ফরেন রেমিটেন্স এর শ্রাদ্ধ

আমি গ্রামে থাকি। প্রায় সাত বছর হতে চলল এখানে আছি। কিন্তু চকারির কারনে এবং এখন ফ্রিল্যান্সিং করার কারনে, বাড়ির আশপাশে তেমন একটা ঘোরাঘুরি করা হয়নি। ফলে আমি তেমন কাউকে চিনিনা। তবে খেয়াল করে দেখেছি আমাকে প্রায় সবাই চেনে। এটা আমার কৃতিত্ব নয়। আমার বাপ দাদার কৃতিত্ব, তাদের পরিচয়েই আমি পরিচিত হই।

পেশাগত ব্যস্ততার খাতিরে পরিবারকে সময় দিতে পারিনি। বিশেষ করে আমার বড় ছেলেটাকে। ফলে তার সাথে আমার একটু দূরত্ব ছিল। যেহেতু এখন আমার বাসাতেই অফিস, ফলে পরিবারকে যথেষ্ট সময় দিতে পারি। এর জন্য আমি ফ্রিল্যান্সিং এর প্রতি কৃতজ্ঞ। কিছুদিন আগে চিন্তা করলাম যেহেতু গ্রামেই থাকব, তাই আশপাশের সবার সাথে পরিচিত হওয়া দরকার। মোটরসাইকেল নিয়ে ঘুরলে সবাই সমিহের দৃষ্টিতে দেখে। আর এদিকে ওজনও বেড়ে যাচ্ছে। তাই ঠিক করলাম সাইকেল চালাব।

বাসায় আমার ছোট বেলার সাইকেলটা পড়েই ছিল। প্রায় ১৫ বছর হয় সাইকেল চালাইনা। সাইকেল চালাতে আমার খুবই ভাল লাগত। আবার পুরোনো দিনে ফিরে গেলাম। সাইকেল ঠিক করা হল। আমরা বাপ বেটা দুই জনে মিলে প্রতিদিন বিকালে সাইকেল নিয়ে বেড়িয়ে পড়ি। যেতে যেতে দুজনে অনেক কথা হয়। যেখানে খুশি সেখনে চলে যাই। নাম না জানা জায়গায় যাই, মানুষের সাথে পরিচিত হই। সমস্যা একটাই আমি কাউকে চিনি না, আমাকে সবাই চেনে। এ এক আস্বস্তিকর অবস্থা।

গত কয়েক দিন আগের ঘটনা, এক গ্রামের ছোট বাজারে চায়ের দোকানে বসেছি চা নাশতার জন্য। চা খাচ্ছি আর আশপাশের মানুষের কথা শুনছি। গ্রামের চায়ার দোকানে আলাপ হয় না, এমন বিষয় মনে হয় দুনিয়াতে নাই। বারাক ওবামা থেকে শুরু করে, কার বউ কয় মাসের প্রেগন্যান্ট এই সব নিয়েও আলোচনা হয় 😀

চা খাচ্ছি, এমন সময় দেখি সবাই একটা মৃত্যুর বিষয় নিয়ে আলোচনা করছে। ভাল করে কান পাতলাম। ঘটনা হচ্ছে গ্রামের একজন মারা গেছে, বেচারা মালয়েশিয়াতে চাকরি করে। প্রায় ১৫ বছর ধরে সেখানে ছিল। মাঝে দুই/ তিন বার দেশে এসেছিল। শেষবার ৫ বছর আগে এসেছিল। তার হার্টের রোগ আর ডায়াবেটিস ছিল। একটু বেশি আয়ের আশায় সে পালিয়ে গিয়ে আরেক জায়গায় চাকরি নিয়েছিল। ফলে সে নাকি অবৈধ হয়ে গিয়েছিল। এখন সমস্যা হচ্ছে তার লাশ পাঠানো নিয়ে। অনেক খরচ, যেহেতু সে অবৈধ। বাংলাদেশিরা চাঁদা তুলে পাঠাবার চেষ্টা করছে। কিন্তু তা প্রয়জনের তুলনায় অপ্রতুল। তার ছোট ছোট বাচ্চা আছে, আর পরিবারের কাছে তেমন নগদ কোন টাকা নেই। তাই তারাও পারছেনা কিছু করতে। আলোচনা থেকে যেটা বুঝলাম, তাকে হয়ত মালয়েশিয়াতেই দাফন করতে হবে। শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেল।

বাসায় ফিরতে ফিরতে, মনে হল, এই লোকটা দেশের জন্য কিছু করেছে। নিজের সবকিছু ত্যাগ করে ফরেন রেমিটেন্স দেশে পাঠিয়েছে। অথচ আজকে তার খবর কেউ রাখে না। দেশের লাখ প্রবাসীর এত কষ্টের ফরেন রেমিটেন্স কত সুন্দরভাবে হ্যাকাররা নিয়ে যায়। কারো কোন মাথা ব্যাথা হয় না। তাই এই অভাগার ব্যাপারে কারো মাথাব্যাথা হবে না এটাই স্বাভাবিক।

দেখলাম আমিও কষ্ট করে ফরেন রেমিটেন্স দেশে আনি। কারন আমি একজন ফ্রিলান্সার, মুক্ত পেশাজীবী! রাতের পর রাত নির্ঘুম জেগে কাজ করি। আমার ইনকামের ২০% শুরুতেই কেটে রাখা হয়। এরপর টাকা আনতে গেলে কত রকমের ফি আছে। তার পর টাকা হাতে পাই। সেই হতভাগার কথা আবার মনে পড়ে গেল, আমরা শুধু কলুর বলদের মত খেঁটেই যাই দেশের জন্য। আমাদের কোন খবর কেউ রাখে না। আমরা আসলেই অসহায়।

Facebook Comments

Comment List

  • Md. Rabby Islam 10 / 06 / 2019

    হ্যাঁ ভাই। ভালো কথা বলেছেন কলুর বলদ ই আমরা

    • admin 11 / 06 / 2019

      ঠিক বলেছেন ভাই। আমাদের পেশার স্বীকৃতি এখনো পাইনি। সেদিন একজন ফ্রিলান্সার ভাই ব্যাংকে গিয়েছিলেন লোন নেয়ার জন্য। ব্যাংক সরাসরি না করে দিয়েছে। বলেছে আপনি প্রতি মাসেই ইনকাম করবেন তার গ্যারান্টি কি। আর আপনি যে আসলেই ইনকাম করেন তার প্রমান কি। আসলে কিছু বলার নেই!

Comments are closed.