আমার স্মৃতিতে ফাহিম উল করিম
আপনারা সবাই জানেন, বাংলাদেশের অনলাইন ফ্রিল্যান্সিং জগতে সবার আইডল, Fiverr এর কমুনিটি লিডার, লেভেল-২ সেলার, এবং আপওয়ার্ক এর টপ রেটেড ফ্রিল্যান্সার, ফাহিম উল করিম ভাই, আমাদের মাঝে আর নেই। গত ১২ই নভেম্বর ২০২০, তিনি আমাদের ছেড়ে অনন্তের পথে যাত্রা করেছেন (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন), মহান রাব্বুল আলামিনের কাছে, এই দোয়া করি, তিনি যেন আমাদের ফাহিম উল করিম ভাইকে, জান্নাতুল ফেরদৌসের উচ্চ স্থানে তাকে সুখে শান্তিতে রাখেন। আমিন!
আসলে তাকে নিয়ে এভাবে লিখতে হবে কখনো ভাবিনি। যে মানুষটার সাথে প্রায় প্রতি সপ্তাহেই, বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা হত, সুখ দুঃখ, আনন্দ ভালবাসা, একসাথে ভাগাভাগি করতাম, সেই মানুষটাকে নিয়ে স্মৃতিকথা লিখতে হবে, ভাবতেই ব্যথায় বুকটা ভেঙ্গে যাচ্ছে। তাকে নিয়ে কোন লেখা দেব না, এই পণ করেছিলাম, কারন তাকে নিয়ে এত সৃতি জমা হয়েছে এবং সব থেকে বড় কথা, তার কাছে আমি যে পরিমাণ ঋণী, সেটা আসলে লেখার ভাষায় ফুটিয়ে তোলা সম্ভব না। তার পরেও আমি লেখার চেষ্টা করছি, কারন এর মাধ্যমে, তার প্রতি কিছুটা হলেও কৃতজ্ঞতা জানানো হবে। যে কথা গুলো আমি আসলে কাউকে কোন দিন বলিনি।
তাকে সেই ২০১৬ সাল থেকেই চিনি। সম্ভবত ২০১৭ সালের দিকে তার সাথে, চ্যাট করা শুরু হয়। ২০১৮ সালে তার সাথে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। আমার লেখালেখির একজন বড় ভক্ত তিনি ছিলেন। একবার মনে আছে, তার ফেসবুক গ্রুপে, রাগ করে কিছুদিন লেখা দেইনি। কারন কিছু দুষ্ট লোক, আমার পিছনে লেগেছিল। তাঁদের অনেককেই দেখতাম, আমার লেখায় আজে বাজে কমেন্ট করতে। তিনি একদিন আমাকে মেসেজ করে বললেন, ভাইয়া আপনার লেখা আমাদের গ্রুপে অনেক দিন ধরে দিচ্ছেন না কেন? আপনি কি রাগ করেছেন? এখন থেকে আপনার সব লেখা আমাদের গ্রুপে দেবেন। অনেকটা আদেশের সুরে কথা গুলো বললেন। তাকে কথা দিলাম। আসলে বয়সের তুলনায়, সে ছিল অনেক বেশি পরিপক্ক, আমার কিছু বলা লাগল না, তার আগেই আমাকে বলল, কেউ যদি আপনার লেখায় আজে বাজে কিছু বলে, জাস্ট আমাকে একটা মেসেজ করবেন। এর পর থেকে, কেউ আজে বাজে কমেন্ট করলেই, তাকে মেসেজ করতাম। সাথে সাথেই একশন। জানিনা এমন শুভাকাঙ্ক্ষী আর কাউকে পাব কিনা।
এবার আসি তার প্রতি কৃতজ্ঞতার ব্যাপারে। একজন ফ্রিল্যান্সারের জীবনে উত্থান-পতন থাকবেই, আমার এই ৬ বছরের ফ্রিল্যনাসিং লাইফেও সেটা ছিল। আর এই জন্য আমি সবাইকে, সব সময় প্লান বি রেডি রাখার ব্যাপারে বলি। এর উপর আমার একটা লেখা, বছর দুই আগে বেশ ভাইরাল হয়েছিল। কিন্তু আমি যে এর ভুক্তভুগী হব, সেটা আমার কল্পনাতেও ছিল না। আমি মূলত Fiverrএ কাজ করতাম। অন্য মার্কেটপ্লেসে প্রোফাইল থাকলেও, কখনো কাজ করিনি। কারন Fiverr এ এত বেশি কাজ পেতাম যে, আমি এবং আমার টিম মিলে কাজ করেও শেষ করতে পারতাম না। তাই অন্য কোথাও কাজের কথা বললেও, আসলে কাজ করা হয়ে ওঠেনি। ২০১৮ সালে তুচ্ছ একটা কারন দেখিয়ে, ৪৫০০+ রিভিউ এবং ৫৫০০+ কমপ্লিটেড কাজ সহ, আমার Fiverr একাউণ্ট ব্যান, করে দেয়া হয়। এই একটা একাউন্টের উপর আমি, আমার পরিবার এবং একটা বড় অফিস নির্ভরশীল ছিল। অফিসের পিছনে, অনেক বড় ইনভেস্ট করে ফেলেছিলাম, আশা ছিল বড় কিছু করব, বলা যায় আমার সঞ্চয়ের প্রায় পুরাটাই এর পিছনে দিয়েছিলাম। এই একাউন্ট চলে যাওয়া ছিল, আমার কল্পনারও বাহিরে। চার বছর ধরে তিলে তিলে গড়ে ওঠা, নিজের সন্তানের মত একটা এক্তাউন্ট, এভাবে এক মুহূর্তে চলে গেলে, সেটার যে অনুভুতি, সেটা আসলে বাস্তব অভিজ্ঞতা ছাড়া বোঝানো সম্ভব না। আমার একেবারে দিশেহারা অবস্থা। ছোট ছোট বাজেটে কাজ করতাম বলে আমার বায়ার ছিল অনেক। ২২০০+ বায়ারের সাথে কাজ করেছি, অথচ বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না, এক জনেরও কন্টাক্ট ইনফরমেশন রাখিনি। একাউণ্ট হারাবার পরে, পাগলের মত নেটে আমার বায়ারদের খুজতে লাগলাম। যত ধরনের ট্রিক্স আছে, নেট ঘেটে কাজে লাগিয়ে, মাত্র ২৫ জন বায়ারকে খুঁজে বের করলাম। এর মধ্যে মাত্র ১৫ জন রিপ্লাই দেয়, যাদের বেশির ভাগই ছোট বায়ার। ধরেই নিলাম এখানেই সব শেষ।
তার পরেও আশা ছাড়ীনি। এই সামান্য কয়েকজনকে নিয়েই আপওয়ার্কে কাজ শুরু করি। কয়েকটা কাজ করার পরে, তাদেরও কাজ শেষ হয়ে যায়। Fiverr কে ধ্যানজ্ঞান মানা আমার কাছে, Upwork পুরাপুরি এক অচেনা জগত। এই অচেনা জগত চেনাতে কাছের যে ২/৩ জন আমাকে হেল্প করেছে, তার মধ্যে ফাহিম ভাই প্রধান। আসলে তার কাছে আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। বিড করি কিন্তু কোন কাজ পাই না। Fiverr এ কোন কাজই নেই। কি যে এক বাজে অবস্থা, বলে বোঝানো সম্ভব না। ২০১৮ সালের কোন এক সকালে, তিনি আমাকে ঘন্টার উপর সময় দেন। Upwork নিয়ে অনেক আলাপ হয়। কোন সময় বায়ার বেশি থাকে, কিভাবে কভার লেটার লিখতে হয়, কিভাবে কাজে পেতে হয় Upwork নিয়ে এমন কোন বিষয় নেই যে, তিনি আমকে বোঝান নাই। আমি এখনো তার দেয়া কভার লেটার মডিফাই করে ইউজ করি। আসলে কিভাবে এসবের কৃতজ্ঞতা জানাব, সেটা আমার জানা নেই। তার মাধ্যমেই জানতে পারি Upworkএর টপ রেটেড ফ্রিল্যন্সারদের একটা প্রাইভেট গ্রুপ আছে, এটা জানার পর থেকে অপেক্ষা করেছি কবে Top Rated হব। যেদিন Top Rated হলাম সেদিনই তাকে জানালাম। তিনি আমাকে ওই গ্রুপে এড করে দেন। আমি নতুন এক জগতে প্রবেশ করি। বাংলাদেশের টপ প্রফেশনাল ফ্রিল্যান্সারদের সান্নিধ্যে আসার সুযোগ হয়। আর এসব কিছুর যোগসুত্র ছিলেন তিনি। কিভাবে এর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি।
মাস খানেক আগে আপওয়ার্কে Top Rated Plus হয়েছি, এটা টপ রেটেড এর বড় ভাই বলা যায়। অনেক বড় একটা অর্জন, কিন্তু আফসোস লাগে মানুষটাকে এই সুখবরটা দেয়ার আগেই সে চলে গেল। স্বীকার করতে দোষ নেই Fiverr থেকে এখন আমার Upwork এ ফোকাস বেশি। Fiverr থেকে বিশ্বাস অনেক আগেই উঠে গেছে। তাই যারা এখনো শুধু Fiverr নিয়ে পড়ে আছেন তাঁদের সবাইকে বলি প্লান B রেডি করতে। আসলে Upworkএ জয়েন করার পরে, প্রফেশনালি অনেক কিছু শিখতে পারি। প্রথম বারের মত Trello, Basecamp, Slack এর মত প্লাটফরম ইউজ করা শিখি। প্রথম বারের মত বায়ারের সাথে ভিডিওতে কথা বলি, যেগুলো এখন আমার দৈনন্দিন কাজের অংশ। এগুলো আসলে Fiverr এ করা কোন মতেই সম্ভব না, কারন তারা এটা এলাও করে না। আমি আসলে Fiverrকে ছোট করছি না। একেক মার্কেটপ্লেসের একেক ধরনের সুবিধা অসুবিধা আছে। আমি এখন দুই মার্কেটপ্লেসেই সমান তালে কাজ করছি। ২০১৯ এর ডিসেম্বরে আমার চাচার স্ট্রোক হয়। তখন বাধ্য হয়ে আমার FIverr এর প্রোফাইল বেশ কিছু দিন বন্ধ রাখতে হয়, এবং কয়েকটি অর্ডার ক্যান্সেল করতে হয়। বুঝতেই পারছেন আমার গিগের র্যাঙ্ক চলে যায় এবং ৬ মাস পর্যন্ত কাজ একবারে তলানিতে চলে যায়। এর পরেও আলহামদুলিল্লাহ আমি টিকে গেছি, কারন Upwork থেকে আমার নিয়মিত কাজ আসছিল। আমি ফাহিম ভাইয়ের কাছে কৃতজ্ঞ যে, এভাবে আমার প্লান B সফল হতে সাহায্য করার জন্য।
মজার ব্যাপার হচ্ছে তার সাথে আমার নিয়মিত যোগাযোগ হচ্ছে, কিন্তু আমি জানতামই না যে, যার সাথে আলাপ করছি, সে আমার মত সুস্থ মানুষ নয়। ২০১৯ সালে প্রথম আলোর একটা ফিচার থেকে জানতে পারি যে, আমাদের ফাহিম ভাই ১০ বছর ধরে বিছানাবন্দি। সাংবাদিকেরা নেগেটিভ জিনিস বেশি প্রচার করে। হলুদ সাংবাদিকতার একটা অংশই হচ্ছে, নেগেটিভ জিনিস খুঁজে বের করে সেটা হাইলাইট করা। সেই পোষ্ট থেকে জানতে পারলাম, এক দুরারোগ্য ব্যাধিতে তার পুরা শরীর অবশ, ডান হাতের মাত্র তিনটা আঙুল এবং ডান পায়ের পাতাটা শুধু নাড়াতে পারেন। আর এই সামান্য যোগ্যতাটুকু দিয়েই তিনি তার সব কাজ করেন। এটা জানার পরে নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল আমি খুব অন্যায় করে ফেলেছি। কারন তার সাথে দিনের পর দিন যে চ্যাট করেছি, তার এগুলো লিখত্ না জানি কত কষ্ট হয়েছে।
এর পর থেকে, তার সাথে যোগাযোগ করতে চাইলে আগেই বলতাম যে আমি কল দেই। তিনি সব সময় না করতেন। কারন তার সাথে রাতে বেশি যোগাযোগ হত, আর এত রাতে কথা বলতে গেলে সবার ঘুম নষ্ট হবে। পরিবারের প্রতি এতটাই খেয়াল ছিল তার। মনে আছে একটা পোষ্টে তিনি বলেছিলেন, তার বাবা যখন ATM থেকে টাকা উঠিয়ে, পকেটভর্তি করে বাসায় আসেন, তখন গর্বে তার বুকটা ভুলে ওঠে, মনে হয় পরিবারের জন্য কিছু একটা করতে পেরেছি। অনেকেই হয়ত জানেন না যে, তিনি ছিলেন তার পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যাক্তি। কারন তার বাবা একটা এক্সিডেন্টে, কোমরে প্রচন্ড ব্যাথা পান। কাজ করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন, তার চাকরি চলে যায়। এর পর থেকে ফাহিম ভাইই ছিল পরিবারের একমাত্র অবলম্বন।
প্রথম আলোর এই ফিচার পাবলিশ হবার পর থেকেই, ফ্রিল্যান্সার হিসাবে তার অর্জন আড়াল হয়ে যায়। সাবাই তার এই শারীরিক প্রতিবন্ধিতাকে বেশি ফোকাস করতে থাকে। এটার জন্য তিনি মাঝে মাঝে আফসোস করতেন। অন্যের দুঃখে দুঃখিত হওয়া খুব সহজ, কিন্তু অন্যের সুখে সুখী হওয়া খুব কঠিন। তিনি অন্যের করুনার পাত্র হতে চাইতেন না, অন্যের কাছে সাহায্যের জন্য আবেদন করতে তার খুবই অনীহা ছিল। ফলে যেটা হয়েছে, তার কোন সুচিকিৎসা হয় নাই। এই মারা যাবার কিছু দিন আগে, চিকিৎসার জন্য তার ঢাকায় আসার কথা ছিল। ফ্রিল্যান্সিং এর ইনাকামের টাকা দিয়ে, কিছুদিন তার চিকিৎসা হয়েছিল, ব্যাস এতটুকুই। চিকিৎসার জন্য অন্যের কাছে হাত পাত্তে তার প্রচণ্ড অনীহা ছিল। তার আত্মসম্মানবোধ ছিল প্রবল। মনে আছে দেশের বড় Upwork রিলেটেড একটা ফেসবুক গ্রুপ, তাকে একরকম আমন্ত্রণ জানিয়ে গ্রুপের মোডারেটর বানায়। আবার কিছুদিন পরে, ঘাড় ধাক্কা দিয়ে গ্রুপ থেকে বেরও করে দেয়। তার অপরাধ ছিল, তিনি ওই গ্রুপ থেকে আয়োজন করা, ফ্রিল্যান্সারদের সম্মানার প্রতিযগিতায়, আবেদন করেছিলেন। এটা নাকি তাঁদের গ্রুপের রুলসের ভায়লেশন, এই জন্য তাকে বিনা নোটিশে গ্রুপ থেকে ব্যান করা হয়। এত বড় অপমান আসলে কারো পক্ষে মেনে নেয়া মুশকিল। তিনি শুধু বলেছিলেন, I will see it. এবং তিনি সেটা করে দেখিয়েছিলেন। সেই বছরই মাননীয় আইসিটি মন্ত্রী তার জেলায় নিজে এসে বিশাল প্রোগ্রাম করে তাকে সম্মাননা দেন। কিছু দিন আগেই তার জেলা থেকে, বেসিসের সেরা ফ্রিল্যান্সার নির্বাচিত হন। Fiverr এর কমুনিটি লিডার হওয়া প্রমান করে, তিনি আসলে কত বড় মাপের লিডার ছিলেন। Fiverr তার শারীরিক প্রতিবন্ধিতার জন্য তাকে নির্বাচিত করেনি, করেছে তার লিডারশীপ কোয়ালিটির জন্য। কেউ অপমান করলে, বা পেছন থেকে খোঁচালে, তার সাথে লাগতে যেয়ে শক্তি অপচায় করা বোকামি। এই প্রসঙ্গে, ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া, আমার একটা পোষ্ট উল্লেখ করতে পারি
“কাঁক যখন ঈগলের ঘাড়ে বসে ঠোকর দিয়ে তাকে বিরক্ত করে, ঈগল তখন তার সাথে লাগতে যেয়ে, সময় ও শক্তির অপচয় করে না। সে তার গতিবেগ বাড়িয়ে দিয়ে, কাঁককে ঘাড় থেকে খসিয়ে ফেলে। ঠিক এভাবেই, বুদ্ধিমানেরা কাজের পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়ে, সফল হয়ে, অপমানের জবাব দেয়” ফাহিমা ভাইও সেই কাজটিই করেছিলেন। তার কাছ থেকে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে।
ফ্রিল্যান্সিংএর টাকায় অনেক আগেই সস্তায় এক টুকরো জমি কিনেছিলেন, স্বপ্ন ছিল নিজেদের একটা বাড়ি হবে। মারা যাওয়ার কিছু দিন আগেই, নতুন বাড়িতে উঠে, সেই স্বপনের বাস্তবায়ন করেছিলেন। তিনি চাইলেই এই টাকায় নিজের চিকিৎসা করাতে পারতেন। কিন্তু তার কাছে তার পরিবার ছিলে আগে। আসলে তিনি তার জীবন দিয়ে, পরিবারের প্রতি তার দায়বদ্ধতা মিটিয়েছেন। আপনারা হয়ত বলতে পারেন, তার যে দুরারোগ্য রোগ হয়েছিল, তাতে তিনি আর কয় দিনই বাঁচতেন। এটা পুরাপুরি ভুল ধারণা। বিজ্ঞানী স্টীফেন হকিংসের তার থেকে বেশি জটিল রোগ ছিল। ২১ বছর বয়সে যখন তার রোগ ধরা পড়ে, তখনই ডাক্তারের বলেছিলেন যে তিনি আর বড় জোর, কয়েক মাস বাঁচবেন। অথচ অত্যাধুনিক চিকিৎসার কারনে ৭৬ বছর বেঁচে তার কর্মের মাধ্যমে পৃথিবীকে ঋণী করে, এই সেদিন ২০১৮ সালে তিনি মারা যান। আমাদের ফাহিম ভাইও যদি একটু সুচিকিৎসা পেতেন তবে, কে জানে হয়ত আরও বেশ কিছু দিন তিনি আমাদের মাঝে থাকতেন। আফসোস লাগে, তিনি আসলে ভুল সময়ে, ভুল দেশ জন্মেছিলেন। তবে তিনি আমাদের মনের মধ্যে, বাংলার স্টীফেন হকিংস হয়ে চিরদিন বেঁচে থাকবেন।
তিনি যেভাবে তার লেখার মাধ্যমে, তার নিজের প্লাটাফরমের মাধ্যমে, নতুন নতুন ফ্রিল্যান্সার তৈরিতে অবদান রেখে গেছেন, তার জন্য আমরা সবাই তাকে কৃতজ্ঞ চিত্তে স্মরণ করব। আমার মত অসংখ্য মানুষকে সঠিক গাইড লাইন দিয়ে, ঋণী করে গেছেন। অন্যদের কথা জানি না, আমাকে আল্লাহ যতদিন ফ্রিল্যান্সিং করার তৌফীক দেবেন এবং যতদিন বাঁচিয়ে রাখবেন, ততদিন তাকে কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করব, দোয়া করব। আফসোস লাগে, আমাদের দেশের বেশির ভাগ তরুণ তরুণীদের ফ্রিল্যান্সিং এর সাথে পরিচয় ঘটে, ফ্রিলান্সার কাশেম, আর জামাল OX এর মত প্রতারকদের মাধ্যমে। যাদের মূল টার্গেট হচ্ছে, স্কুল কলেজ পড়ুয়া টিনেজ ছেলে মেয়ে, বেকার যুবক যুবতী, কষ্টে থাকা প্রবাসী ভাইয়েরা, যাদের মধ্যে আবেগ কাজ বেশি করে। তাঁদের এই আবেগকে কাজে লাগিয়ে, ফ্রিল্যান্সিং এর মাধ্যমে লাখ টাকার স্বপ্ন দেখিয়ে, ট্রেনিং এর মাধ্যমে টাকা হাতিয়ে নেয়াই তাঁদের মূল পেশা। ফেক এপস এর কাছ থেকে কমিশন নিয়ে, এটা দিয়ে ইনকাম করা যায়, এই মুলা ঝুলিয়ে, সেটার উপর ভিডিও বানিয়ে ধোঁকা দেয়া, ১৮+ ট্যাগ ইউজ করে ইউটিউবে ফ্রিল্যান্সিং এর ভিডিও র্যাঙ্ক করানো, ফ্রি কোর্সের মুলা ঝুলিয়ে, হাজার হাজার তরুনের কাছে কোর্স বিক্রি করা, এসবের সব কিছুই জানি। কিন্তু দেখেও কিছু করা নেই, লেখার মাধ্যমে প্রতিবাদ করা ছাড়া। আফসোস লাগে, এই দেশে আইনের শাসন সেভাবে নেই। না হলে এই সব প্রতাকরকের স্থান, হত জেলখানার গরাদের ওপাশে।
যারা এদেরকে আইডল মানেন, তাদেকে বলছি, শয়তান যার আইডল হয়, তাকে দিয়ে আর যাই হোক ভাল কিছু হবে না। মনে রাখতে হবে শয়তান মানুষকে ধোঁকা দেয় মিষ্টি কথা বলে, আর ভাল মানুষের রূপ ধরে। প্রতারিত হবার পরে এদের চরিত্র ধরা পড়ে। অথচ আমাদের ফাহিম ভাইকে যদি আইডল মানতাম, তবে অবশ্যই আমাদের দ্বারা ভাল কিছু হত। ১০ বছর ধরে বিছানায় শয্যাশায়ী একজন মানুষ, যার মাত্র কয়েকটা আঙুল নড়ে, সেই মানুষ এতটা সফল। অথচ আমাদের হাত পা চোখ কান সুস্থ থাকার পরেও, শিক্ষাগত যোগ্যতা, হাইস্পিড ইন্টানেট থাকার পরেও আমাদের সময় কাটে, বিভিন্ন গ্রুপে আমাদের বার্থতার গল্প শেয়ার করে, আর হা হুতাশ করে। আমাদের লজ্জা হওয়া উচিৎ। আর ওইসব প্রতাকরদের উদ্দেশ্যে বলব, তোমরা ফাহিম ভাইয়ের জীবন থেকে শিক্ষা নাও। ফাহিম ভাই মারা যাবার পরে সবাই কি বলছে, আর তোমরা মরার পরে কি বলবে। মনে রাখবা পরকাল বলে একটা জিনিস আছে। এই জগতে পার পেয়ে গেলেও, পরকালে আল্লাহর পাকড়াও হবে অনেক কঠিন।
পরিশেষে বলব, যে মানুষটা বায়প্রাপ্তির আগেই জীবনটা বিছানার মধ্যে বন্দি হয়ে গেছে। তার দ্বারা আর যাই হোক কোন পাপ করা সম্ভব না। ২২ বছরের ছোট্ট জীবনের ১০ বছরই কেটেছে বিছানায়, সেই মানুষটা আর কি পাপ কাজই করতে পারে। তার পরেও মানুষ হিসাবে সামান্য কোন ভুল ত্রুটি যদি থেকেই থাকে, তবে আমাদের মত সাধারণ মানুষের এত শ্রদ্ধা ভালবাসা, অশ্রু সজল চোখে খোদার কাছে দোয়ার উসিলায়, আল্লাহ নিশ্চয়ই তাকে মাফ করে, কবুল করবেন। সাহাবীদের কোন এক বৈঠকে, আমাদের রসুলুলুল্লাহ (সাঃ) একবার একটু মজা করে বলছিলেন যে , কুৎসিত কালো কেউ জান্নাতে প্রবেশ করবে না। এই কথা শুনে একজন কালো কাফ্রি মহিলা সাহাবী, খুব করে কাঁদতে লাগলেন। সুলুলুল্লাহ (সাঃ) জিজ্ঞেস করলে তুমি কাঁদছ কেন? সে বলল ইয়া রসুলুল্লাহ, আমি কালো কুৎসিত নারী, আর এই জন্য আমি জান্নাতে যেতে পারব না। তখন মুচকি হেসে সুলুলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, আসলে জান্নাতে যাবার আগে প্রত্যেক জান্নাতিকে সর্বোত্তম রূপে, সুশ্রী করে, এর পরে প্রবেশ করাবে। কাজেই তোমার চিন্তার কিছু নেই। তোমার এই চেহারা পরিবর্তন করে সুশ্রী, সুন্দরী করে, আল্লাহ তোমাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। একবার একটা ছবিতে দেখেছিলাম একজন প্যারালাইজড ব্যাক্তি সুইমিং পুলে পানিতে নেমে সোজা হয়ে দাড়িয়ে আছেন। তার খুব ইচ্ছা ছিল নিজে নিজে দাঁড়ানোর, যেটা পানি ছাড়া সম্ভব না। আমাদের ফাহিম ভাইয়েরও নিশ্চয়ই খুব ইচ্ছা ছিল, সুস্থ সবল ভাবে দাড়াবার। এই জনমে সেটা সম্ভব না হলেও, ওপারে নিশ্চয়ই সুস্থ শরীরে, নিজের পায়ে ভর দিয়ে আয়েশ করতে করতে আমাদের দেখছেন।
সব শেষে আমার একটা আক্ষেপের কথা বলে পোষ্টের ইতি টানব। খুব ইচ্ছা ছিল তার সাথে সরাসরি দেখা করার। গত বছর কুষ্টিয়া বেড়াতে গিয়েছিলাম। তার বাড়ির এত কাছে গিয়েও কেন তার সাথে দেখা করলাম না, সেই জন্য সে রাগ করেছিল। তাকে বলেছিলাম একদিন আসব, শুধু তার সাথে দেখা করতে। আফসোস লাগে, আমার সেই আশা আর পূরন হল না। তবে আশা রাখি, পরকালে ইনশাল্লাহ আপনার সাথে দেখা হবে। আল্লাহ যেন আপনাকে জান্নাতুল ফিরদাউসের উচ্চ স্থানে সুখে শান্তিতে রাখেন। এই জীবনে অনেক কষ্ট করে গেলেন, পরকাল যেন আপনার আনন্দময় হয়। মহান রবের নিকট এই প্রার্থনা করি। আমিন!