বার্ডস অফ প্যারাডাইস (জান্নাতের পাখিগুলো)

বার্ডস অফ প্যারাডাইস (জান্নাতের পাখিগুলো)

যারা আমার প্রফাইল দীর্ঘদিন ধরে ফলো করেন তারা হয়ত জানেন, আজ থেকে প্রায় আড়াই বছর আগে, পবিত্র রমজান মাসে আমি আমার কলিজার টুকরা ভাতিজীর জন্য আপনাদের দোয়ার জন্য ফেসবুকে পোষ্ট দিয়েছিলাম। তখন আমার ১ মাস বয়সী ভাতিজী প্রচন্ড অসুস্থ হয়ে NICU তে অত্যন্ত সংটাপন্ন অবস্থায় ভর্তি ছিল।

প্রথম তিন দিন তার মধ্যে প্রাণের তেমন কোন লক্ষণ ছিল না। ডাক্তারেরা সব আশাই ছেড়ে দিয়েছিল। নামাজে সেজদায় পড়ে আল্লাহর কাছে ভাতিজীর জন্য কেঁদে কেঁদে জীবন ভিক্ষা চাইলাম। বাসার সবাই একই কাজ করছিলাম। কিন্তু কোন সাড়া পেলাম না, আসলে আমি আমার জীবনে মন থেকে আল্লাহর কাছে এভাবে কিছু চেয়েছি কিনা জানি না। কাঁদতে কাঁদতে বুক ভাসিয়ে ফেলেছি। হঠাৎ মাথায় বুদ্ধি এল, ফেসবুকে আপনাদের সবার নিকট দোয়া চাইলাম।

সেই পবিত্র রমজানে আপনাদের সবার দোয়ার উসিলায়, তিন দিন পর আমার মামনির মধ্যে সামান্য প্রাণের স্পন্দন দেখা গেল। শোকর আলহামদুলিল্লাহ্‌! ডাক্তারের এই ঘটনায় সবাই অবাক। আমি আমার ভাতিজীর জন্য টানা তিন মাস রোজা রাখার মানত করেছিলাম। অবশেষে আল্লাহর রহমতে ৭ দিনের মাথায় মামনি বাড়ি যাওয়ার জন্য মোটামুটি সুস্থ হয়। আমি আল্লাহর কাছে দেয়া আমার ওয়াদা রেখেছিলাম।

টানা তিন মাস রোজা রেখেছিলাম। আপনাদের দোয়ায় আমার মামনি এখন বেশ বড় হয়েছে, সে এখন জ্ঞানীদের মত কথা বলে, মাত্র আড়াই বছরের ছোট একটা মানুষ এখন আমাদেরকে অনেক জ্ঞান দেয়। তাকে কাছে পেলে মনে হয় বুকটা চিরে এর ভিতরে ভরে রাখি। আমার ভালবাসার যন্ত্রনায় সে আমার থেকে একটু দূরে দূরে থাকে। যখন বলি বাবার খিদা লেগেছে একটু দুধ দেবে মা? সে তখন দুই হাত দিয়ে বুক ঢেকে পালায়। সবাই আমার মামনিটার জন্য দোয়া করবেন।

আমার নিজের তিন মেয়ে, এর মধ্যে মেজ মেয়েটা একটু অভিমানি আর জেদি। সে যেটা জেদ করবে, সেটা না আনা পর্যন্ত সে থামবে না। সে যখন রাগ করে তখন দেখলে অবাক হয়ে যাই, এত ছোট মানুষের মধ্যে বড়দের মত এত রাগ কিভাবে আসে। আমাদের সারদিনের কাজ হচ্ছে আমার মামনিদের রাগ ভাঙ্গানো।

গত বছরের ঘটনা, শহরে গিয়েছি একটা কাজে, দুপুরে আমার এক ছোট ভাইয়ের অফিসে গিয়েছি। সে আমার জন্য হোটেল থেকে কাচ্চি আনিয়েছে। মাত্র হাতা গুটিয়ে খেতে শুরু করেছি এমন সময় বাসা থেকে স্ত্রীর কল। স্ত্রী কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগল, আমার মেজ মেয়েকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আমার বাড়ীর পাশে শত্রুর সাথে বসবাস করি, এরা আমাদের জানের দুশমন জমি নিয়ে গন্ডগল।

আমাদের উপর কয়েকবার হামলা করেছে। ধারনা করলাম এরাই কিছু একটা করেছে। কারন শুনেছিলাম এরা আমাদের বড় কোন একটা ক্ষতি করবে যেন সারা জীবন আমাদের আফসোস করতে হয়। এছাড়া বাড়ির পাশে দুইটা বড় বড় পুকুর পাশাপাশি আছে। আমি ফোনে শুধু চিৎকার করে বললাম তাড়াতাড়ি পুকুরে জাল ফেল। বউ বলল ইতিমধ্যে জাল ফেলা হয়েছে। প্রচুর মানুষ পুকুরে নেমে খোঁজ করছে। আমার মাথা কাজ করছিল না। আমি কিভাবে অফিস থেকে বের হলাম, কিভাবে মোটরসাইকেল চালু করলাম জানি না। আমার মনের অবস্থা ভাষায় প্রকাশ করার মত ভাষা আমার জানা নেই নেই। শহরের মধ্যে আমি ঝড়ের বেগে মোটরসাইকেল চালাতে লাগলাম। অন্তত কয়েকটা এক্সিডেন্ট একটুর জন্য হয়নি।

