পহেলা বৈশাখ, আর ছোট একটা ভাল লাগার গল্প

বছর কয়েক আগের কথা। সেদিন পহেলা বৈশাখ বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন ছিল। সেই দিনটি পরিবারের সবাইকে নিয়ে অনেক সুন্দর ভাবে কেটেছিল!  পহেলা বৈশাখ নিয়ে অনেক ধরনের বিতর্ক দেখা যায়।  আমার মাথায় আসে না, আমাদের উৎসবের এই দিনটি নিয়ে কেন ইদানীং এতটা বিতর্ক 🙁 অথচ পহেলা বৈশাখ আমাদের শত বছরের ঐতিহ্য। আমাদের বাবার্‌ দাদারা তাদের পূর্বপুরুষেরা এই উৎসব পালন করেছেন, জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সবাই মিলে মিশে এক সাথে। কখনো কোন সমস্যা হয়নি। সব কিছুতে ধর্মকে টেনে আনা আমার খুবই অপছন্দের।

সেদিন অনেক গরম পড়েছিল, তাই বাহিরে বের হব না বলে ঠিক করেছিলাম, এছাড়া কাজের অনেক ব্যাস্ততাও ছিল। কিন্তু বিকেলে বাচ্চাদের চাপচাপিতে সবাইকে নিয়ে বের হতেই হল আমাদের গ্রামের মেলাতে। উল্লেখ্য আমি গ্রামে থাকি। চিরাচরিত গ্রাম্য মেলা, তবে এখন গ্রামেও আধুনিকতার ছাপ পড়েছে। মেলাতে দেশি বিদেশি আকর্ষণীয় পণ্য বেশ ভালই পাওয়া যায়। মনে আছে আমার সামনেই, একজন রিমোট কন্ট্রোল হেলিকপ্টার দরদাম করছিল, আড়াই হাজার টাকায়। কয়েক বছর আগেও এটা ছিল কল্পনারও বাহিরে। গ্রামের মানুষের ক্রয় ক্ষমতাও অনেক বেড়েছে।

আমিও কয়ক হাজার টাকা খরচ করেছিলাম, বাচ্চাদের খেলনার জন্য, বাচ্চাদের আনন্দ বলে কথা। তবে যা যা কিনেছিলাম তার মধ্যে দেশীয় ঐতিহ্যের ছিটেফোঁটা নেই 🙁 হাবিজাবি অসংখ্য জিনিসের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ১২০০ টাকা দিয়ে আমার বাচ্চার সাইজের, প্রায় দ্বিগুণ সাইজের দুইটা বড় পুতুল (চাইনিজ পাণ্ডা)। পিওর চায়না মাল, আমার মাথায় আসেনা, এত সস্তায় চীনারা এই জিনিস দেয় কিভাবে। আমি বছর কয়েক আগে চীনে অফিশিয়াল ট্যুরে গিয়েছিলাম। সেখানের বাজারে আমি জিনিসের দরদাম করে দেখেছি, জিনিসের দাম আমাদের দেশের থেকেও বেশী। মনে হয় চীনারা আমাদের অনেক ভালবাসে। তাই প্রায় পানির দামে সবকিছু দিয়ে দেয় 🙂 পুতুলগুলো এতটাই বড় ছিল যে, বাসায় আনার পর , রাখার যায়গা খুজে পাওয়া যাচ্ছিল না। আর বাসায় আসার পথে দাম বলতে বলতে গলা শুকিয়ে যাবার অবস্থা হয়েছিল  😀 এটা গ্রামের ঐতিহ্য, কোন কিছু দেখলেই সবাই দাম জিজ্ঞেস করবে। না বললে মাইন্ড করবে। কি আর করার 🙁 ভাবছি এর পর থেকে জিনিসের গায়ে বড় করে দাম লিখে রাখব, তাহলে আর বার বার বলা লাগবে না, কি বলেন আপনারা?

আজকের লেখার উদ্দেশ্য কিন্তু এসব নিয়ে নয়। তাহলে কি নিয়ে সেই ভাল লাগার গল্প? এবার আসি সেই প্রসঙ্গেই। মেলা থেকে সবাই মিলে ফেরত আসছি। পড়ন্ত বিকেল, সন্ধ্যা হতে বেশী দেরি নেই। এমন সময় দেখি একজন বৃদ্ধ লোক কয়েকজন বাচ্চাকে নিয়ে মেলার দিকে যাচ্ছে। ধরনা করি বাচ্চাগুল তার নাতি নাতনী। হাতে দুইটি পাখা। পাখাগুলো খুবই সুন্দর, তাল পাতার চিকন বিনুনিতে অসাধারণ নকশার হাত পাখা। দেখেই বুঝা যায় অনেক যত্নে তৈরি করা হয়েছে। অনেক মজবুত। গ্রামে বয়োবৃদ্ধ কিছু মানুষের মধ্যে এই ঐতিহ্য এখনো আছে। তারা অনেক চমৎকার হাতের কাজ পারে। যেগুলো আমাদের গ্রামীণ ঐতিহ্য। তারা অবসর সময় এগুলো তৈরি করে। এরপর গ্রামের হাটে নিয়ে বিক্রি করে। খুব বেশী না, হয়ত এক দুইটা আইটেম। বিক্রি করার টাকা দিয়ে, হয়ত কিছু সদাই পাতি কিনে, একটা চা খেয়ে, পান মুখে দিয়ে রাতে বাড়িতে ফেরে। আমার দাদাকেও দেখতাম বাঁশ দিয়ে চমৎকার ঝুড়ি বানাতে। বর্ষাকালে যখন কাজ থাকত না তখন হাত জাল তৈরি করত। ২/৩ মাসে একটা জাল তৈরি হত। অনেক খাটুনীর কাজ।

আমাদের গ্রামের হাঁটে প্রায় ৮০ বছরের এক বৃদ্ধকে গত কয়েক বছর ধরে আমি ফলো করি। যিনি নিজের হাতে কাঠের জিনিসপত্র তৈরি করেন। যেমন খড়ম (কাঠের স্যান্ডেল মত), কুপির স্ট্যান্ড, দা ছুরির হাতল, উকুন মারার চিরুনি ইত্যাদি ইত্যাদি। অসাধারণ তার হাতের কাজ। যেমন মজবুত তেমনই কারুকার্যময়।কিন্তু প্রায় সময়ই কিছু বিক্রি হয় না। কারন মানুষ এখন অনেক আধুনিক, এসব আর লাগে না। কিন্তু তিনি তারপরেও এগুলো তৈরি করেন, কারন এগুলো করতে তার ভাল লাগে।

আমি একবার শখ করে এক জোড়া খড়ম (এক ধরনের কাঠের স্যান্ডেল) তৈরি করিয়েছিলাম। যদিও আমার এগুলোর কোন দরকার নেই। তার পরেও কিনেছিলাম। কেন কিনেছিলাম সেই রহস্য পরে ফাঁস করছি। আমার পায়ের সাইজ অনেক বড়, এই সাইজ তার কাছে ছিল না। তাই বড় খড়ম বানাবার অর্ডার দিলাম এবং পুরা টাকাই জোর করে অগ্রিম দিয়ে আসলাম। এর পর এর কথা ভুলেই গেলাম। অথচ তিনি তার দায়িত্ব ঠিকই পালন করেছিলেন।আমার খড়ম তৈরি করে তার পরের হাটেই আমার মামার দোকানে দিয়ে এসেছিলেন। আমি অনেক পরে মামার দোকান থেকে খড়ম জোড়া নিয়ে আসি। এই অসাধারণ হাতের কাজ হয়ত আর খুব বেশিদিন টিকবে না। কারন পরবর্তী প্রজন্মের এর প্রতি কোন আগ্রহ নেই। কেউ এই কাজ শিখতে চায় না। তারও অনেক বয়স হয়েছে। হয়ত আর খুব বেশি দিন এই দৃশ্য দেখব না, যে এক হতাশ বৃদ্ধ, গ্রামের হাঁটে কোন এক দোকানের সামনে তার হাতের কাজের জিনিসপত্র নিয়ে উদাস নয়নে বসে আছে। যে দোকানের সামনে বসেছে, দোকানদার বার বার তাগাদা দিচ্ছে উঠে অন্য কোথাও বসতে। কারন তার বেচাবিক্রিতে সমস্যা হচ্ছে। বেচার এক যায়গা থেকে আরেক যায়গায় বসছে যদি কিছু বিক্রি হয়।

ত এবার ফিরে যাই মেলার সেই পাখাওয়ালার কাছে। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম চাচা কত দিয়ে কিনেছেন? তিনি বললেন এগুলো বিক্রির জন্য। যদিও বাড়িতে আমার পাখার খুব একটা প্রয়োজন পড়ে না (বাসাতে আইপিএস আছে অনেক্ষণ ব্যাকআপ পাই)। কিন্তু তার এই পাখাগুলো না কিনে স্থির থাকতে পারলাম না। দাম কত চাই বলল ৯০ টাকা। আমি বললাম কিছু কম হবে কি না? তিনি বললেন ৭৫ টাকা দেন। আমি পাখাগুলো হাতে নিয়ে তাকে ১০০ টাকা দিলাম। তিনি ২৫ টাকা ফেরত দিয়ে বাচ্চাদের নিয়ে মেলার দিকে হাঁটা দিলেন। এই পাখা শহরে যে কেউ ১০০ টাকায় কিনে নেবে, হয়ত ড্রইং রুম সাজাবে, এগুলো এতটাই অসাধারণ। তার কাছে যদি আরো পাখা থাকত তবে আমি সব কিনে নিতাম।

আমি জানি আমার লেখা পরে আপনাদের ধৈর্যচ্যুতি হচ্ছে। অনেকেই আমার পাগলামির মাথামুণ্ডু বুঝতে পারছেন না। এবার আসল কথায় আসি, আমি এই সব অভাবি মানুষ দের কাছ থেকে এমনিতেই এগুলো কিনি। কারন আর কিছুই না, আমার আসল উদ্দেশ্য তাদেরকে আর্থিক ভাবে কিছু সাহায্য করা। কারন ইনাদের আত্মসম্মন বোধ অনেক প্রবল। না খেয়ে মরবে কিন্তু কখনোই হাত পাতবে না। কখনোই ভিক্ষা করবে না। আর আমি নিজেও ভিক্ষা দেই না। কারন ভিক্ষা করা পাপ। একেবারে অসহায় হলে সেটা ভিন্ন কথা।

আমার পাখা ওয়ালা চাচা যখন আমাকে ভাংতি দিচ্ছিল, তখন আমি দেখেছি তার কাছে বড় কোন নোট নেই। আমার ১০০ টাকাই সব থেকে বড়। বাচ্চাগুলোকে নিয়ে মেলায় যেয়ে হয়ত সামান্য কিছু কিনে দেবে। এতেই হয়ত বাচ্চারা খুশীতে আত্মহারা হয়ে যাবে। সাথে সেই চাচাও। তাদের এই খুশির সাথে থাকতে পেরে আমারও একটা ভাল লাগা পেয়ে বসল। এটাই আজকের নববর্ষে আমার বড় প্রাপ্তি, ভাল লাগার গল্প।

আমার ইচ্ছা আছে ক্যামেরা নিয়ে বেড়িয়ে পড়ার। এই সব মানুষদের কথা, তাদের সুখ দুঃখ ক্যামেরায় ধারন করার। তারপর ইউটিউবে ছেড়ে দেয়ার। তারা হয়ত একদিন পৃথিবীতে থাকবে না, তাদের কাজও কেউ চাক্ষুষ দেখবে না। কিন্তু ভিডিওতে সৃতি হিসেবে রয়ে যাবে, তারা আসলে কতই না অসাধারণ গুনসম্পন্ন ভাল মানুষ ছিল।

সবাই ভাল থাকবেন।

ধন্যবাদ!

Similar Posts