আংকেল টু ভাইয়া, ভাইয়া টু নানা

পূর্ব কথা

ছোট বেলা থেকেই আমার শরীর স্বাস্থ্য আল্লাহর রহমতে ভাল, মায়ের দিকের জিন পেয়েছি এই জন্য মনে হয়। আমি খুব বেশি খাই না, তা পরেও স্বাস্থ্য কমে না। আর যদি ভাল মন্দ একটু খাই তবেত কথাই নেই। আমার একটা হিসাব আছে ৩ঃ২, মানে আমি যদি শ্বশুর বাড়িতে বেড়াতে যাই। তবে প্রতি তিন দিনে, আমার ওজন দুই কেজি বাড়ে। এই জন্য চেষ্টা করি শ্বশুর বাড়ী দুই দিনের বেশি না থাকতে। আমার বড় মেয়ে হবার সময় শ্বশুর বাড়ি ৭ দিনের মত ছিলাম। ফলাফল বুঝতেই পারছেন। তবে ছোট বেলায় অনেক খেলাধুলা, আর নিয়মিত ব্যায়াম করার কারনে শরীর সব সময় ফিট ছিল।
 
মার্কেটিং এ চাকরীতে ঢোকার পরেও ফিটনেস ধরে রেখেছিলাম। রাতে কাজ শেষ করে বাসায় আসার আগে, অন্তত এক ঘণ্টা জিমে ঘাম ঝরাতাম। একটু আরামের আশায় মার্কেটিং এর চাকরি ছেড়ে, অফিশিয়াল জব নিলাম। সারাদিন ডেস্কে বসে থাকি। সকাল থেকে রাত। বাড়িতে বসে বউ আর মায়ের হাতের মজার মজার রান্না খেয়ে, আর ব্যায়াম না করাতে, ওজন হু হু করতে বাড়তে লাগল। ডায়েট করে কমাবার চেষ্টা করি, কিন্তু কাজে আসে না। কমবে কি করে, দুই দিন ডায়েট করলে, ভাল ভাল খেয়ে, সেটা তিন দিন সেলিব্রেট করি 🙂 ফলাফল কি সেটা বুঝতেই পারছেন। ভুড়ি বাড়তে বাড়তে ডেস্কে ঠেকে গেল। সব সময় হাঁসফাঁস করি। ওজন তখন প্রায় ৯০ কেজি। বুঝলাম সামনে বিপদ আসছে। ঘটলোও তাই, অফিসে আমার নাম্বার ওয়ান শত্রু, জানি দুশমন, আমার অফিসের বসের, শকুনের দৃষ্টি আমার উপর পড়ল। সে পানিশমেন্ট হিসেবে আমাকে বান্দরবনে পোস্টিং দিয়ে দিল। বলল একটু হাওয়া বদল করে আসেন, ওজন ঠিক হয়ে যাবে। কি আর করার, তিন মাসের গর্ভবতী স্ত্রী, দুই বছরের ছোট ছেলে, আর মা ভাইকে রেখে, বাক্স পেটরা গুছিয়ে, অজানার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম।
 

আংকেল টু ভাইয়া

মনে আছে বাসে যখন উঠলাম, তখন এক সুন্দরী ইয়াং লেডি আমাকে বলল আংকেল একটু সাইড দেন। রাগে দুঃখে মরে যেতে ইচ্ছে করল 🙁 বয়স আর এমন কিইবা হয়েছে? এই বয়সেই আংকেল? ভাবতেই চোখে জল চলে আসল :'( জেদ চেপে গেল, যেভাবে হোক ওজন কমাতেই হবে। পাহাড়ে চার মাস থাকলাম। প্রতিদিন পাহাড়ে উঠা নামা করতে হয়। প্রচণ্ড হাড় ভাঙা শারীরিক পরিশ্রম, আর ব্যায়ামের ফলে ওজন কমে একেবারে স্লিম হয়ে গেলাম। ওজন ৯৩ কেজি থেকে একেবারে ৭০ কেজিতে নেমে এল। নিজেকে দেখে, নিজেই চিনতে পারি না। নিজেকে পাখি মনে হত। মনে হত উড়ে বেড়াই। পেটের ৪ প্যাক সহজেই দেখা যায়, বাকী দুই প্যাক উঁকি ঝুকি মারছে। সুযোগ পেলেই আয়নায়, খালি গায়ে, নিজেকে ঘন্টার পর ঘণ্টা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখি। মেয়েরা যেমন সুন্দর সাজু গুজু করার পর, নিজেকে আয়নায় দেখে, এই রকম আরকি! অনেকটা আত্মপ্রেম বলা চলে। মনে আছে, চার মাস পরে বাড়ি ফিরছি। সেই একই কোম্পানির একই ধরনের বাসে উঠেছি। জিন্স আর স্কিন টাইট গেঞ্জি পরা, চোখে কালো সানগ্লাস। সেই একই রকম ঘটনা। এক অল্প বয়সী সুন্দরী ললনা হেসে মিষ্টি সুরে বলল ভাইয়া, একটু সাইড দেবেন? গর্বে আমার বুকটা ফুলে উঠল। আমি আংকেল থেকে আবার ভাইয়ায় উন্নত হয়েছি। সেই আনন্দ ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। শুধু অনুভব করা যায়। আমার জীবনের অন্যতম বড় অর্জন হচ্ছে এটা। কিন্তু আফসোস এই অর্জন আমি ধরে রাখতে পারিনি। কেন পারিনি এবার সেই গল্পে আসছি।
 