ভাগ্য ভাল যে বড় কোন এক্সিডেন্ট করিনি। মাথা কাজ করছিল না। চলন্ত অবস্থায় মনে হল মোবাইল বাজছে। কি মনে করে মোটরসাইকেলটা রাস্তার পাশে দাড় করালাম। মোবাইল বের করে দেখি, বউ অনেকগুলো কল দিয়েছে। রিসিভ করলাম, সে বলল মেজ মেয়েটাক পাওয়া গিয়েছে। সে রাগ করে আলমারির পাশে চুপ করে বসে ছিল। ছোট মানুষ আল্প যায়গাতে এটে গেছে। মামনিটা আমার এতটাই অভিমানি যে, সবাই চিৎকার করে তার নাম ধরে ডাকছিল, কিন্তু সে সাড়া দিচ্ছিল না। আমি রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলাম। হেলমেটে মুখ ঢাকা ছিল বলে, কেউ বুঝতে পারছিল না যে, একজন পিতা তার সন্তানের জন্য কাঁদছে।

এমন ঘটনা আরো আছে। আমাদের বাসায় মোট ৭ টা বাচ্চা বয়স আড়াই বছর থেকে ১৩ বছর পর্যন্ত। বেশির ভাগ খুবই ছোট। সত্যি বলতে বাচ্চা কাচ্চা হবার পরে আমার নিজের বলে আর কিছু নেই। তাদের ঘিরেই সব। নিজের কোন শখ আলহাদ পূরন করতে ইচ্ছা হয় না। এখন খালি আল্লাহর কাছে এই দোয়াই করি যেন আমার মায়দেরকে বিয়ে দিয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় নিতে পারি। আমার থেকে বাচ্চার মায়ের বাচ্চাদের প্রতি দরদ হাজার গুন বেশি।

তারা সারাটা দিন বাচ্চাদের পিছনেই কাটে। এখন সে আমাকে আর সময় দিতে পারে না। এটা নিয়ে আমার বিন্দুমাত্র আফসোস নেই। বাচ্চাদের সামান্য একটু জ্বর বা ব্যাথাতে সে যেভাবে ভেঙ্গে পড়ে, দেখলেই অবাক হই। সব সময় বাচ্চাদের জন্য দোয়া করি। আল্লাহর কাছে দোয়া করি ওদের যেন কোন ক্ষতি না হয়, কোন বালামুসিবত আসলে যেন আমার উপর দিয়ে যায়।

আসলে মা বাবার কাছে সন্তান কি জিনিস সেটা শুধুমাত্র মা বাবা হবার পরেই টের পাওয়া যায়। আমার স্ত্রী প্রতিষ্ঠিত ব্যাংকের চাকরী ছেড়েছে শুধুমাত্র সন্তানদের মুখের দিকে তাকিয়ে। আমি জানি আপনারাও আপনার সন্তানদের এমন বা এর থেকে আরো বেশি ভালবাসেন। এখন একটু চিন্তা করেন এই কলিজার টুকরারা বোমার আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে মারা গেছে, কচি দেহের অবশিষ্ট সামান্য অংশটুকু পোঁটলায় করে নিয়ে এক বাবা দোউড়াচ্ছেন।

অথবা একজন বাবার সামনে তার সব সন্তানের সারিবদ্ধ লাশ। কেমন হবে তাদের অনুভুতি, আসলে একজন পিতা হিসাবে আমি আর নিতে পারছি না। গতকাল থেকে মন প্রচন্ড খারাপ হয়ে আছে। গা*জায় হাসপাতালে বোমা হামলায় নিহত প্রায় ৫০০ জনের মধ্যে অধিকাংশই ছোট ছোট শিশু। তাদের ছবিগুলো দেখে আমি আর সহ্য করতে পারছি না। এক ধরণের মানসিক ট্রামার মধ্যে আছি। এই জান্নাতের পাখিগুলো উড়ে উড়ে জান্নাতে চলে গিয়েছে।

কিন্তু এই যে এত বড় অপরাধ যে হল, এর বিচার কি বিশ্বসমাজ করতে পারবে? জানি কোন বিচার হবে না। জালেমদের কিছুই হবে না। আমরা নিরুপায় অক্ষম, আমাদের কিছুই করার নেই। একমাত্র আল্লাহর কাছে তাদের শাস্তির জন্য ফরিয়াদ করা ছাড়া আর কিই বা করতে পারি। আল্লাহর শাস্তি বড়ই নির্মম। উনি ছাড় দেন কিন্তু ছেড়ে দেন না। সেই বিচারে অপেক্ষায় রইলাম। আল্লাহ্‌ যেন এসব জালেমদের সমুলে ধ্বংস করেন। আমিন!

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *