করতে পারি। বিষয়টা খুব ইজি, সেটা হচ্ছে এই সময়টা নিজের স্কিল ডেভেলপমেন্টে কাজে লাগাতে পারি। নতুন বছরের প্লানিং রেডি করে ফেলতে পারি। কে না জানে সঠিক পরিকল্পনা কাজের অর্ধেক। আরও যেটা করা যেতে পারে, বায়ারের মত আমারাও কিছু দিনের জন্য ভ্যাকেশনে চলে যেতে পারি। দেশের মধ্যেই এখন অনেক সুন্দর সুন্দর জায়গা আছে ঘোরার। এছাড়া কম খরচেই দেশের বাহিরে এখন ট্যুর দেয়া যায়। ৪/৫ জনের গ্রুপ করে ট্যুর দিলে খরচ অনেক কমে যাবে। এই ঘোরাঘুরির সময়টাতে আড্ডার পাশাপাশি অনেক নলেজ শেয়ার হবে, নেটওয়ার্কিং হবে। এমনও হতে পারে নতুন কোন চমৎকার আইডিয়া পেয়ে যেতে পারেন। আর ভ্যাকেশন থেকে আসার পরে আপনি ১০০% ফুল রিচারজড হয়ে আসবেন, এতে কোন সন্দেহ নেই। আপনার কাজে উদ্যম বাড়বে, নতুন কিছু করার অনুপ্রেরণা পাবেন।
সবাই ভাল থাকবেন।
ধন্যবাদ!