ভাইয়া টু নানা

ফ্রিলান্সিং করব এই নিয়তে চাকরি ছেড়ে বাড়িতে চলে এলাম। টিকে থাকার জন্য পর পর দুইটা বিজনেস করলাম এবং মোটামুটি বড় রকমের ধরা খেলাম। প্রচন্ড পরিশ্রম আর টাকার চিন্তায়, আরও শুকিয়ে যেতে থাকলাম। ব্যাবসার খাতিরে ব্যাংক, বিভিন্ন সরকারী অফিসে, নিয়মিত যাতায়ত করতে হত। তখনো আমার ফিটনেস ভালই ছিল। কোন অফিসে গেলে, আমাকে সবাই বেশির ভাগ সময়, তুমি বলে সম্বোধন করত। মনে করত আমি মনে হয় বাচ্চা ছেলে। অথচ আমি অনেক আগেই ৩০ পেরনো দুই বাচ্চার বাপ। এই কথা বললে অনেকেই বিশ্বাস করতে চাইত না। মনে আছে ছোট ভাইয়ের প্রিলির ফরম তুলতে গিয়ে, কলেজের স্যারের বকা খেয়ছি। সে আমাকে তার ছাত্র মনে করে, ইচ্ছে মত ধুয়ে দিয়েছে ক্লাশ না করার জন্য। অথচ বয়সে তার থেকে কয়েক বছরের বড় হব। মন খারাপ হলেও, এই ভেবে ভাল লাগত যে, আমি অনেক ফিট আছি, তারুণ্যকে ধরে রাখতে পেরেছি। এই সৌভাগ্য কয় জনের হয়!
 
গ্লুকোমিটারের বিজনেস করার সময়, প্রায়ই কাস্টমারের বাসায় যেয়ে মেশিন বুঝিয়ে দিতে হত। এক বয়স্ক কাস্টমার প্রায়ই অপ্রয়োজনে তার বাসায় ডাকত। তার ছিল পাঁচ মেয়ে, তিন টার বিয়ে হয়ে গেছে, দুইটার বাকী। পিঠা পিঠি বোন, একটা এস এস সি পাশ করেছে, আরেকটা দেবে। ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দুই মেয়েকে আমার কাছে মেশিন দিয়ে পাঠাত। আমি তাদের সুন্দর করে মেশিন বুঝিয়ে দিতাম। আমি কিছুটা বোকা সোঁকা টাইপের মানুষ। তাদের উদ্দেশ্যটা কি ঠিক বুঝতে পারতাম না। তারা যে আসলে আমাকে, বিয়ের করার জন্য তাদের যে কোন একটা মেয়েকে, চয়েজ করার অপশন দিয়েছে, সেটা আমি অনেক পরে বুঝেছি। তাদের জাল অনেকটাই গুটিয়ে এনেছে বলে, মনে হতে লাগল, কারন বাড়িতে কে কে আছে, জিজ্ঞেস করত, একদিন বলল, আমাদের বাড়িতে খুব শীঘ্রই তারা যাবে, আমার মায়ের সাথে নাকি বিশেষ কথা আছে। একদিন কথা প্রসঙ্গে বলে ফেললাম, আমি দুই বাচ্চার বাপ। সেই আংকেল আন্টির চেহারা দেখার মত হয়েছিল, বিশেষ করে আন্টিত প্রায় কেঁদেই ফেলে এমন অবস্থা :'( বুঝতেই পারছেন, এত দিনের পরিশ্রম সব বৃথা। এর পরে আর কোন দিন, আমাকে তাদের বাসায় ডাকেননি। আল্লাহ আমাকে তিনটা মেয়ে দিয়েছে, এখন তাদের সেই কষ্ট ভাল করেই অনুভব করি।
 
ব্যাবসার পরে ফ্রিলান্সিং শুরু করলাম। আস্তে আস্তে হাতে টাকা আসতে লাগল। সারাদিন পিসির সামনে বসে থাকি। ব্যায়াম করারত প্রশ্নই আসে না। হাতে কাঁচা টাকা আসলে যা হয়, কাজ, খাওয়া আর ঘুম এর বাহিরে আর কোন কাজ নেই। সব সময় ভাল মন্দ কেনা কাটা করি, ভাল মন্দ খাই। বাজারের সবাই আলাদা চোখে দেখে, খাতির করে। শহরে গেলে সব থেকে ভাল হোটেলের, ভাল ভাল খাবার টেস্ট করা চাইই চাই। আস্তে আস্তে ওজন বাড়তে লাগল। আমি সেই আগের পর্যায়ে যেতে লাগলাম। আগের ওজনের রেকর্ড ভেঙ্গে ফেললাম তাও প্রায় দুই বছর হয়ে গেছে। ওজন বাড়তে বাড়তে এখন শতকের কাছাকাছি।
 
আমি ভাইয়া থেকে একেবারে নানা হয়ে গেছি (বাস্তবেও আমি নানা, মানে আমার ভাতিজার বাচ্চা হয়েছে)। ব্যাপারটা খুলে বলি, সেদিন শহরে গিয়েছি একটা কাজে, রিক্সার জন্য দাঁড়িয়ে আছি, এমন সময় এক রিক্সাওয়ালা আমাকে ডাক দিচ্ছে এই বুইড়া নানা, কই যাবেন? আমি মনে করেছিলাম সে মনে হয় অন্য কাউকে বলছে। পরে দেখলাম সে আমাকেই বলছে। মেজাজ খারাপ হয়ে গেল >:( সে অশিক্ষিত রিকশাওয়ালা ভুল করেছে, এই ভেবে মনকে সান্ত্বনা দিলাম। কিন্তু ভুল ভাংল এই সেদিন। গাড়িতে করে শহরে যাচ্ছি, গাড়ি একটা স্টপেজে থেমেছে, এমন সময় এক ইয়াং লেডি, আমাকে বলছে নানা, একটু সাইড দেন, নামব। আমি হথভম্বের মত হা করে চেয়ে রইলাম। এ আমি কি শুনলাম :O শেষ মেস আমি নানা হয়ে গেলাম? আংকেল হলেও চলত, তাই বলে একেবারে নানা :'( মনটাই ভেঙ্গে গেল। আসলে হজ্জ করে আসার পর, গত দুই বছর ধরে বড় দাড়ি রাখছি, সাথে এই বাড়তি ওজনের হাতির মত শরীর। সবাইত নানা ডাকবেই, বাস্তবতা মেনে নিতেই হবে, কি আর করার।

পরিশিষ্ট

আগের সেই স্টামিনা আর নেই। এখন আমি চার বাচ্চার বাপ। তিনটা মেয়ে আমার, তাদের নিয়ে অনেক টেনশন। চল্লিশ ছুই ছুই এই আমি, এখনই জীবনের হিসাব মেলানো শুরু করেছি। সেই ইয়াং বয়সের মত জিন্স আর স্কিন টাইট গেঞ্জি, চোখে সানগ্লাস লাগিয়ে হিরো হতে চাই না। ইচ্ছা নেই ইয়াং লেডিদের সামনে, নিজেকে জাহির করার। বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না, স্কুল কলেজের মেয়েদের দেখলে, আমার মধ্যে এখন পিতৃভাব জাগ্রত হয়। তাদেরকে নিজের মেয়ের মত মনে হয়। আমার মেয়েরা বড় হলে, দেখতে কি এদের মত হবে? এখন সেই হিসাব মেলাই। আসলে আমার বেশি কিছু চাওয়ার নেই, ওজনটা কমিয়ে, একটু সুস্থ ভাবে জীবন যাপন করতে পারলেই হল। কারন আমার উপরে অনেক দায়িত্ব। গাদা গাদা ওষুধ খাওয়া, কিছু দিন পর পর হাসাপাতালে ভর্তি হওয়া, আর ডাক্তারের চেম্বারে ঘণ্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করতে, এখন আর ভাল লাগে না। সুস্থতা যে আল্লহর কত বড় নিয়ামত, সেটা হাড়ে হাড়ে টের পাই।
 
সুস্থ থেকে যেন নিজের দায়িত্ব পালন করতে পারি, এই জন্য সবার নিকট দোয়া প্রার্থী। সবাই নিজের প্রতি খেয়াল দিন, সুস্থ থাকুন, ভাল থাকুন ।
 
ধন্যবাদ!

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *